বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমারে মুসলিমবিরোধী বর্ণবাদ নিরুৎসাহিত করে এবং সামরিক বিচ্ছিন্নতা ছাড়াই রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানের পথ খুঁজে বের করার জন্য লড়াই করছেন দেশটির নেত্রী অং সান সু চি। সু চির ঘনিষ্ঠ একজন উপদেষ্টার বরাত দিয়ে ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য টাইমস এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
নবীন গণতান্ত্রিক এই দেশটির ক্ষমতা আবারও সেনাবাহিনী কেড়ে নিতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, বর্ণবাদ নিয়ন্ত্রণ ও সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়েই সঙ্কট সমাধানে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন সু চি।
সেনা অভিযানে হত্যা ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনায় নীরব ভূমিকা পালন করায় দেশের বাইরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী মিয়ানমারের এই নেত্রী। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের রাখাইনে সেনাবাহিনীর নৃশংস অভিযানে পাঁচ লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে।
ওই উপদেষ্টার মতে, সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান এড়িয়ে ও কট্টর জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ সন্যাসীদের মাঝে মুসলিমবিরোধী উত্তেজনা উসকে না দিয়ে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা ও অন্যান্যদের দুর্দশা দূর করার জন্য কাজ করছেন সু চি।
‘সেনাবাহিনীর বিরোধীতা সত্ত্বেও কীভাবে বেসামরিক সরকার ত্রাণ সরবরাহ, সংহতি ও শান্তি পুনরায় স্থাপন করতে পারে সেবিষয়ে আগ্রহী তিনি’- সু চির অবস্থানের ব্যাপারে কয়েকজন ব্রিটিশ সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে এ মন্তব্য করেন ওই উপদেষ্টা।
গত বছর পর্যন্ত মিয়ানমারের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণকারী প্রভাবশালী সেনা জেনারেলদের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে স্পষ্টভাষায় কথা বলতেন ১২ বছরের রাজনৈতিক বন্দি সু চি। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিনি নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গ হয় এড়িয়ে গেছেন অথবা সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকাণ্ডে জোর সমর্থন দিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই উপদেষ্টার মতে, ‘সু চি রাখাইনের ভয়াবহ দুর্ভোগের কথা স্বীকার করেছেন এবং বাস্তবসম্মত সমাধান চান তিনি।’
‘তিনি এমন কোনো ভাষা ব্যবহার না করেই এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন; যা সঙ্কটকে আরো খারাপ করে তুলতে পারে।’ ওই উপদেষ্টা বলেন, ‘বিপজ্জনক পরিস্থিতির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন সু চি; যাতে বেসামরিক সরকার জড়িয়ে পড়েছে। এতে এমন কিছু ঘটছে; যা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি।’
বৃহস্পতিবার রাতে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সু চি রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে তিনি বেশ কয়েকটি প্রস্তাবনা তুলে ধরেছেন। ‘সঙ্কট সমাধানে যা করা দরকার তা সঠিক, ভয়হীন এবং কার্যকরভাবে করা উচিত। অভিযোগ এবং সমালোচনার জবাবে আমরা বিশ্বকে আমাদের নেয়া পদক্ষেপ এবং কাজ দেখাবো।
পুনরায় তিনি অঙ্গীকার করে বলেন, ‘শরণার্থীদের বার্মায় ফেরার অনুমতি দেয়া হবে। তাদেরকে মানবিক ত্রাণ সহায়তাসহ পুনর্বাসন করা হবে এবং দরিদ্র ওই অঞ্চলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে।’
নতুন এই পদক্ষেপ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধানের জন্য একটি নতুন সংস্থা গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন সু চি। রাখাইনের মানবিক সহায়তা, পুনর্বাসন এবং উন্নয়নের লক্ষ্যে গঠিত এই ইউনিয়নে মিয়ানমার সরকার, বিভিন্ন এনজিও এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক এনজিও ও বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা অন্তর্ভূক্ত হবেন।
গত মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকেন মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা সু চি। এর পরে তিনি এবং তার মন্ত্রীরা বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। রোহিঙ্গা ট্র্যাজিতে সু চি আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে অধিবেশনে না গিয়ে একজন উপদেষ্টাকে পাঠিয়ে দেন। এই কাজের ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সু চির যে বীরত্বপূর্ণ ভাবমূর্তি ছিল তাতে কিছুটা ছেদ ফেলেছে।
সেনা নিপীড়নের জেরে নয় রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের তাণ্ডবে রোহিঙ্গারা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন বলে সেনাবাহিনী যে দাবি করেছে সেব্যাপারে সু চির অবস্থান এখনো পরিষ্কার নয়। ২৫ আগস্ট রাখাইনের রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) ছোট পরিসরের হামলা চালায় পুলিশের ওপর। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আরসার হামলার জবাবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী নৃশংস উপায়ে যে হামলা চালাচ্ছে তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
তবে সরকারিভাবে সেনাবাহিনীর অভিযানের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে সু চি নেতৃত্বাধীন দেশটির ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। শান্তিতে নোবেলজয়ী এই নেত্রীর উপদেষ্টা বলেন, ‘প্রকৃত তথ্য পাওয়া সু চির জন্য সহজ নয়। কিন্তু মানুষ বিষয়গুলো তার সামনে নিয়ে আসছে এবং এতে তিনি শঙ্কিত।’
বার্মা ক্যাম্পেইন ইউকে’র কর্মকর্তা মার্ক ফার্মানার বলেন, ‘সু চি সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। কিন্তু তিনি এটা অস্বীকার করতে পারবেন না যে সেখানে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হচ্ছে না। তিনি কাজের মাধ্যমে নিজেকে তুলে ধরতে চান কিন্তু এসব কাজ মিথ্যায় পরিপূর্ণ এবং অস্বীকারের গণ্ডিতে আবদ্ধ।’
সূত্র : দ্য টাইমস।
পাঠকের মতামত