প্রকাশিত: ২৬/০৫/২০১৭ ২:৪৮ পিএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৫:৩৩ পিএম

বিএনপি চলছে আট বছর ধরে এক কমিটি দিয়ে

তোফায়েল আহমদ কক্সবাজার ::
জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফার বক্তব্য—‘এলাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দলীয় নেতাদের কেন যে দলীয় সরকারের অবদানের কথা বলেন না তা বুঝছি না। নেতারা বলেন না দলীয় প্রধানের অবদানের কথাও। একটি সেতু উদ্বোধন করতে গিয়েও একজন এমপি বলে বসেন, এটি তিনিই দিচ্ছেন। বিশেষ করে এমপি আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে যত সব অভিযোগ। এই এমপি নাকি সীমান্ত জনপদে চাল-কাপড়সহ নানা ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন নিজের নামে। সব উন্নয়নের দাবিদার এমপি। ’

কয়েক দিন আগে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের এক সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করে এ কথা বলেন সিরাজুল মোস্তফা। তিনি বলেন, ‘জেলাবাসী চাওয়ার আগেই সব পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমরা দলের নেতারা সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। ’ তিনি বলেন, সরকার বিনা মূল্যে বই দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের। অথচ শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলে, প্রধান শিক্ষক বই দিচ্ছেন। তাদের একবারের জন্যও বলা হচ্ছে না, এসব বই শেখ হাসিনার সরকার দিচ্ছে।

কক্সবাজারে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রকে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, স্থানীয় এমপি পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়নের মাঝিরপাড়া শাহ রশিদিয়া আলিম মাদরাসার পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের একজন নেতাকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের কাছে সুপারিশ করেন। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের কিছু নেতা ওই পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য একজন স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করেন। ওই ব্যক্তি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝোলানো জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর কক্সবাজারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ক্যাশিয়ার ছিলেন। এখন তাঁর অবস্থান বিএনপি-শিবিরে। দলের একজন নেতার পরিবর্তে একজন চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তির পক্ষে আওয়ামী লীগের কিছু নেতার প্রকাশ্য তদবির এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও ঘটেছে এ রকম বিতর্কিত ঘটনা। সীমান্তবর্তী উখিয়া-টেকনাফে দলীয় এমপির বিরোধিতার কারণে জেলা আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীদের কয়েকজন পরাজিত হন।

মহেশখালী দ্বীপের দুটি ইউনিয়নে নির্বাচন স্থগিত হয়েছিল। সেসব স্থানে আবার ভোটগ্রহণ করা হয়েছে গত মঙ্গলবার। নির্বাচনে নৌকা প্রতীকধারী দুই প্রার্থীই পরাজিত হয়েছেন। একটি কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকে ভোট পড়েছে মাত্র একটি। এসব ঘটনায় কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগকে নিয়ে নানা কথা উঠেছে। হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প এগিয়ে চললেও রাজনৈতিক সমর্থনের দিক থেকে সরকারি দলটি তেমন এগোয়নি। এর কারণ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে প্রচারমূলক কর্মকাণ্ডের অভাব। সাধারণ মানুষের কাছে সরকারের উন্নয়নের খবর পৌঁছাতে দলের নেতাকর্মীরা ব্যর্থ।

দলের এ অবস্থার মধ্যে কক্সবাজারের চারটি সংসদীয় আসনে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার লড়াইয়ে নেমেছেন অনেকে।

কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনে তীব্র দলীয় কোন্দলের মধ্যে প্রার্থী হতে চাইছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন আহমদ সিআইপি। তিনি তিনবার এ আসনে দলের প্রার্থী হয়ে পরাজিত হয়েছেন।

চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাফর আলম, কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার

জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রেজাউল করিম এবং সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়কারী আশরাফুল ইসলাম সজীব এ আসনে প্রার্থী হতে চান।

কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের আশেক উল্লাহ রফিক। তিনি ছাড়াও এ আসনে প্রার্থী হতে চান জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা ও সহসভাপতি অ্যাডভোকেট ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী, মহেশখালী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন ইব্রাহিম, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ওসমান গনি ও মহেশখালী উপজেলা কৃষক লীগ সভাপতি অধ্যাপক সরওয়ার কামাল।

কক্সবাজার-৩ (কক্সবাজার সদর-রামু) আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের সাইমুম সরওয়ার কমল। আগামী নির্বাচনে তিনি ছাড়াও সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী কানিজ ফাতেমা মোস্তাক, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগ নেত্রী নাজনীন সরওয়ার কাবেরী।

কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের আবদুর রহমান বদি। তাঁকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। গত ৬ মে কক্সবাজারের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইয়াবা পাচারকারীদের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করার পর ধারণা করা হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে তিনি দলের মনোনয়ন নাও পেতে পারেন। তবে বদির সমর্থকরা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ মনোনয়ন না দিলে তিনি স্বতন্ত্র অথবা বিএনপির প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করবেন। এ আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী ও শিল্পপতি মোহাম্মদ ইয়াহিয়া প্রার্থী হতে চান।

জেলা বিএনপির হালচাল : আট বছর ধরে কক্সবাজার জেলা বিএনপি চালাচ্ছে বর্তমান কমিটি। ২০০৯ সালে সংঘর্ষের কারণে জেলা বিএনপির সম্মেলন পণ্ড হয়ে যায়। পরে সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরীকে সভাপতি ও অ্যাডভোকেট শামীম আরা বেগম স্বপ্নাকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা কমিটি ঘোষণা করা হয়। এই মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিতে ঝগড়া-বিবাদের অন্ত নেই। এরই মধ্যে গত ১৩ মে তৃণমূল পর্যায়ে সম্মেলনের আয়োজন করেছিল জেলা কমিটি। সম্মেলনের আগে জেলা বিএনপির মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন বিদ্রোহী গ্রুপের নেতা সাবেক এমপি আলমগীর মোহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ ফরিদ। সহযোগী সংগঠনগুলোতেও বিরোধ রয়েছে।

জেলা সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী বলেন, চারটি সংসদীয় আসনেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি। তবে নতুন প্রার্থী তেমন নেই। প্রায় সবাই পুরনো।

কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনে সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী (বর্তমানে ভারতের শিলংয়ে অবস্থানরত) বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদের স্ত্রী হাসিনা আহমদ প্রার্থী হবেন। তবে সালাহ উদ্দিন আহমদ যদি দেশে ফিরে মামলা-মোকদ্দমা সামলে প্রার্থী হতে পারেন, তাহলে তিনিই এ আসনে নির্বাচন করবেন।

কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনে সাবেক এমপি আলমগীর মোহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ ফরিদ, অ্যাডভোকেট নুরুল আলম, কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এ টি এম নুরুল বশর চৌধুরী, মহেশখালী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবু বকর ছিদ্দিক প্রার্থী হতে পারেন। তাঁরা মাঠে সক্রিয় রয়েছেন।

কক্সবাজার-৩ (কক্সবাজার সদর-রামু) আসনে সাবেক এমপি লুত্ফুর রহমান কাজল নির্বাচন করার জন্য তৎপরতা চালাচ্ছেন। সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার সহিদুজ্জামানও মনোনয়ন চাইতে পারেন।

কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনে সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী প্রার্থী হবেন। তিনি মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন। তাঁর ছোট ভাই উখিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সরওয়ার জাহান চৌধুরী এবং টেকনাফ বিএনপির নেতা মোহাম্মদ আবদুল্লাহও দলের মনোনয়ন চাইবেন।

জাতীয় পার্টির হালচাল : কক্সবাজার জেলা জাতীয় পার্টির জেলা পর্যায়ে তৎপরতা থাকলেও সব উপজেলায় দলটি তেমন দৃশ্যমান নয়। জেলার দুটি আসনে তারা প্রার্থী দিতে চায়। কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনে বর্তমান এমপি মৌলভি মোহাম্মদ ইলিয়াস দল থেকেই মনোনয়ন চাইবেন বলে জানিয়েছেন। কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে প্রচারে রয়েছেন।

জামায়াতের হালচাল : জেলার রাজনীতিতে একসময় জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপক প্রভাব ছিল। সেই জামায়াত এখন নেই। বেশির ভাগ নেতাকর্মী গাঢাকা দিয়েছে। যারা মাঠে আছে তাদের বেশির ভাগ ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত। তবে গোপনে সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে দলটি। প্রতি সপ্তাহে এক-দুইবার গোপন বৈঠক হয়।

জেলার চার আসনের মধ্যে কেবল কুতুবদিয়া-মহেশখালী আসনে সাবেক এমপি ও ঢাকা মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। এলাকার নেতাকর্মী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ রাখেন। যদি জামায়াত নির্বাচন না করে তাহলে তিনি বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন। সেটা না হলে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন বলে সমর্থকরা জানিয়েছে।
সুত্র: কালেরকন্ঠ

পাঠকের মতামত