জমির নামজারির ক্ষেত্রে ডিজিটাইজেশনের কথা বলা হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ভূমি মন্ত্রণালয় ঘটা করে ঘোষণা দিচ্ছে সেবাগ্রহীতাদের দুর্ভোগ কমাতে সব ক্ষেত্রে ডিজিটাইজেশন বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু জমি ও ফ্ল্যাটের নামজারির ক্ষেত্রে পদে পদে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন গ্রাহকরা।
নামজারির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র স্ক্যান করে অনলাইনে জমা দেওয়ার পরও সেগুলোর হার্ড কপি এসিল্যান্ড অফিসে দিতে হয়। আবেদন গ্রহণ করার পর এসিল্যান্ড অফিস থেকে শুনানির দিন ধার্য করা হয়। এ ব্যাপারে মোবাইলে এসএমএস পাঠানো হলেও কার কখন শুনানি হবে, তা উল্লেখ করা হয় না। সেবাপ্রত্যাশীরা সকাল থেকে সারাদিন বসে থাকার পরও অনেককে ওই দিন শুনানির জন্য ডাকা হয় না। কাউকে কাউকে পুনরায় আবেদন করতে বলা হয়। আবার এসব বিষয়ে অনলাইনে সঠিক তথ্য মেলে না।
অভিযোগ উঠছে ধাপে ধাপে হয়রানির ফাঁদ পেতে রাখা হচ্ছে ঘুষ আদায়ের জন্য। সরেজমিনও মিলেছে এর প্রমাণ।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, রাজধানীর এসিল্যান্ড অফিসে নামজারির আবেদনের জন্য গেলেই দেখা মেলে সুযোগসন্ধানী লোকদের। নানা ঝামেলার কথা শুনিয়ে এক পর্যায়ে চাওয়া হয় ঘুষ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সেবাপ্রত্যাশী সমকালকে বলেন, তিনি জমির নামজারির জন্য ধানমন্ডির এসিল্যান্ড অফিসে যাওয়ার পর ফ্রন্ট ডেস্কের সহকারী পরিচয় দেওয়া আবদুল মতিন কথা বলার এক পর্যায়ে ২০ হাজার টাকা চান। টাকা দিলে পুরো কাজটিই করে দেবেন বলে জানানো হয়। তবে সামর্থ্য না থাকায় তিনি এত টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি কাগজপত্র জমা দিয়েছেন অনেক দিন হলো, কিন্তু কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না।
সূত্র জানায়, নামজারির আবেদন ফি ৭০ টাকা। আবেদনটি গ্রহণ করা হলে ডিসিআর ফি বাবদ ১ হাজার ১০০ টাকা জমা দিতে হয়। এর বাইরে আর অর্থ খরচের বিষয় নেই। কিন্তু প্রতিটি এসিল্যান্ড অফিসে নানা কৌশলে আদায় করা হয় বড় অঙ্কের অর্থ।
নামজারির জন্য অনলাইনে আবেদন করার সময় স্ক্যান করে আবেদনকারীর ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্র, ক্রয়-সংক্রান্ত দলিল, বায়া দলিল, সিটি পর্চা, আগের নামজারি সনদ, আরএস পর্চা, এসএ পর্চাসহ বিভিন্ন কাগজপত্র দিতে হয়। এসিল্যান্ড অফিসেও ওইসব কাগজপত্র জমা দিতে হয়।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার এলাকার বাসিন্দা মো. ইদ্রিস তাঁর ফ্ল্যাট নামজারির জন্য পাঁচ-ছয় মাস আগে ধানমন্ডি এসিল্যান্ড অফিসে অনলাইনে আবেদন করেছিলেন। তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানির জন্য ডাকা হয়েছিল। শুনানিকালে তাদের ফ্ল্যাট-সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্র প্রদর্শন করা হয়। এরপর গ্রাহকের মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে আবেদনটি ভুল/ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে নামঞ্জুর হিসেবে গণ্য করা হয়। এরপর আবার আবেদন করার পরামর্শ দেওয়া হয়। মো. ইদ্রিস আবার ভোগান্তির শিকার হবেন আশঙ্কায় আর আবেদন করেননি। তিনি সব ধরনের রেকর্ডপত্র স্ক্যান করে অনলাইনে আবেদন করার পর ওইসব কাগজপত্রের কার্ডকপির সেট নিয়ে শুনানিকালে হাজির হয়েছিলেন। তাঁর আবেদনটি গ্রহণ করা হলে অনলাইনে সব রেকর্ডপত্র পাওয়ার পরও হার্ডকপির ওই সেট রেখে দেওয়া হয়। ইদ্রিসের মোবাইলে পাঠানো মেসেজে বলা হয়, আবেদনকারীর মালিকানা-সংক্রান্ত মূল কাগজপত্র/রেকর্ডপত্র যাচাই করা সম্ভব হয়নি। এর জন্য আবেদনটি ভুল/ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে বাতিল করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভূমি কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, আবেদনকারী অর্থ খরচ করে কাগজপত্র স্ক্যান করে অনলাইনে জমা দেন। এই প্রক্রিয়াটি ডিজিটাইজেশনের মধ্যে পড়ে। এরপর একই কাগজপত্রের হার্ডকপির সেট জমা দিতে হয়। সফট কপি জমা দেওয়ার পর হার্ডকপি জমা দেওয়া হলে সেটি ডিজিটাইজেশনের মধ্যে পড়ে না। অথচ মন্ত্রণালয় ভূমির সব ক্ষেত্রে ডিজিটাইজেশন বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলে ঘোষণা দিচ্ছে।
সরেজমিন জানা গেছে, অনলাইনে আবেদন গ্রহণ করার পর এসিল্যান্ড অফিস থেকে শুনানির দিন ধার্য করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সেবাপ্রত্যাশী সমকালকে বলেন, শুনানির দিন ধার্য করে মোবাইলে এসএমএস পাঠানো হলেও সময় উল্লেখ করা হয় না। সেবাপ্রত্যাশীরা যথাসময়ে এসিল্যান্ড অফিসে যান। তারা সকাল থেকে সারাদিন বসে থাকার পরও শুনানির জন্য ডাকা হয় না। এর মধ্যে কেউ কেউ একটা সময়ে হয়তো চলে যান। যাদের শুনানি গ্রহণ করা হয়, তাদের অধিকাংশের আবেদন ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে বাতিল করে মোবাইলে মেসেজ পাঠনো হয়। কারও ক্ষেত্রে সরকারি স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটার কথা বলা হয়। শুনানির দিন হাজির হননি বলেও উল্লেখ করা হয়। কাউকে কাউকে আবার নামজারির আবেদন করতে বলা হয়। সব মিলিয়ে সেবাপ্রত্যাশীরা চরম ভোগান্তির মুখোমুখি হন। শুনানির দিনে কর্মকর্তাদের সুবিধাজনক সময় অনুযায়ী দেখা না করলে প্যাঁচ ধরা হয়। নামজারির আবেদন নামঞ্জুর করা হয়। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, শুনানির দিনে কাগজপত্র নিয়ে হাজির হননি। দুই সেট কাগজ আগেই জমা দেওয়া থাকলেও এমন বক্তব্যে হতাশ হন অনেকে। দেখা গেছে, ১০ থেকে ২০ জনকে ডাকা হলে সবাই সকাল সাড়ে ৮টায় হাজির হয়ে বসে থাকেন। কাকে কখন ডাকা হবে, কেউ জানেন না।
জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি হয়রানি হতে হয় সেবাপ্রত্যাশীদের জমির দাগের অন্য জমি অধিগ্রহণ করা হলে। এ ক্ষেত্রে জমির নামজারি ব্যক্তির নামে হলেও ফ্ল্যাট তৈরির পর মালিক ফ্ল্যাটটির নামজারি করতে গেলে বলা হয়, ওই জমি অধিগ্রহণের মধ্যে পড়েছে। এক দাগে জমি থাকে কয়েক একর। ওই দাগের অধিগ্রহণ করা জমির অংশ বাদ দিয়ে ব্যক্তির জমি ঠিক থাকলেও ফ্ল্যাটের নামজারি করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। নামজারির ক্ষেত্রে ভূমি অধিগ্রহণের রিপোর্টটি সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস থেকে এসিল্যান্ড অফিসে পাঠানো হয়। পরে এসিল্যান্ড অফিস ভূমি অফিসের রিপোর্টের ভিত্তিতে নামজারির আবেদন বাতিল করে দেয়। ওই দাগে কতটুকু জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, কতটুকু অধিগ্রহণ করা হয়নি– ভূমি অফিস থেকে সেই তথ্য অনুযায়ী রিপোর্ট পাঠানো হয় না।
সূত্র জানায়, ভূমি মন্ত্রণালয় ডিজিটাইজেশনের নামে কিছু রোবট দিয়ে কথা বলাচ্ছে। তথ্য চাইলে বলা হয়, আপনার নামজারির আবেদন এই ‘পজিশনে’ আছে। অর্থাৎ একটি সিস্টেম তৈরি করে রাখা হয়েছে। এতে বিভ্রান্ত হন সেবাপ্রত্যাশীরা।
ডিজিটাইজেশনে আরেক সংকট
ডিজিটাইজেশনের অসামঞ্জস্যপূর্ণ কার্যক্রমের জন্য খোদ ভূমি মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব বিভাগের নিরীক্ষকরা মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম নিরীক্ষা করতে পারছেন না। প্রয়োজনীয় নথিপত্র দেখার জন্য অনলাইনে এক্সেস না দেওয়ার কারণে নিরীক্ষা করা যাচ্ছে না। অনেক সময় নিরীক্ষকদের ঘোরানোর পর এক্সেস পাওয়ার দেওয়া হলেও অনলাইনে ঢুকে প্রয়োজনীয় নথি দেখা যায় না। কোনো ব্যক্তি ভূমির খাজনা দিলে এই হিসাব প্রথমে ওঠে ভূমি অফিসের তিন নম্বর আমদানি রেজিস্টারে। তিন নম্বর রেজিস্টার থেকে তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয় ক্যাশ-সংক্রান্ত চার নম্বর রেজিস্টারে। এই ক্যাশ রেজিস্টার থেকে আদায় করা অর্থ চালানের মাধ্যমে জমা দেওয়া হয় ট্রেজারিতে। খাজনা দেওয়ার পদ্ধতিতে ডিজিটাইজেশনের ঘোষণা দেওয়া হলেও এখনও আগের পদ্ধতিতেই কর আদায় করা হচ্ছে। এখন অনলাইনে খাজনা দেওয়ার পর তা তিন নম্বর রেজিস্টারে জমা হয়। তিন নম্বর থেকে যায় চার নম্বর রেজিস্টারে। চার নম্বর রেজিস্টার থেকে জমা হয় ট্রেজারিতে।
আগে দেখা যেত, তহসিলদার যখন খাজনা আদায় করতেন, তিন নম্বর রেজিস্টারে দাখিলা নম্বর দিয়ে ৫০০ টাকা আদায় করা হলেও অনেক ক্ষেত্রে চার নম্বর রেজিস্টারে লেখার সময় ৫০ টাকা উল্লেখ করা হতো। ডিজিটাইজেশন হওয়ার কারণে নিরীক্ষকরা তিন নম্বর রেজিস্টার দেখার পর চার নম্বর রেজিস্টার দেখতে পারেন না। চার নম্বর রেজিস্টার দেখার এক্সেস পাওয়ার নিরীক্ষকদের দেওয়া হচ্ছে না। কখনও দেওয়া হলেও সব ধরনের তথ্য ব্লক করে রাখা হয়। নাম প্রকশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, ভূমি মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাইজশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ভূমি অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বলেছেন, ‘আমরা বললেও তোমরা চার নম্বর রেজিস্টার দেখার এক্সেস দেবে না।’
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ওই সংকটের কারণে বর্তমানে নিরীক্ষকরা নিরীক্ষা করতে পারছেন না। অনলাইন হওয়ার পর নিরীক্ষা বিভাগকে ক্ষমতা না দেওয়ার কারণে ভূমির অনেক হিসাব-নিকাশ নিরীক্ষা করা যাচ্ছে না।
ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনে বলেছিলেন, অনলাইনে ভূমির সেবা দেওয়া হচ্ছে তাতে হয়রানি বাড়ল কিনা, এটা খতিয়ে দেখা হবে। সম্প্রতি তিনি সমকালকে বলেন, পুরো ডিজিটাইজেশন না হওয়া পর্যন্ত সমস্যা থেকে যাচ্ছে। হার্ড কপি ছাড়া নামজারি করা যায় কিনা, সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। নামজারির শুনানির জন্য এসিল্যান্ড অফিসের মোবাইল মেসেজে কার কোন সময় শুনানি হবে, তা উল্লেখ করতে হবে। গ্রাহক এসিল্যান্ড অফিসে এসে হাজিরা দিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় বসবেন। তাদের বসার জন্য সুনির্দিষ্ট জায়গা থাকতে হবে। পরে তাদের উল্লিখিত সময় অনুযায়ী ডেকে শুনানি নিতে হবে।
অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ভোগান্তি প্রসঙ্গে ভূমিমন্ত্রী বলেন, এ ক্ষেত্রে মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এমন অনেক কিছুই আছে, সেগুলোর তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ ধরনের জমির যতটুকু অধিগ্রহণ হবে, সেটুকু খাস খতিয়ানে চলে যাবে। বাকি জমির রেকর্ড কারেকশন করাই থাকে। এসব ক্ষেত্রে নামজারি না করা বা খাজনা না নেওয়ার কোনো কারণ নেই। এ ধরনের অভিযোগ ভূমি মন্ত্রণালয়ের হটলাইন বা অন্য কোনো মাধ্যমে দেওয়া হলে মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা বা ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তাকে শোকজ করা হবে। সুত্র: সমকাল