মেহেদী হাসান ::
রোহিঙ্গা সংকটের রাজনৈতিক সমাধান এবং এ দেশে আশ্রিতদের সুরক্ষা—বাংলাদেশ সফরে এ দুটি বিষয়েই জোর দিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। পাশাপাশি তাঁরা রোহিঙ্গা নিপীড়নের দায়ে মিয়ানমারকে জবাবদিহির আওতায় আনার বিষয়েও তাগিদ দিয়েছেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, রোহিঙ্গাদের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের এ সফর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে এ দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার ব্যাপারে তাঁরা আরো সরব ভূমিকা রাখবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু এ সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির ব্যাপারে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ঐক্যবদ্ধভাবে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক কালের কণ্ঠকে বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের একক ক্ষমতা জাতিসংঘ বা বিশ্বব্যাংকের নেই। বিশেষ করে, জাতিসংঘ পরিচালিত হয় সদস্য দেশগুলোর মাধ্যমে। এর পরও জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরব ভূমিকা পালন করছেন। গত বছর তিনি এ ইস্যুতে দৃষ্টি দেওয়ার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে এক নজিরবিহীন চিঠি দিয়েছেন। গত সোমবার তিনি রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করে বিশ্বকে উদ্যোগী হওয়ার জোর তাগিদ দিয়েছেন।
ওই কূটনীতিক বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশ সফর করলেও মিয়ানমার সফর করেননি।
এর মাধ্যমে তিনি মিয়ানমারকে একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশকে ৪৮ কোটি মার্কিন ডলার মঞ্জুরি সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আবার মিয়ানমারকে প্রতিশ্রুত অর্থ সহায়তা দেওয়া স্থগিত রেখেছে। এর মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর কিছু না কিছু চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বেশি চাপ দিলে মিয়ানমারের বেসামরিক সরকারেরও অস্তিত্ব সংকটে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ঢাকায় সুইডেনের রাষ্ট্রদূত শারলোটা স্লাইটার গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠ’র এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, বিশ্ব সম্প্রদায় রোহিঙ্গা সংকটের রাজনৈতিক সমাধান ও মানবিক সংকট মোকাবেলা—দুটি বিষয় নিয়েই কাজ করছে। বিশেষ করে, তাঁর দেশ সুইডেন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হিসেবে এ সংকটের সমাধান খুঁজতে অন্য সদস্যদের সঙ্গে কাজ করছে।
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, রাজনৈতিক সমাধান ও মানবিক পরিস্থিতি মোকাবেলা—এ দুইয়ের মধ্যে সংগত কারণে মানবিক সংকট মোকাবেলাকেই জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংক আপাতত অগ্রাধিকার দিচ্ছে। কারণ রাজনৈতিক সমাধান দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর কয়েক দশক ধরে চলা বঞ্চনা এবং রাষ্ট্রহীন করে রাখার নীতি রাতারাতি বদলানো কঠিন।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য মিয়ানমারের বেসামরিক সরকারকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাগিদ দিয়ে আসছে। জাতিসংঘ মহাসচিবও গত সোমবার কক্সবাজারে সাংবাদিকদের বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে না পারার ব্যর্থতা জাতিসংঘের নয়, মিয়ানমারের। আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির প্রেসিডেন্ট পিটার মাউরাও গতকাল ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের অধিকারসহ নিজেদের বাসভূমিতে ফেরানোর মতো দায়িত্বশীল নেতৃত্বের ওপর জোর দিয়েছেন।
এদিকে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি গতকাল কক্সবাজার থেকে এক ভিডিও বার্তায় স্পষ্ট করে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের সবাই একটি কথাই বলছে। তারা নাগরিকত্ব পরিচয় নিয়েই ফিরতে চায়। এটি নিশ্চিত করা না হলে তাদের ফিরে যাওয়া অসম্ভব যদি নাও হয়, খুব কঠিন হবে। তিনি আরো জানান, ইউএনএইচসিআরের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল বর্তমানে রাখাইন রাজ্য সফর করছে। সেখানে এখন যে পরিস্থিতি তা কোনোভাবেই রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ফেরার জন্য অনুকূল নয়।
সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশি কর্মকর্তারা বলেছেন, সংকটের দ্রুত সমাধান হবে এমনটি বাংলাদেশও মনে করে না। তবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব না হলে সবচেয়ে বিরূপ প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের ওপর। বাংলাদেশ এ সংকট সমাধানে মিয়ানমার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংক আশ্বাস দিয়েছে, সংকট মোকাবেলায় তারা বাংলাদেশের পাশে থাকবে। বাংলাদেশে আশ্রিত ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে বাঁচিয়ে রাখতে বিপুল পরিমাণ সাহায্য প্রয়োজন। জরুরি চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয় প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের মধ্যে মাত্র ২৬ শতাংশের জোগান মিলেছে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আরো ভূমিকা পালন করতে পারে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রসঙ্গ তুলেছেন কি না—গত সোমবার রাতে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সংবাদ সম্মেলনে এমন প্রশ্ন উঠেছিল। জবাবে তাঁর উপমুখপাত্র ফারহান হক জানান, জাতিসংঘ মহাসচিব যেখানেই যান না কেন মানবাধিকার সম্পর্কিত বিষয়গুলো তুলে থাকেন। তবে বাংলাদেশে বৈঠকের বিষয়ে তখনো তাঁর কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল না।
গণতন্ত্র ও নির্বাচনের আগে আইনের শাসন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে ফারহান হক বলেন, তাঁর কাছে বৈঠকের বিষয়ে পূর্ণ তথ্য নেই। তবে আলোচনার বেশির ভাগ অংশজুড়েই ছিল রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তার প্রসঙ্গে।