উখিয়া নিউজ ডেস্ক::
মিয়ানমারে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে স্থানান্তরের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও চাওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে পাঠিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা ঘোষণার পর দেশি – এমনকি বিদেশিদেরও – কৌতুহল ঠেঙ্গারচর কোথায় এবং সেখানে বসবাস কতটা বাস্তবসম্মত, সে বিষয়ে জানার।
সরেজমিনে হাতিয়ার ঠেঙ্গারচর এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে বোঝা গেল প্রশাসন এবং স্থানীয়দের মধ্যে চরের নাম এবং কোথায় রোহিঙ্গাদের পাঠানো হবে সেটি নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। ঠেঙ্গারচরের নামে স্থানীয়রা একাধিক চরকে চিহ্নিত করার কারণে বিভ্রান্তি দেখা যায়। ঠেঙ্গারচর বলতে অনেকেই জালিয়ার চরকে বোঝাচ্ছেন এবং পরিদর্শনে গেলে সেখানেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
বিবিসির পক্ষ থেকে ঠেঙ্গারচরে যাবার জন্য হাতিয়া থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকা ভাড়া করা হয়। নৌযানে চড়ে আড়াই ঘণ্টা পর তীরের দেখা পাই।
ঐ চরে দেখা যায় নৌযান ভিড়তে পল্টুন বাধা রয়েছে। হেলিপ্যাড তৈরি চলছে। স্বশস্ত্র পাহারায় আছে নৌসেনারা। রোহিঙ্গা স্থানান্তরের সরকারি ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব এ চর এলাকা ঘুরে গেছেন।
হাতিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান রোহিংগা স্থানান্তরের ঘোষণার পর এ চরে কাজ শুরু হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ইউএনও-সহ সবাই মনে করছে এ চরেই রোহিঙ্গাদের পাঠানো হবে।
কিন্তু বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসনের কাছে এ চরটির নাম জালিয়ার চর। জেলা প্রশাসন বলছে যেখানে রোহিঙ্গাদের জায়গা দেয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়েছে সেটি ঠেঙ্গারচর। স্থানীয়রা জালিয়ার চরকে বোঝালেও সরকার নির্ধারিত ঠেঙ্গারচরটি আরো দক্ষিণ-পশ্চিমে।
জেলা প্রশাসন জানাচ্ছে রোহিঙ্গারা যাতে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে না পারে সেজন্য ঠেঙ্গারচরের ৫শ’ একর জমি বরাদ্দের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
নোয়াখালী জেলা প্রশাসক বদরে মুনির ফেরদৌস জানান, “জায়গাটি হাতিয়া থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং সন্দীপ থেকেও ২০ কিলোমিটার দূরে হবে। এটি একটি নির্জন চর। যে চরটির জমির পরিমান আনুমানিক প্রায় দশ হাজার একর। এটি লম্বায় প্রায় আট কিলোমিটার আর চওড়া প্রায় ৫ কিলোমিটার। সেখানে পুনর্বাসনের বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য ৫শ একর জমির আমরা প্রস্তাব করেছি।”
বন বিভাগের কাছে জানতে চাইলে তারাও ঠেঙ্গারচর বলতে অভিন্ন জায়গা দেখান এবং জেলা প্রশাসনের প্রস্তাবিত জায়গা নিয়েই লিখিত প্রতিবেদন পাঠানোর কথা জানান।
গুগল মানচিত্রে ঠেঙ্গারচরটি এখনো দৃশ্যমান হয়নি। কিন্তু বন বিভাগের ২০১৩ সালের সরকারি মানচিত্রে ঠেঙ্গারচর এবং জালিয়ার চর আলাদাভাবে নামকরণ করা ও অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ অনুযায়ী নির্ধারণ করা আছে।
ঠেঙ্গারচরে সরকারি উদ্যোগে এখনও কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি। চরের মাটিও নরম। বন বিভাগ এবং স্থানীয়রা জানান বর্ষা এবং বড় জোয়ারে ঠেঙারচরের দুই-তৃতীয়াংশ পানিতে ডুবে যায়। ২০১০-১১ সাল থেকে ঠেঙ্গারচরে গাছ লাগানো শুরু করে বন বিভাগ। ২০১৩ সালে এ চরকে সংরক্ষিত বনাঞ্চলও ঘোষণা করা হয়।
এরই মধ্যে ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গা সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনায় উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে নিউইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
বন বিভাগ তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে প্রাকৃতিকভাবে ঠেঙ্গারচরে জনবসতি গড়ে তোলা কঠিন হবে।
নোয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, “এখানে যেকোনো ইঞ্জিনিয়ারিং স্ট্রাকচার করে ঐ চরের উপযোগী করে হয়তো জনবসতি স্থানান্তর সম্ভব হবে। কিন্তু তার আগে অবশ্যই আপনাকে ফিজিবিলিটি স্টাডি করতে হবে যে, এখানে কী ধরনের জীববৈচিত্র আছে, এখানে মাটির কন্ডিশন কেমন, এখানে কী কী চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে থাকবে – সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে এখানে যে কোনো জনবসতি স্থানান্তরের চিন্তা করতে হবে”।
এ ব্যাপারে জেলা নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক জানাচ্ছেন, কোনো চরই প্রাকৃতিকভাবে মানুষের জন্য বসবাসযোগ্য হয় না। সেখানে বেড়ীবাধ করতে হবে, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, সাইক্লোন শেল্টার নির্মান, নিরাপত্তা জোরদার করা বাঞ্ছনীয়।
জেলা প্রশাসক জানান, ঠেঙ্গারচরে ৫শ’ একর জায়গায় এক মাসের মধ্যেই বেড়ীবাধ দেয়া সম্ভব হবে। বাকী জায়গায় রোহিঙ্গার চাষাবাদ করতে পারবে, মাছ ধরেও জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে। মন্ত্রণালয়ের অবগতির জন্য ঠেঙ্গারচরের অবস্থান ও সার্বিক বিষয় নিয়ে জেলা প্রশাসন ও বন বিভাগের যৌথ প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়েছে।
এদিকে ঠেঙ্গারচরের নতুন নাম দেয়ার কথাও জানান নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক বদরে মুনির ফেরদৌস। তিনি জানান, ঠেঙ্গার চরের অফিসিয়াল নাম হচ্ছে ‘চর মুনির’। চরের নতুন নামকরনের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে এখন গেজেট প্রকাশের অপেক্ষায় আছে।বিবিসি বাংলা,
পাঠকের মতামত