সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা হবে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা সরকারের এ সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়ে বলেছে, চরটি মানুষ বসবাসের উপযোগী নয়। সরেজমিন দেখা গেছে, রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে যে স্থানটি প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা হয়েছে, তা ঠেঙ্গারচরে নয় পড়েছে পার্শ্ববর্তী জালিয়ারচরে।
ঠেঙ্গারচর মেঘনা নদীর মোহনায় জেগে ওঠা নতুন দ্বীপগুলোর একটি। ২০০০ সালের পর এটি জাগতে শুরু করে। নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এর অবস্থান। ২০১১ সালে বনায়ন শুরু হয় এ দ্বীপে। ১০ হাজার একর আয়তনের দ্বীপটির বেশিরভাগ বর্ষায় ডুবে যায়। যে অংশটুকু অংশ উঁচু, সেখানেও মানুষের বসবাসের মতো অবস্থা তৈরি হয়নি।
ঠেঙ্গারচর থেকে আরও উত্তর-পূর্বে জালিয়ারচরের অবস্থান। ১৯৯০ সালের শুরুতে দ্বীপটি জেলেদের নজরে আসে। গাঙ্গুরিয়া মাছের আধিক্যের কারণে এক সময় এর নাম ছিল ‘গাঙ্গুরিয়ারচর’। পরে মানুষের মুখে মুখে নাম বদলে হয় জাইল্যারচর। পরে বন বিভাগের কাগজপত্রে নামকরণ হয় জালিয়ারচর। ঠেঙ্গারচরের চেয়ে পুরনো এ দ্বীপ। ১৯৯৮ সালে বনায়ন শুরু হয়। উঁচু অংশ বর্ষায় ডোবে না। মানুষের বসতি না থাকলেও দ্বীপটির জমি কৃষিকাজের উপযোগী হয়ে উঠেছে। গরু, মহিষ চরানো হয়।
জালিয়ারচর দৈর্ঘ্যে প্রায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার। প্রস্থে সোয়া চার কিলোমিটার। বন বিভাগের বা হাতিয়া উপজেলা ভূমি অফিসের কাছে এর আয়তন সম্পর্কে তথ্য নেই। তবে স্থানীয়ভাবে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, দ্বীপটির আয়তন ২৫ বর্গকিলোমিটারের কাছাকাছি। ভূমির পরিমাণ সাড়ে ছয় হাজার একরের মতো।
দুটি চরের অবস্থান পাশাপাশি হওয়ার কারণে রোহিঙ্গাদের ঠেঙ্গারচর না জালিয়ারচরে পুনর্বাসন করা হবে, তা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় এমপি (নোয়াখালী-৬) বেগম আয়েশা ফেরদৌস দাবি করেন, জালিয়ারচর নামে কোনো দ্বীপই নেই। দুই অংশে বিভক্ত দ্বীপটির নাম ‘চর প্রিয়া’। এক সময়ে যার নাম ছিল ঠেঙ্গারচর।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, ঠেঙ্গারচরের উত্তর-পূর্ব দিকে জালিয়ারচরের অবস্থান। এমপি জানান, সম্প্রতি নৌবাহিনীর প্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব ঠেঙ্গারচর পরিদর্শনে যান। তারা রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে যে স্থানটিকে চিহ্নিত করেছেন, তা মানুষ বসবাসের উপযোগী। সেখানে গরু-মহিষের বাথান আছে। আয়েশা ফেরদৌস বলেন, ‘যারা গিয়েছিলেন, তাদের কারও কাছে শুনিনি দ্বীপের চারপাশে কাদা, কাঁটা রয়েছে। মানুষ বসবাসের উপযোগী নয়।’ এমপির এ বর্ণনা অনুযায়ী, সরকারের প্রতিনিধিরা জালিয়ারচরেই গিয়েছিলেন, যা মানুষ বসবাসের উপযোগী।
স্থানীয় সাংবাদিক সুমন ভৌমিকও একই কথা জানান। একাধিকবার ঠেঙ্গারচর ও জালিয়ারচর ঘুরে আসা এ সাংবাদিক সমকালকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব জালিয়ারচরেই গিয়েছিলেন। রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে জালিয়ারচরকে চিহ্নিত করেছেন।’ একই তথ্য জানান, স্থানীয় আরেক সাংবাদিক শামীমুজ্জামানও।
তারা জানান, চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ থেকে দূরত্ব মাত্র দু-তিন কিলোমিটার। পুনর্বাসনের স্থান চিহ্নিত করার সময় উপস্থিত না থাকলেও উপজেলা চেয়ারম্যান মাহবুব মুর্শেদও দাবি করেন, জালিয়ারচর নামে কোনো দ্বীপের অস্তিত্ব নেই।
তবে নোয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, ঠেঙ্গারচরের চেয়ে বয়সে পুরনো জালিয়ারচর। ঠেঙ্গারচরে বনায়ন শুরু হয় ২০১১ সালে। জালিয়ারচরে বনায়ন শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। ১৯ বছর আগে রোপণ করা চারা ও বপন করা বীজ থেকে জন্মানো গাছ অনেক বড় হয়েছে। দ্বীপটি মানুষ বসবাসের উপযোগী।
সম্প্রতি সরেজমিন একই চিত্র দেখা গেছে। নৌকা ছাড়া ঠেঙ্গারচর বা জালিয়ারচরে যাওয়ার উপায় নেই। তবে জলদস্যুর ভয় থাকায় মাঝিরা যেতে সহজে রাজি হন না। হাতিয়ার নলচিরা ঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ঠেঙ্গারচর যেতে সময় লাগে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। সেখান থেকে চোখে দেখা দূরত্ব হলেও জালিয়ারচর যেতে সময় লাগে আধা ঘণ্টা থেকে পৌনে এক ঘণ্টা।
ঠেঙ্গারচর পেঁৗছে দেখা যায়, চারদিকে হাঁটু সমান কাদা। কাদা না মাড়িয়ে দ্বীপে ওঠার উপায় নেই। নদীর কূল থেকে কয়েক ফুট ওপরে উঠতেই দেখা যায় ছোট ছোট গাছ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সঙ্গে যাওয়া স্থানীয় সংবাদকর্মীরা জানালেন, এখানে সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। প্রতি বর্ষায় দ্বীপের প্রায় ৮০ শতাংশ তলিয়ে যায়। বড় গাছপালা না থাকায় সাগর যখন উত্তাল থাকে, তখন ঝড়ো বাতাসে কাঁচা বাড়িঘর টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
তাহলে এমন একটি বিরান বিপদসংকুল দ্বীপে রোহিঙ্গাদের কী করে পুনর্বাসন করা সম্ভব! স্থানীয়দের দাবি, এখানে নয়, ঠেঙ্গারচর থেকে কিছু দূর সন্দ্বীপ লাগোয়া জালিয়ারচরে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প হবে। নৌকা রওনা হয় জালিয়ারচরের দিকে। দ্বীপটির দক্ষিণ দিক ভাঙছে। তবে অন্যদিকে ভূমি জাগছে বলে জানান স্থানীয়রা। সেখানে দেখা হওয়া জেলে ভবেশ চন্দ্র জানান, এ দ্বীপের নাম জালিয়ারচর। তবে মুখে মুখে নাম হয়ে যাচ্ছে ঠেঙ্গারচর।
জালিয়ারচর পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। দ্বীপের বুক চিড়ে রয়েছে কয়েকটি খাল। জোয়ারের পানি খাল দিয়েই চলাচল করে। খাল দিয়ে দ্বীপের কিছুটা ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, দ্বীপের দক্ষিণে গভীর বন রয়েছে। বনের ভেতর বেশ কয়েকটি গাছ কাটা। জলদস্যু ও পথ হারানোর ভয়ে বনের অভ্যন্তরে বহিরাগতদের প্রবেশ করতে বারণ করেন মাঝি ও জেলেরা।
তবে এখানে মহিষ বাথানের রাখালদের বাস রয়েছে। জেলেরা জানান, ১০-১৫ বছর বয়সী অনেক গাছ-গাছালিও রয়েছে জালিয়ারচরে। এর মধ্যে কেওড়া, ঘেউয়া, বাইন ও গোলপাতা অন্যতম। দ্বীপের চারদিকে বেড়িবাঁধ ও রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হলে এখানে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মানুষের বাস সম্ভব।
ঠেঙ্গারচর বা জালিয়ারচর নিয়ে মৌলিক তথ্য নেই বন বিভাগ ও ভূমি অফিসের কাছে। স্থানীয়রা জানান, দুই চরেরই পাশে নতুন ভূমি জাগছে (স্থানীয়ভাবে বলা হয় লেসকি)। চর দুটি ধীরে ধীরে যুক্ত হচ্ছে। গুগলের আর্থ ভিউয়ে যে স্যাটেলাইল চিত্র রয়েছে, তাতে দেখা যায়, ঠেঙ্গারচর ও জালিয়ারচরের মাঝে যতটা দূরত্ব রয়েছে, পুরোটাই কাদা রঙের। নীল পানির চিহ্ন নেই। অর্থাৎ দ্বীপ দুটির মাঝে যে দূরত্ব, সেখানের পানির গভীরতা খুবই কম। পলি জমে আগামী কয়েক বছরে তা ভেসে উঠে সরাসরি যোগাযোগ সৃষ্টি হতে পারে দুই দ্বীপের মধ্যে।
সুত্র: সমকাল