প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নবনির্মিত ঝিনুক আকৃতির অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন কক্সবাজার রেলস্টেশনটি ইতোমধ্যেই উদ্বোধন করেছেন। পহেলা ডিসেম্বর থেকে বাণিজ্যিকভাবে ঢাকা থেকে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়েছে বহু প্রতীক্ষিত এই রেলওয়ে যোগাযোগ। এই ট্রেন যোগাযোগে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পৌঁছাতে সময় লাগছে মাত্র সাত ঘণ্টা। সমুদ্র ভ্রমণ-পিপাসুদের জন্য এর চেয়ে আনন্দের সংবাদ আর কী হতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তি সুবিধা সম্পন্ন দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় এই আইকনিক রেল স্টেশনটির উদ্বোধনের পরে মানুষের ভিতর এই বিশ্বাস এরই মধ্যে এসেছে যে-পর্যটন নগরী কক্সবাজার এখন আর রাজধানী ঢাকা থেকে দূরবর্তী কোনো জেলা নয়। শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতির ফলে এই দূরবর্তী জেলাটিও নিকটবর্তী হয়ে উঠলো। সেই ষাট, সত্তর ও আশির দশকে এই কক্সবাজারে হোটেল-মোটেল ছিল খুবই কম। তখন বিভিন্ন স্কুলকলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী-পর্যটক বাধ্য হয়ে কক্সবাজারের বিভিন্ন স্কুল কলেজের বেঞ্চে কিংবা ফ্লোরে শুয়ে-বসে রাত পার করতেন। সাথে প্রয়োজনীয় বাজার ও রান্নার জন্য বাবুর্চি, হাঁড়ি-পাতিল তারা নিয়ে আসতেন। পর্যটকদের এত কষ্ট করে আসা শুধু একটু আনন্দের জন্য।
বহুল প্রত্যাশিত কক্সবাজারের আইকনিক রেলস্টেশন ও রেল লাইন প্রকল্পের উদ্বো ধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার নিয়ে তাঁর কৈশোরের যে গল্প বলেছেন তা আমাদের স্মৃতিতাড়িত না করে পারে না। তিনি খুবই আবেগঘনভাবে বলেছেন-বঙ্গবন্ধু জেলের বাইরে থাকলে পরিবার নিয়ে কক্সবাজার আসার চেষ্টা করতেন কিন্তু সেটা হয়তো সবসময় সম্ভবপর হতো না। প্রধানমন্ত্রী এও বলেছেন-১৯৬১ সালে তার পিতার সঙ্গে তিনি প্রথমবার এই কক্সবাজার আসেন। একটি ‘মোটেল’-এ তখন থেকেছেন, মোটেলের সাথে একটা কিচেন ছিল, সেখানে নিজেরা রান্নাবান্না করে খেয়েছেন। ’৬১-এর পর বঙ্গবন্ধুর জেলজীবন ও মুক্ত জীবনের ফাঁকে তার পিতার সঙ্গে আরও কয়েকবার এসেছেন বলেও তিনি জানিয়েছেন। আসলে এটা মোটেও বাড়িয়ে বলা নয় যে-মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্মৃতিতে অত্যন্ত গুরুত্ব নিয়ে সমুদ্র শহর কক্সবাজার একটা বিশাল জায়গা দখল করে আছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আবেগ ও ভালোবাসা এবং কক্সবাজারের অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেশকে আন্তর্জাতিকমান ও স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের জন্য তাঁর অদম্য আগ্রহ।
এটা অতিকথন নয়-কক্সবাজার বদলে গেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই। কক্সবাজারে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের এক-একটি বাস্তবায়ন শুরু হয়। সত্তর-আশির দশকে খোলা জিপ চাঁদের গাড়িতে করে শুটিং পার্টি এবং অ্যাডভ্যাঞ্চারাস পর্যটকরা হিমছড়ি, ইনানীর দিকে যেতেন। ’৯০-এর দশক থেকে মেরিন ড্রাইভ প্রকল্প শুরু হলেও বারবার অগ্রগতি থমকে গেছে। ১৯৯৬-এর সরকারে এসে এবং পরে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সালের সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় ইচ্ছায় মেরিন ড্রাইভের কাজ শেষ হয়েছে। কক্সবাজার সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘পৃথিবীতে দীর্ঘ সৈকত হয়ত আছে কিন্তু এই রকম ৮০ মাইল দীর্ঘ বালুকাময় সৈকত আর নেই। সৈকতের পুরো দৈর্ঘ্য ই উপভোগ্য, এমন সৈকত পৃথিবীতে বিরল। জাপানেও দীর্ঘ সৈকতগুলোতে কাদামাটির সৈকত বলে সহজে নামা যায় না। নেদারল্যান্ডসেও একই অবস্থা। স্পেন, পর্তুগালে বালুকাময় সৈকত আছে কিন্তু এত দীর্ঘ নয়।’
এ রকম একটা পৃথিবীখ্যাত সৈকত বেলাভূমি আমাদের দেশের জন্য সম্পদ। পৃথিবীর কাছে এই সম্পদ সহজে উন্মুক্ত করার উপায় বের করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে বিমানবন্দর সম্প্রসারিত হয়ে আন্তর্জাতিক মানের হচ্ছে। সাগর ছুঁয়ে আন্তর্জাতিক বিমান নামার সে স্বপ্ন দ্রুতই বাস্তবায়িত হবে এখন। সাগরের একটি অংশ পুনরুদ্ধার করে রানওয়ে নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে।
চীনের দু:খ যেমন হোয়াংহো, তেমনই একটা সময়ে কক্সবাজারের দু:খ ছিল চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কপথ। কিন্তু সে দু:খ আর এখন নেই। উন্নত হয়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের সড়ক ব্যবস্থা আর নতুনভাবে শুরু হলো রেলওয়ে ব্যবস্থা। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কক্সবাজারের যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন একটা এগোচ্ছে না-এই দু:খ কক্সবাজারবাসীর দীর্ঘদিনের ছিল। এখন সেসব হতাশা, দূ:খ ও আহাজারি দূর হয়ে গেছে। কক্সবাজার এখন সারাদেশের সঙ্গে অভূতপূর্ব যোগাযোগ ব্যবস্থায় সংযুক্ত হয়েছে।
জানা যায়-ব্রিটিশ সরকার ১৮৯০ সালেই কক্সবাজারের সাথে রেললাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল। পাকিস্তান আমলেও আরেকবার পরিকল্পনা হয়েছিল কিন্তু কাজ আর এগোয়নি। বিগত ১৩৩ বছরের ব্যর্থতাকে জয় করে প্রধানমন্ত্রী শক্ত হাতে হাল ধরে এবার কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ উন্মুক্ত করে দিলেন। যেকোনো পর্যটক রাতে ঢাকা থেকে উঠে সকালে আইকনিক রেল স্টেশনে নেমে দেখছেন, একটি ঝিনুক তার জন্য আধফোঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু কক্সবাজার নয় বিগত ১৫ বছরে রেলপথ সম্প্রসারিত হয়েছে প্রায় সারা দেশে। শুধু বরিশাল যাওয়া বাকি আছে মাত্র। সেটাও অচিরেই বাস্তবায়ন হয়ে যাবে এমন প্রত্যাশা আর অমূলক নয় মোটেও।
কক্সবাজার শহরটা পূর্ব-পশ্চিম লম্বালম্বি এক সড়কের শহর ছিল। দক্ষিণে পাহাড়, উত্তরে বাঁকখালী নদী। এ শহরটা দিনে দিনে বড়ো হয়েছে। জনসংখ্যা অনেকগুণ বেড়েছে। বাইপাস সড়ক হয়েছে। বসতি ঘন থেকে আরও ঘন হয়েছে। কিন্তু শহরটি সম্প্রসারিত হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত আগ্রহে, বাঁকখালী নদীর ওপর খুবই দৃষ্টিনন্দন ৫৬৫ মিটার দীর্ঘ একটি সেতু নির্মাণ করেছে এলজিইডি। এর ডিজাইনও প্রধানমন্ত্রী নিজে দেখে অনুমোদন করেছিলেন। সাগরের মোহনার কাছাকাছি এই ব্রিজ নির্মাণে অনেক চ্যালেঞ্জিং অধ্যায় গেছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় এলজিইডি এই অধ্যায়গুলো অতিক্রম করেছে।
জাপান সরকারের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে জাইকা এখন মাতারবাড়ি মহেশখালীকেও বদলে দিচ্ছে। বহু বহু উন্নত প্রকল্প এখন এসব জায়গায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। আর কক্সবাজার হয়ে যাচ্ছে দেশের গোটা অর্থনীতির গেম চেঞ্জার। কক্সবাজার পৌরসভায়ও জাইকা’র সিটি গভর্ন্যান্স প্রকল্প শুরু হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করছে এলজিইডি এবং পৌরসভা। কক্সবাজারের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ শহরটা বদলে যাবে এখন।
এ ছাড়া সাবরাং এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন, জ¦ালিয়ার দ্বীপ থেকে নেটংপাহাড় চূড়া পর্যন্ত পর্যটন বান্ধব মেগা প্রকল্প চলমান রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে কক্সবাজারের উন্নয়ন চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, উন্নয়নের ধারায় বদলে যাওয়া কক্সবাজারকে দেখাতেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ২০০৬-২০০৭ অর্থবছর থেকে শুরু করে বর্তমান ২০২২-২০২৩ অর্থবছর সময় পর্যন্ত কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে উন্নতি হয়েছে সে সম্পর্কে জানান জেলা প্রশাসন। বর্তমান সরকারের আমলে কক্সবাজারে শতাধিক প্রকল্প নেয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক কক্সবাজার, সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র, মেরিন অ্যাকুরিয়াম স্থাপন, ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপ লাইন, মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, দোহাজারি থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের নিকটে ঘুমঘুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ, মাতারবাড়ি ২৬০০ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপারক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্ট, কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, পুরো দেশের অর্থনীতির একটা বড় অংশ হচ্ছে কক্সবাজার। সরকারের বহুমুখী পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বাস্তবায়নে অনেকদূর এগিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে অনেক প্রকল্প শেষ হয়েছে আরো বড় বড় প্রকল্পের উন্নয়ন চলছে।
প্রধানমন্ত্রী একজীবনে কোটি কোটি মানুষের জীবনে আশার ফুল ফোটাচ্ছেন এবং ফুটিয়ে চলেছেন। দিনদিন কক্সবাজারবাসীর স্বপ্ন দেখার সাহস আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ, মধ্যম আয়ের দেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ, সোনার বাংলা এগুলো এখন স্বপ্ন নয় রীতিমতো বাস্তবায়িত। স্বপ্নগুলো এখন বাস্তবের পথ ধরে শুধু হাঁটছে না-তা রীতিমতো দৌড়ে চলেছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতা এগিয়ে চলুক এই প্রত্যাশা পর্যটন জেলা কক্সবাজারবাসীর।
ছৈয়দ আলম, কক্সবাজার
কক্সবাজারের উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ফের আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এবার ক্যাম্প-৪ ডাব্লিউতে পুড়ে গেছে তিনটি ...
পাঠকের মতামত