এ কে এম জাকারিয়া::
সমাজে আমরা নানা পেশায় কাজ করি। এর কিছু নির্দিষ্ট দায়দায়িত্ব থাকে। অনেকেই এখন আর এসব খুব
বিবেচনায় নেন না। দায়িত্ব বা দায়িত্ববোধ—এসব এখন অনেকটাই দুর্লভ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আর সংবেদনশীলতার আশা তো বড় দুরাশা। হাইওয়ে পুলিশের এক কনস্টেবল পারভেজ মিয়ার দায়িত্বশীলতা ও সংবেদনশীলতা তাই আমাদের চমকে দেয়।
শুক্রবার সকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দাউদকান্দির গৌরীপুরে জনা পঞ্চাশেক যাত্রী নিয়ে একটি বাস খাদে পড়ে যায়। পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুয়ায়ী, এ সময়ে সেখানে সড়কে দায়িত্ব পালন করছিলেন দাউদকান্দি হাইওয়ের থানার কনস্টেবল পারভেজ মিয়া। বাসটি পড়ে ছিল ময়লা ও আবর্জনায় ভরা একটি পচা ডোবায়। পারভেজ মিয়া কোনো কিছুর অপেক্ষা না করে পোশাক পরা অবস্থাতে ওই ডোবায় নেমে পড়েন। বাসের ভেতরে আটকে পড়া যাত্রীদের বাঁচাতে তিনি গাড়ির জানালার কাচগুলো ভেঙে দেন। এতে অনেক যাত্রী বের হয়ে আসতে সক্ষম হন। পরে নিজেই গাড়ির ভেতরে ঢুকে বের করে আনেন আটকে পড়া সাত মাসের এক শিশুকে। উদ্ধার করেন গাড়ির ভেতর আটকে পড়া পাঁচ নারীসহ ১০ থেকে ১২ জন যাত্রীকে।
পুলিশ কনস্টেবল পারভেজ নিজে যখন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তখন স্থানীয় জনগণও তাঁকে সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছিল। অনেকে আহত হলেও এ দুর্ঘটনায় কেউ মারা যাননি। দুর্ঘটনার কবলে পড়ে উদ্ধার হয়েছেন, এমন যাত্রীদের কেউ কেউ বলেছেন, কনস্টেবল পারভেজ যা করেছেন, তা না করলে বিপদ ছিল। কনস্টেবল পারভেজ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন। হাইওয়ে পুলিশের একজন কনস্টেবল হিসেবে দায়িত্ববোধের বাইরেও আমরা তাঁর সংবেদনশীল মনের আঁচ পাই।
প্রখর সংবেদনশীলতা ছাড়া কেউ তাৎক্ষণিকভাবে এ ধরনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন না। পুলিশের এই দায়িত্বশীলতার প্রতি আমাদের সালাম। কনস্টেবল পারভেজ মিয়ার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা!
একই সময়ে আবার পুলিশ নিয়ে কিছু গুরুতর দুঃসংবাদও পড়তে হলো। এগুলোর মধ্যে আছে ঢাকার শান্তিনগরে অর্থ না পেয়ে ইয়াবা মামলায় সাংবাদিককে ফাঁসানোর অভিযোগ, তেজগাঁওয়ে স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে এক পুলিশ কনস্টেবলকে গ্রেপ্তারের ঘটনা ও বরিশালে ইয়াবাসহ পুলিশ কনস্টেবল আটকের ঘটনা।
ইয়াবা মামলায় আটক আছেন দ্য অবজারভারের ফটোসাংবাদিক আশিক মোহান্মদ। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, আটক করে টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে ইয়াবা রাখার মামলা সাজিয়েছে। এ ধরনের অভিযোগ পুলিশ বরাবরই অস্বীকার করে।
আশিক মোহান্মদের পরিবারের অভিযোগও পুলিশ যথারীতি অস্বীকার করেছে।
অভিযোগ অভিযোগই। একটি বিশ্বাসযোগ্য ও যথাযথ তদন্ত ছাড়া এটা বলা কঠিন যে কোন পক্ষ সত্যি কথা বলছে। আশিক মোহান্মদের পরিবার, নাকি পুলিশ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনার পর তার বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত ও ফলাফলের নজির খুব কমই আছে। আশিক মোহান্মদের পরিবার যে অভিযোগ করেছে, পুলিশের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ অনেক পুরোনো। কিছু কিছু প্রমাণও বিভিন্ন সময়ে মিলেছে। ফলে পুলিশ যে এ ধরনের ঘটনা ঘটায়, সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনো কারণ নেই।
পুলিশের মতো একটি বড় বাহিনীতে নানা ধরনের ও মানসিকতার লোক থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সেখানে কেউ কেউ দুর্নীতি ও অপকর্ম করবে বা করার চেষ্টা করবে, তা-ও স্বাভাবিক। এটা মোকাবিলার পথ হচ্ছে শৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে সদস্যদের বিরুদ্ধে যেকোনো অভিযোগকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া, যথাযথ তদন্ত করা এবং কেউ কোনো ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়লে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। বাহিনী হিসেবে পুলিশকে যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে, তার অপব্যবহার নাগরিকের জন্য যে চরম ভীতিকর ও হয়রানিমূলক হতে পারে, তা মাঝেমধ্যে আমরা টের পাই।
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা সাধারণভাবে খুবই হতাশার। পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে প্রায় সব ক্ষেত্রেই পুলিশ প্রশাসন যে অবস্থানটি নেয়, তা হচ্ছে অস্বীকারের নীতি। পুলিশের কেউ অপকর্ম করেছে, এটা স্বীকার করে নেওয়া হলে বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে—এমন মানসিকতাই সম্ভবত এ ক্ষেত্রে কাজ করে। কিন্তু এই মানসিকতা খুবই বিপজ্জনক এবং এটা বরং পুলিশের ভাবমূর্তিকে আরও খারাপের দিকেই নিচ্ছে।
কনস্টেবল পারভেজ মিয়ার মতো লোকজন পুলিশকে উঁচুতে নিয়ে যায়, আর টাকা আদায়ে ইয়াবা মামলা সাজানোর অভিযোগ পুলিশকে নিচে নামায়। বাহিনী হিসেবে পুলিশের ভাবমূর্তি ধরে রাখার সহজ পথ হচ্ছে, পারভেজ মিয়ার মতো সদস্যদের আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কৃত ও সম্মানিত করা। আর কোনো পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তাঁকে রক্ষা ও অস্বীকারের নীতি থেকে সরে আসা। অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত ও প্রমাণিত হলে শাস্তি নিশ্চিত করা। ভালো কাজের জন্য পুরস্কার ও অপরাধের জন্য শাস্তি—এটাই পুলিশের ভাবমূর্তি ধরে রাখার আসল পথ। সুত্র: পূর্বপশ্চিম বিডি
পাঠকের মতামত