প্রকাশিত: ২৭/১১/২০১৬ ৭:৫৮ এএম

উখিয়া নিউজ ডটকম::

মানবপাচারকারী ও ইয়াবা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ হচ্ছে। দুই দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে নিত্য নতুন কৌশলে অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। সীমান্তে কড়াকড়ির মধ্যেও ওই সি-িকেটের সহায়তায় প্রতিদিন শত শত রোহিঙ্গা এদেশে ঢুকে পড়ছে। তবে এখন টেকনাফের চেয়ে উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত পথ দিয়ে বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটছে। টেকনাফ সীমান্তে কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করায় এখন উখিয়া অংশ বেছে নিয়েছে দালাল ও রোহিঙ্গারা।

গতকাল শুক্রবার টেকনাফের হৃীলা ইউনিয়নের লেদা শরণার্থী শিবির ও উখিয়া উপজেলার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প ম্যানেজমেন্ট কমিটি ও অনুপ্রবেশকারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ভোরে আড়াই শতাধিক মানুষ বাংলাদেশে ঢুকেছে। ভোরের আলোর ফোটার সাথে সাথে এদেশীয় দালাল ও স্বজনদের মাধ্যমে ক্যাম্পে ঢুকে পড়েছে তারা। বরাবরের মতো তারাও বলেন, স্থানীয় দালালের সহায়তায় নাফ নদী পেরিয়ে রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে তারা। দুই দেশের সীসান্ত রক্ষী বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দালালদের দেখিয়ে দেয়া পথে এদেশে ঢুকে পড়ে। তারাও মিয়ানমান সরকারের অমানবিক নির্যাতনের কথা বর্ণনা দেন।
চলমান সীমান্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বিজিবি‘র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন সকালে টেকনাফ বন্দরের মালঞ্চ হলে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় করেছেন। বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে বলে স্বীকার করে তিনি বলেন, যেসব পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা ঢুকছে, সেসব পয়েন্টে নজরদারি বাড়ানো হবে। এছাড়াও সীমান্ত এলাকায় পর্যায়ক্রমে কাটা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা দেয়া হবে।
অনুপ্রবেশকারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল শুক্রবার টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, জালিয়াপাড়া, নয়াপাড়া, উলুবনিয়া, হোয়াইক্ষ্যং, লেদা এবং উখিয়া উপজেলার কুতুপালং, ধুমধুম, ভালুরিয়া, পাতাবাড়ি, রেজুখালী, বালুখালী, বালুখালী কাস্টমস অফিস এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকার তমরু পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে।
গত তিন দিন সরেজমিন ঘুরে এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, গত সপ্তাহে টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কক্সবাজারে বিজিবি ও বিজিপি বাহিনীর সাথে পতাকা বৈঠকের পর টেকনাফ এলাকায় নাফ নদী ও সীমান্ত এলাকায় অনুপ্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। সীমান্তে বিজিবি ও নাফ নদীতে কোস্টগার্ড সদস্যদের টহল বাড়ানো হয়েছে। এছাড়াও টেকনাফ এলাকা নাফ নদীর প্রশস্ত বেশি। এসব মিলে টেকনাফ অংশে অনুপ্রবেশে কিছুটা কড়াকড়ি করা হয়েছে। তবুও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটছে। তবে টেকনাফে কড়াকড়ি বাড়ানো হলে উখিয়ার উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বেশি অনুপ্রবেশ ঘটছে।
মংডুর সিংড়িপাড়ার জোবাইদা বেগম গতকাল শুক্রবার ভোরে সদ্যজাত শিশু সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন টেকনাফ লেদা ক্যাম্পে। তিনি বলেন, চারদিন আগে বাংলাদেশ সীমান্তের হৃীলা এলাকায় পৌঁছে চার দিন বন-ধানক্ষেতে ছিলাম। কিন্তু বিজিবির কড়া পাহারার কারণে লোকালয়ে আসতে পারিনি। শেষতক এক দালাল দয়া করে আমাকে ক্যাম্পে নিয়ে এসেছে।
উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তি ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি আবু সিদ্দিক জানান, গতকাল ভোরে শতাধিক লোক ঢুকেছে। তারা আত্মীয়স্বজনের ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বলেন, এখানে দু-তিনদিন থাকার পর অবস্থানকারীরা আবার অন্য জায়গায় চলে যাবে।
একই কথা বললেন, টেকনাফের হৃীলা ইউনিয়নের লেদা ক্যাম্প ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি দুদু মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক আমির হোসেন। তারা বলেন, মিয়ানমার সরকারের অমানবিক নির্যাতন ও সহিংসতার কারণে আরাকান মুসলিমরা এদেশে ছুটে আসছে। গতকাল শুক্রবার ভোরে এই ক্যাম্পে শতাধিক লোক এসেছে বলে জানায় তারা।
মংডুর কাউয়াবিল এলাকার মনসুমা খাতুন বলেন, নির্যাতনের পর একটি গ্রামে আশ্রয় নিই। সেখানে খাল-জঙ্গল ও পাহাড়ি পথে তিন দিন হেঁটে নাফ নদীর সীমান্ত এলাকায় পৌঁছাই। মিয়ানমার বাহিনীর কড়াকড়ির কারণে প্যারাবনে লুকিয়ে থাকি। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা একটু সরলে নদীতে নেমে নৌকায় তিন-চারজন করে এপারে ঢুকে পড়ি। একসঙ্গে ১৭ জন ঢুকেছেন বলে জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, এসময় ওপারে বনে, পাহাড়ে আরও কয়েক শত লোক অবস্থানে ছিল। মিয়ানমারের দালালদের জনপ্রতি ২০-২৫ হাজার কিয়াত (মিয়ানমারের মুদ্রা) এবং বাংলাদেশি দালালদের দুই থেকে তিন হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে। দুই দেশের দালালদের টাকা দিয়ে অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। অনেকেই আবার টাকা দিতে না পারলে স্বর্ণাংলঙ্কার দিয়ে এদেশে ঢুকে পড়ছে।
জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় বাসিন্দা, আশ্রিত রোহিঙ্গা, শরণার্থী শিবিরে আশ্রিতদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সাম্প্রতিক ঘটনায় ১০ হাজারের বেশি লোক বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। বিভিন্ন বস্তিতে রোহিঙ্গাদের স্বজন, দালাল ও যেকোনোভাবে ঢুকে পড়ছে। রোহিঙ্গা বস্তিগুলো অরক্ষিত থাকায় রাতের আঁধারে তারা ঢুকে যাচ্ছে। দিনের বেলায় সীমান্তপথে দুই দেশের সীমান্ত বাহিনীর কড়াকড়ি বেশি থাকে। তাই দিনের বেলায় ঝোপ-ঝাড়ে অবস্থান নিয়ে রাতে বেলায় সুযোগ বুঝে পাড়ি জমাই।
মংডুর কেয়ারিপাড়ার মনজিলা বেগম (৬০) জানান, ঘরের দরজা বন্ধ করে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে মিয়ানমার সেনা বাহিনী। পেছনে পালিয়ে জীবন রক্ষা করেছি। কিন্তু চোখের সামনে স্বামী ও এক ছেলেকে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে। আর এক মেয়েকে পাশবিকভাবে নির্যাতন করেছে। নির্যাতিত এই কিশোরিও মুখ গুজিয়ে রাখে।
মংডুর জাম্বুনিয়ার বদি আলম (৭০) জানান, স্ত্রীকে মেরে ফেলা হয়েছে। দুই ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছি না। ছোট মেয়েটিকে কিভাবে নির্যাতন করল। মেয়ের ইজ্জত বাঁচাতে ছুটে গিয়েছিল মেয়ের মা। তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে। ৫ দিন আগে ছেলের বউ ও এক বছরের নাতনিকে নিয়ে নাইচং গ্রামে পালিয়ে যাই। পাড়ায় ভিক্ষা করে টাকা জোগাড় করে বাংলাদেশে পাড়ি দিয়েছি। তিনি বলেন, মেয়ে দেখলেই হামলে পড়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও উঠতি যুবকেরা। ঘরে ঘরে ঢুকে মেয়েদের নির্যাতন করছে। কেউ রেহাই পাচ্ছে না।
দুই দিন আগে অনুপ্রবেশ করেছেন গজিরবিল এলাকার গৃহবধু ছমিরা বেগম। তার ছোট দুই কৈশোরি বোনের উপর পাশবিকতা চালানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, উখিয়া, টেকনাফ ও রামু আঞ্চলিক কমিটি
মনোয়ারা বেগম মুন্নি বলেন, মিয়ানমারে সরকারি উদ্যোগে সেদেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর বর্বতা চালানো হচ্ছে। নারী ও শিশুদের ওপর বেশি নির্যাতন চালানো হচ্ছে। নির্যাতিত মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এদেশে ছুটে আসছে। কিন্তু মিয়ানমারের দায় কেন বাংলাদেশ সরকার নেবে ? তিনি বলেন, যেহেতু রাষ্ট্রীয় নির্দেশে মিয়ানমারে বর্বর হত্যাকা- চলছে, সেহেতু বিষয়টি সমাধানের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক হামিদুল হক চৌধুরী
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী এই অঞ্চলের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। বিভিন্ন বিয়ে-শাদি করে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। এখানকার জনগণের নাগরিক সুবিধা ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এমনকি বিভিন্ন নির্বাচনে রোহিঙ্গা প্রভাব ফেলছে। এছাড়াও রোহিঙ্গাদের দারিদ্র্যকে পুঁজি করে একটি গোষ্ঠী তাদের নানা অপকর্মে ব্যবহার করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন করা না হলে দেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল খায়ের বলেন, উখিয়া সীমান্ত এলাকা বিশাল। পুরো এলাকায় পাহারা চৌকি বসানো সম্ভব নয়। এই ফাঁকে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু রোহিঙ্গা ঢুকে পড়ছে।
টেকনাফ বিজিবির ২ ব্যাটালিয়ের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুজার আল জাহিদ জানান, সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাড়তি নিরাপত্তা জোরদার করেছে বিজিবি, কোস্টগার্ড ও পুলিশ। এ তৎপরতার ফলে আগের তুলনায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অনেকটা কমে এসেছে।

পাঠকের মতামত

কক্সবাজারে বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশনের তিন দিনব্যাপী কর্মশালা শুরু

কক্সবাজারে বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশনের আয়োজনে শুরু হয়েছে ’আবহাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন ও জনস্বার্থ সাংবাদিকতা’ শীর্ষক তিনদিনব্যাপী ...

ফ্যাসিবাদ ও বৈষম্য মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করুন : টেকনাফে মাওলানা মুহাম্মদ শাহজাহান

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা মোঃ শাহজাহান বলেছেন, ফ্যাসিবাদ ও বৈষম্যমুক্ত ব্যতিক্রমধর্মী বাংলাদেশ ...