সপ্তম শ্রেণিপড়ূয়া সন্তানের জন্য দেড় কোটি টাকা মূল্যের গাড়ি কিনেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন! সিটি মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র ১৫ মাসের মাথায় ছেলেকে এমন দামি গাড়ি উপহার দিচ্ছেন তিনি। জাপানের গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টয়োটার বিলাসবহুল লেক্সাস ব্র্যান্ডের গাড়িটি এরই মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পেঁৗছেছে। গত শনিবার বন্দরের ৪ নম্বর শেডে গিয়ে মেয়র নিজেই গাড়িটি দেখে এসেছেন। সাদা রঙের
বিলাসবহুল এ গাড়িটি ২০১৬ মডেলের। সপ্তম শ্রেণি পড়ূয়া শিশুসন্তানকে এমন বিলাসবহুল গাড়ি উপহার দেওয়ার বিষয়টিকে ভালোভাবে দেখছে না সুশীল সমাজ। প্রসঙ্গত, নির্বাচনের সময় জমা দেওয়া হলফনামায় বিভিন্ন ব্যাংক-বীমায় নাছির আট কোটি ৬৩ লাখ ৯৪ হাজার টাকা ব্যাংক ঋণ রয়েছে বলে উল্লেখ করেছিলেন। বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন তিন কোটি ৬২ লাখ ৩২ হাজার টাকা।
গাড়ি কেনার বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন শনিবার রাতে সমকালকে বলেন, ‘ছেলের শখ পূরণ করতে গাড়িটি কিনেছি। তবে এটি কেনার প্রক্রিয়া মেয়র হওয়ার আগেই শুরু করেছিলাম। আজ (শনিবার) বন্দরে গিয়ে দেখে এসেছি।’
তবে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি অধ্যাপক সিকান্দার খান বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার ১৫ মাসের মাথায় গাড়ি তিনি কিনতেই পারেন। তবে সপ্তম শ্রেণি পড়ূয়া সন্তানকে এত দামি গাড়ি উপহার দেওয়াটা দৃষ্টিকটু। ওনার ভালো আয় থাকতে পারে। কিন্তু মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে তো এত দামি গাড়ি ব্যবহার করেননি।’
অনুসন্ধানে দেখা যায়, নির্বাচনের আগে জমা দেওয়া হলফনামায় মাত্র ১১ কোটি ৯৯ লাখ ৫১ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে বলে উল্লেখ করেছিলেন মেয়র। এর মধ্যে তার নিজ নামে ছিল ১১ কোটি ৫০ লাখ ৭৯ হাজার ২৬০ টাকার সম্পদ। আর স্ত্রীর নামে ছিল মাত্র ৪৮ লাখ ৭১ হাজার ৮৯২ টাকার সম্পদ। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রমের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হন তিনি। আগে থেকে এ ব্যবসায় যুক্ত থাকলেও নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে অপর দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব পায় মেয়রের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তবে এ কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার সময় এক বছর হয়নি। এরই মধ্যে ছেলের জন্য কিনলেন দেড় কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল লেক্সাস।
গাড়ি ব্যবসায়ী এনএসি অটো মোবাইলসের স্বত্বাধিকারী নুরুল আবসার চৌধুরী জানান, ২০১৬ সালে তৈরি লেক্সাস ব্র্যান্ডের অত্যাধুনিক গাড়ির দাম শুল্কসহ প্রায় দেড় কোটি টাকা। এ ধরনের গাড়ি ছাড় করাতে চট্টগ্রাম কাস্টমসে ক্রয়মূল্যের চেয়ে দুইশ’ থেকে চারশ’ গুণ শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হয়। জাপানে তৈরি হওয়া এ গাড়িটির আমদানিকারক চট্টগ্রামের গাড়ি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান কে কে অটোমোবাইলস। মেয়রের গাড়ি পরিদর্শনের সময় তাদের একজন প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরপরই আ জ ম নাছির জাপান থেকে টয়োটা আলফার্ড ব্র্যান্ডের কোটি টাকারও বেশি মূল্যের একটি বিলাসবহুল মাইক্রোবাস আমদানি করতে চেয়েছিলেন। মেয়রের জন্য এই গাড়িটি আমদানি করার কথা ছিল আগ্রাবাদের ফোর হুইলার্স লিমিটেড নামের একটি গাড়ি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের। এক কোটি ১৮ লাখ টাকা মূল্যের এ গাড়িটি কিনতে তিনি ২০ লাখ টাকা অগ্রিম পরিশোধও করেন। তখন এ নিয়ে আগেভাগে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় গাড়ি কেনা থেকে পিছু হটেন মেয়র। এরপর শখ পূরণ করতে সময় নেন ১৫ মাস। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ূয়া ছেলে আবু সাঈদ মো. তানবীরের জন্য এবার আরও বেশি দামের গাড়ি আনলেন মেয়র। প্রসঙ্গত, নওশীন নামে মেয়রের আরেকটি কন্যাসন্তান রয়েছে।
নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় আয়ের উৎস হিসেবে আ জ ম নাছির প্রধানত দেখিয়েছেন ব্যবসা খাতকে। শুধু এ খাত থেকেই তার বার্ষিক আয় হয় ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। এ ছাড়া কোম্পানি থেকে পরিচালক ভাতা হিসেবে ৪২ লাখ টাকা, ওয়াকফ বেনিফিশিয়ারি হিসেবে সম্মানি ৩ হাজার টাকা, অন্যান্য খাত থেকে ২৫ হাজার টাকা এবং ব্যাংক ইন্টারেস্ট বাবদ চার হাজার ৭৪৪ টাকা বছরে আয় আছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। নাছির বার্থ অপারেটর, সোয়েটার ফ্যাক্টরি, আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, ফিশিং ঘাট ইজারা এবং তেল পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে উল্লেখ করেন। ব্যবসায় থাকা বিনিয়োগের মধ্যে প্রোপাইটরশিপ ক্যাপিটাল হিসেবে ১০ কোটি ৭৪ লাখ ৫৫ হাজার ৪৯৮ টাকা, স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ার আছে ৯ লাখ ১৯ হাজার ৬৯৮ টাকার, কোম্পানির শেয়ার আছে ২১ লাখ ২২ হাজার ৫০০ টাকার, জীবন বীমা ও ডিপিএস কিস্তি হিসেবে জমা ৪১ লাখ ৬৫ হাজার ৮৬৮ টাকা। একইভাবে স্ত্রীর নামে কোম্পানির শেয়ার আছে ৩৪ লাখ টাকার। নিজের নামে কোনো এফডিআর না থাকলেও স্ত্রীর নামে নাছির ১২ লাখ ৫৪ হাজার ৩২০ টাকার এফডিআর রেখেছেন বলে উল্লেখ করেছিলেন হলফনামায়।
পাঠকের মতামত