নাইপেদো: গত ৯ অক্টোবর থেকে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অভিযান শুরু করে মায়ানমারের সেনাবাহিনী। সেখানে রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনায় বিভিন্ন দেশ এবং মানবাধিকার সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে।
চলতে থাকা এমন অমানবিক সহিংসতা থেকে জীবন রক্ষা করতে হাজার হাজার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম প্রতিবেশি দেশে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।
এ পরিস্থিতিতে রাখাইনে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে সম্মতির কথা জানিয়েছেন মিয়ানমারে মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াঙ্গি লি।
রবিবার ইয়াঙ্গির বরাত দিয়ে টাইম ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে রাখাইনে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ সংঘটনের কথা তুলে ধরা হয়।
তিনি বলেন, ‘আমি দেশেটির ভেতরের এবং আশেপাশের দেশগুলো থেকে বিভিন্ন প্রতিবেদন পেয়েছি, যাতে বুঝা যায় মিয়ানমার সরকার পরিস্থিতি সম্পর্কে যে দাবি করছে তা ঠিক নয়। আমরা প্রচুর নৃশংস ও পীড়াদায়ক ছবি ও ভিডিও দেখেছি।’
জাতিসংঘের একটি হিসাবে, সেনা নির্যাতনের মুখে প্রাণ বাঁচাতে ইতিমধ্যে ২২ হাজার রোহিঙ্গা নদী পার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে।
আসিয়ানের সদস্য হিসেবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মুসলিম দেশ মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায় ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক মায়ানমার সরকারের অবস্থানের কড়া সমালোচনা করেছেন।
আর ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেটনো মার্সুদি গত ৬ ডিসেম্বর মায়ানমারের রাজধানী নাইপেদোতে গিয়ে সু চির সঙ্গে দেখা করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার সরকারের কড়া অবস্থানের কথা জানিয়ে এসেছেন।
এছাড়া এ সপ্তাহের শেষ দিকে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে আসিয়ানের জ্যেষ্ঠ নেতারা মিলিত হতে যাচ্ছেন। মূলত ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ অনির্ধারিত বৈঠকের পরিকল্পনা করেছে।
সেখানে আসিয়ানের সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিরা বিশ্বায়নের ফলে পরিবর্তিত জলবায়ু এবং এ ক্ষেত্রে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নীতি এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিষয়ে আলোচনা হবে।
এ আলোচনার আগেই সু চি রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারের অবস্থান তুলে ধরতে আসিয়ানের নেতাদের তার দেশে যাওয়ার আহ্বান জানালেন।
গত অক্টোবরের শুরুর দিকে রাখাইনের তিনটি সীমান্ত চৌকিতে হামলায় নয়জন পুলিশ সদস্য নিহত হন। এ ঘটনার জন্য ইসলামপন্থীরা দায়ী দাবি করে রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো অবরোধ করে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ নামে অভিযান চালাচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী।
যেখানে অভিযান চলছে, সেখানে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের প্রবেশ করতে দিচ্ছে না সরকারি বাহিনী।
কিন্তু আক্রান্ত এলাকায় মিয়ানমারের সেনারা ব্যাপকহারে ধর্ষণ, বিচারবহির্ভূত হত্যা, রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে দেয়ায় রাখাইনে বসবাসকারী ১০ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ক্রমেই ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। তবে সেনারা এসব অপরাধের অভিযোগ অস্বীকার করছে।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী অপবাদ দিয়ে তাদের নাগরিকত্বের অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে দেশটিতে রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে কোণঠাসা হয়ে আছে।
২০১২ সালে রাখাইনের বৌদ্ধদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয়ে এক লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছিল।
গত নভেম্বরের শুরুতে মিয়ানমার সরকারের তত্ত্বাবধানে কয়েকজন বিদেশী কূটনীতিক এবং জাতিসংঘ কর্মকর্তা রাখাইনের আক্রান্ত এলাকায় যেতে সক্ষম হন। তবে এতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন লি।
তিনি বলেন, ‘এটি ছিল একটি গাইড-ট্যুর, এমনকি সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর কড়া উপস্থিতি ছিল। এর মধ্যেও লোকজন প্রতিনিধি দলের কাছে এসে কথা বলার চেষ্ঠা করেছিল। আমরা শুনেছি পরে এ কারণে তারা প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিল এবং তাদের পাকড়াও করা হয়েছিল।’
গত দু’মাস ধরে আরাকানে শিশুসহ হাজার হাজার রোহিঙ্গা খাদ্যসহ নানা মানবিক সহায়তার অভাবে ভুগছেন। গত ৯ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সসহ ১৪টি দেশের কূটনৈতিক মিশন এসব অসহায় মানুষকে সহায়তা দিতে ত্রাণসংস্থাগুলোকে ‘সম্পূর্ণ এবং অবাধ প্রবেশাধিকার’ দিতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।