হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠিয়ে অনলাইনে পার্টটাইম (খণ্ডকালীন) চাকরির টোপ দিচ্ছে একটি প্রতারকচক্র। তাদের লোভনীয় টোপে অনেকেই পা দিচ্ছেন। দৈনিক এক থেকে দুই হাজার টাকা বেতনের প্রলোভন দিয়ে পরবর্তীতে উচ্চ লাভে অনলাইন ব্যবসার ফাঁদে ফেলে উলটো লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি।
যোগাযোগমাধ্যম হিসাবে তারা এনক্রিপটেড অ্যাপস টেলিগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই টাকা খুইয়ে বসছেন ভুক্তভোগী। চক্রের ফাঁদে পা দিচ্ছেন উচ্চশিক্ষিত বিভিন্ন পেশার মানুষ ও বেকাররা। তবে ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই এ নিয়ে মামলা করছেন না। যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শরণাপন্ন হন তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে কয়েকজন গ্রেফতার হলেও হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সাইবার ইউনিটের কর্মকর্তারা বলেন, পার্টটাইম চাকরির লোভ দেখিয়ে টাকা আত্মসাতের পুরো বিষয়টি দেশের বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। যে অ্যাপসের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে সেগুলো বেশিরভাগই সিঙ্গাপুর থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলাদেশে বেতনভুক্ত কর্মচারী রেখে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে টাকা তুলে নিচ্ছে চক্রটি।
ভুক্তভোগীদের একজন রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা সোহেলী সুলতানা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে এখন চাকরিপ্রত্যাশী। সম্প্রতি প্রতারকচক্রের খপ্পরে পড়ে মাত্র দুই দিনেই খুইয়েছেন ৭০ হাজার টাকা। এ কারণে ১ ফেব্রুয়ারি ডিএমপির কাফরুল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন তিনি।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বুধবার সোহেলী সুলতানা যুগান্তরকে বলেন, হোয়াটসঅ্যাপে অপরিচিত একটি নম্বর থেকে পার্টটাইম চাকরির মেসেজ আসে। মেসেজে তারা জানায়, অনলাইনে একটি গ্রুপওয়াইজ কাজ করতে হবে, প্রোডাক্ট কেনাবেচা করতে হবে, বিনিময়ে প্রতিদিন এক থেকে দুই হাজার টাকা করে লাভ হবে।
তিনি বলেন, ‘আমি চাকরিপ্রত্যাশী। চেষ্টা করেও কাঙ্ক্ষিত চাকরি হচ্ছে না। ভেবেছিলাম এভাবে যদি কিছু টাকা আয় করা যায়। এজন্য তাদের দেওয়া লিংকে অ্যাকাউন্ট খুললে পরবর্তী সময়ে বলে, তাদের ওয়েবসাইট থেকে জিনিসপত্র কেনাবেচা যত করতে পারব তার ওপর তত বেশি লাভ হবে। অ্যামাজান ও দারাজের মতন তাদের একটি ওয়েবসাইট ছিল। যেখানে আমি টাকা দিয়ে জিনিস কিনতে পারছিলাম। এসব জিনিসের টাকা বিকাশে পরিশোধ করেছি। একে একে প্রায় ৭০ হাজার টাকার বেশি জিনিস কিনেছিলাম। ওইসব জিনিস আবার বিক্রি করে দিলে আমাকে কোনোটাতে ৭% আবার কোনোটাতে ২৫% পর্যন্ত কমিশন দিচ্ছিল। আমি জিনিসপত্র বিক্রির পর ওরা দেখাত আমার বিকাশে মেসেজ আসছে টাকা যোগ হয়েছে। আর ওদের যে ওয়েবসাইটে আমার সোহেলী সুলতানা নামের একটা অ্যাকাউন্ট ছিল সেখানে দেখাত আমার কত টাকা জমা হয়েছে, লাভ কত হয়েছে, মোট কত টাকা আছে। কিন্তু সেই টাকা তুলতে গেলে বলে, আরও ইনভেস্ট করলেই টাকা ফেরত দেবে। তখন বুঝতে পেরেছি সবটাই ভাঁওতাবাজি।’
সোহেলী আরও বলেন, ‘আমি স্টুডেন্ট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে দুই বছর ধরে টিউশনি করে ঢাকায় আছি। খুব কষ্টে টাকাগুলো জমিয়েছিলাম বিপদের দিনে খরচের জন্য।’
আরেক ভুক্তভোগী চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক শিক্ষার্থী মো. আবু সাঈদ। তিনি জানান, ১৬ নভেম্বর তার ফোনের হোয়াটসঅ্যাপে পার্টটাইম চাকরির মেসেজ আসে। যোগাযোগ করার জন্য একটি হোয়াাটসঅ্যাপ নম্বর দেওয়া হয়। তাদের কথামতো এমাজনআরএফজে অ্যাপ ডাউনলোড ও ইনস্টল করেন। পরে অ্যাপটিতে অ্যাকাউন্ট নিবন্ধন করেন তিনি। ওই অ্যাকাউন্ট থেকে জিনিসপত্র অর্ডার করলে বড় অঙ্কের কমিশন দেবে বলে জানায়। প্রথমে ২০০ টাকার মালামাল অর্ডার করলে আবু সাঈদের অ্যাকাউন্টে ৩৯৯ টাকা রিটার্ন দেয়। এভাবে মাত্র দুই দিনেই ধাপে ধাপে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৭৯.৮৩ টাকা বিনিয়োগ করেন তিনি এবং কমিশনসহ মোট ৭ লাখ ৬১ হাজার ৮১২ টাকা পাবেন বলে জানায় চক্রটি।
আবু সাঈদ বলেন, ‘অ্যাকাউন্টের টাকা তুলতে চাইলে তারা আমাকে ২০% অর্থাৎ ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা ট্যাক্স হিসাবে দিতে বলে। আমি বলেছিলাম, আমার অ্যাকাউন্ট থেকে কেটে নিতে। কিন্তু তারা অগ্রিম টাকা দিতে বলে। আমি টাকা না দেওয়ায় তারা আমাকে কোনো টাকা দিচ্ছে না।’
সম্প্রতি প্রতারকচক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ। তাদের মধ্যে একজন চীনা নাগরিকও রয়েছেন।
ডিবি জানিয়েছে, চক্রটি পার্টটাইম চাকরি, অ্যাপসে লোন দেওয়ার কথা বলে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তারা টাকা নিতে মোবাইল ফাইন্যান্স সার্ভিস ব্যবহার করে। তাদের থেকে বিপুল পরিমাণ ভুয়া রেজিস্টার্ড সিমকার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। এসব টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে। চক্রটির হোতারা দেশের বাইরে থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের পক্ষে বাংলাদেশে যারা কাজ করছে তারা মূলত বেতনভুক্ত কর্মচারী। তারা মাসে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা বেতন পেয়ে থাকে।
ডিবির ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের ইনচার্জ অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) আশরাফউল্লাহ জানান, হতদরিদ্র ও কম আয়ের সাধারণ মানুষকে প্রলোভিত করে অর্থের বিনিময়ে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে বিভিন্ন কোম্পানির সিম রেজিস্ট্রেশন করছে চক্রটি। সিমগুলো দখলে নেওয়ার পর তারা আবার রেজিস্ট্রেশনকৃত ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে মোবাইল ব্যাংকিং সিস্টেম বিকাশ, নগদ ও রকেটের অ্যাকাউন্ট খুলে সেটিও তাদের দখলে নিয়ে নেয়। ওই সিমকার্ড ব্যবহার করেই তারা হোয়াটসঅ্যাপ লিংকসহ মেসেজ পাঠায়।