প্রকাশিত: ২০/০৯/২০১৮ ৭:৪২ এএম

ঢাকা: যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রেখে সংসদে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় হাতকড়া পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সাংবাদিক নেতারা। তারা বলছেন, এই আইনের ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ হবে। সাংবাদিকরা প্রতি পদে পদে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অন্তত আটটি ধারায় গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের আপত্তি থাকলেও তা সুরাহা না করেই বুধবার ( ১৯ সেপ্টেম্বর) সংসদে পাস করা হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল। সংসদেও বিলটি উত্থাপনের পর বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য তা বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব করেন। তারাও বলেন, বিলে স্টেকহোল্ডারদের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে। বাকস্বাধীনতার জন্য এটা উদ্বেগজনক।

পাস হওয়া এই আইন সাংবাদিকতায় কী প্রভাব ফেলতে পারে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি মোল্লা জালাল সারাবাংলাকে বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংসদে পাস হওয়ায় মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে সাংবাদিক সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। এই মিশ্র প্রতিক্রিয়ার কারণে এটি কালো আইন হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।

তিনি বলেন, কালো আইনে মানুষ কখনও ন্যয়বিচার পায় না। ফলে আইনটির প্রতি মানুষের আস্থা থাকবে না। আর আস্থাহীন আইন প্রয়োগ করলে মানুষের প্রতি জুলুম করা হবে। জুলুমের মাধ্যমে কখনও দেশে আইনের শাসন হবে না।

বিএফইউজে সভাপতি আরও বলেন, বিগত দিনে অনেক সরকারই কালো আইন করেছে, কিন্তু ঠিকিয়ে রাখতে পারেনি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কালো আইনের মোড়ক দেওয়া হলে এই আইনও টিকবে না।

বাংলাদেশ ফেডারেশন সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) একাংশের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন সাংবাদিকতার কবর রচনা করলো সরকার। এই আইন পাসের মধ্যে দিয়ে আমরা ডিজিটাল যুগ থেকে আবার অন্ধকার যুগে ধাবিত হলাম। আইনটি পাসের মধ্যে দিয়ে বর্তমান সরকার একটা কালো অধ্যয়ের সূচনা করলো।’

তিনি আরো বলেন, ‘গোটা সাংবাদিক সমাজের আপত্তির মুখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি আরো কঠোরভাবে প্রয়োগ করে পাস করা হয়েছে। এই আইনে ভিন্নমত প্রকাশের কোনো সুযোগই নাই।’

এই কালো আইন সাংবাদিকদের পক্ষে মানা সম্ভব না উল্লেখ করে রুহুল আমিন গাজী আরো বলেন, ‘এই আইন মানলে স্বাধীন সাংবাদিকতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মানুষের মৌলিক অধিকার বলে কিছইু থাকবে না। এই আইন সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক তথ্য অধিকার আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। সর্বোপরি সংবিধানে আর্টিকেল ১০ অর্থ্যাৎ সংবিধানে মানুষের যে মৌলিক অধিকার দিয়েছে তারও পরিপন্থী। এই আইনের মাধ্যমে কোন লোককে বিনা ওয়ারেন্টে চাইলেই গ্রেফতার করতে পারবে। এই আইন করার প্রতিবাদে আগামী ২২ সেপ্টেম্বর সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হবে।’

বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ ধরনের আইন সঠিক সাংবাদিকতায় সংকট তৈরি করবে, যা স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী, মুক্তবুদ্ধি চর্চার পরিপন্থী।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সম্পাদক পরিষদ থেকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিলাম, এ আইনের বেশ কয়েকটি ধারার বিষয়ে আমাদের আপত্তি রয়েছে। কিন্তু দেখা যায়, আমাদের সেই আপত্তির জায়গাগুলো সংশোধন করা হয়নি। এর আগে যখন এটি মন্ত্রিপরিষদ সভায় পাস করা হয়, তখন আমরা এটা প্রত্যাখান করেছিলাম। বিশেষ করে ৩২ ধারা নিয়ে আমাদের জোরালো আপত্তি ছিল।’

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়েনের (ডিইউজে) সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘৩২ ধারা কিভাবে রাখা হয়েছে, সেটা এখনও জানি না। ৩২ ধারার বিরুদ্ধে আমিসহ ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সবাই এর বিরুদ্ধে। এই ৩২ ধারা সংশোধনের কথা ছিল। কিন্তু যদি সংশোধন না করা হয়ে থাকে, সাংবাদিক বা সংবাদকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য বিতর্কিতধারা গুলো রেখে যদি বিলটি পাস করা হয়ে থাকে, তাহলে সেটি আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক।’

জানতে চাইলে চ্যানেল আই অনলাইনের সম্পাদক জাহিদ নেওয়াজ খান বলেন, কোনো ধারা বা আইনের কারণে অনুসন্ধানী সাংবাদকিতা বসে থাকবে না। ভয়ের জায়গা হলো- ৩২ ধারাকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে ব্যবহারের সুযোগ আছে এবং রাষ্ট্র ও সরকার সেটা করবে।

‘কিন্তু এখন সাংবাদিকরা কি প্রতিবাদে নামবে? আমাদের সম্মিলিত মেরুদণ্ড এখন অতটা শক্ত নয়,’- বলেন জাহিদ নেওয়াজ খান।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি ও বৈশাখী টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক সাইফুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে এ আইনের ফলে সাংবাদিকরা পদে পদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ আইনের অনেকগুলো ধারায় সংশোধনী দিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়সহ সব জায়গায় আমরা আমাদের মতামত জানিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমাদের সুপারিশ অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়াও সারাবাংলাকে বলেন, এককথায় এ আইনের ফলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব ও সংকুচিত হবে।

এর আগে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ছিল। এই ধারা ব্যবহার করে অনেক সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়। ‘কালো আইন’ অভিহিত করে আইসিটি আইনের এই ৫৭ ধারা বাতিলের দাবিতেও বিভিন্ন সময় আন্দোলন করেছেন সাংবাদিকরা। ডিজিটাল সিকিউরিটি বিল পাস হওয়ায় আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা আর কার্যকর থাকবে না। তবে সাংবাদিকরা বলছেন, ৫৭ ধারায় যে বিষয়গুলো ছিল, সেই বিষয়গুলোই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন ধারায় আরও বিস্তারিত আকারে সংযুক্ত হয়েছে।

বুধবার পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট ১৯২৩-এর আওতায় কোনো ব্যক্তি সরকারি কোনো কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক্স মাধ্যমে তথ্য পাচারের অপরাধ করলে বা করতে সহায়তা করলে তিনি ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার সংঘটিত করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এই বিলের ৪৩ ধারায় বিনা ওয়ারেন্টে তল্লাশি ও গ্রেফতারের পাশাপাশি ক্ষতিকর তথ্য-উপাত্ত ব্লক বা অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। এক্ষেত্রে জাতীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিলের মহাপরিচালকের অনুমোদনক্রমে পুলিশ যেকোনো স্থানে প্রবেশ ও তল্লাশি করতে পারবে এবং বাধাপ্রাপ্ত হলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে। কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম ও নেটওয়ার্কসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ও দলিল জব্দ ও ওই ব্যক্তি গ্রেফতার করতে পারবে। তবে তল্লাশি শেষ করার পর এ বিষয়ে ট্রাইবুনালকে প্রতিবেদন দিতে হবে।

২১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান বা তাতে মদত দেন, তাহলে ওই ব্যক্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড ও এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

বিলের ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট আ অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে (ক) ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলে জানা থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন; বা (খ) রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুন্ন করার বা বিভ্রান্তি ছড়ানোর বা একই উদ্দেশ্যে অপপ্রচার বা মিথ্যা বলে জানা থাকা সত্ত্বেও কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে তিনি ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৩ লাখ টাকা অর্থ দণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার সংঘটিত করলে ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন ওই ব্যক্তি।

২৮ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার বা উসকানি দেওয়ার অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন, তাহলে তিনি ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার সংঘটিত করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

বিলের ২৯ ধারায় ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে পেনাল কোডের ৪৯৯ ধারা অনুযায়ী মানহানিকর কোনো তথ্য প্রচার ও প্রকাশ করার দায়ে ৩ বছরের কারাদণ্ড ও ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তবে একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার সংঘটিত করলে ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে।

৩১ ধারায় বলা হয়েছে, ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ তৈরি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটানোর উপক্রম হয়, তাহলে তিনি ৭ বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার সংঘটিত করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন ওই ব্যক্তি।

বিলের ৮ ধারায় বলা হয়েছে, জাতীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিলের মহাপরিচালকের নিজ অধিক্ষেত্রভুক্ত কোনো বিষয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি তৈরি করলে তিনি ওই তথ্য-উপাত্ত অপসারণ, ক্ষেত্রমতো ব্লক করার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বা বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবেন। একই ধারায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও জনশৃঙ্খলা রক্ষায় মহাপরিচালকের মাধ্যমে একইভাবে তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ব্লক করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আইনের এ ধারায় সরকারকে অবহিত করে বিটিআরসিকে তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া অনুরোধ কার্যকর করার সক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

গত ২৯ জানুয়ারি ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।

পাঠকের মতামত

মেয়াদবিহীন ইন্টারনেট প্যাকেজ চালুর কথা বললেন উপদেষ্টা নাহিদ

জনগণের চাহিদার কথা বিবেচনা করে মেয়াদবিহীন ইন্টারনেট প্যাকেজ চালুর জন্য বাংলালিংক প্রতিনিধিদের বললেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ...