দেশে জুয়া খেলা নিষিদ্ধ। কিন্তু গ্রাম এবং শহরে সমান তালে চলছে জুয়ার কর্মকাণ্ড। ক্রিকেট খেলার সর্বশেষ ফলাফল কিংবা এক ওভারে কত রান বা কয়টা চার/ছয় হবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে টাকার বিনিময়ে ধরা হয় বাজি। জুয়ার পুরো কর্মকাণ্ড চলে অনলাইনে। এটি জুয়ার আধুনিক সংস্করণ। মফস্বলের রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে শহরে ক্লাব, অভিজাত এলাকা, এমনকি নিজেদের ঘরের ভেতরেও একা অথবা কয়েকজন মিলে জুয়ার আসর বসছে। লোভে পড়ে এতে নিঃস হচ্ছেন অনেকে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে বিপিএল, সিপিএল, আইপিএলের মতো জাতীয় পর্যায়ের ক্রিকেট খেলাকে নিয়ে ধরা হয় বাজি। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি অনলাইন জুয়ার কর্মকাণ্ড বেড়েছে। জুয়া পরিচালনা কিংবা জুয়া খেলা দুটোই করা হয় স্মার্টফোনের মাধ্যমে। প্রযুক্তির উন্নতির কারণে অনলাইন জুয়ার টাকা লেনদেন করা হয় মোবাইল ব্যাংকিংয়ে। জুয়ার কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় বিভিন্ন ধরনের মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে। ওয়ান এক্স বেট, বেট ৩৬৫, বোভাডা, এক্সবেটসহ বেশ কয়েকটিতে অ্যাপসে অনলাইন জুয়া খেলা পরিচালিত হয় বেশি। বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে দেখা গেছে জনপ্রিয় আইপিএল খেলোয়াড়দের মুখ লাগিয়ে ভিডিও সম্পাদনা করা সেই ভিডিও প্রচার কওে অনলাইন জুয়া খেলায় উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
শরীয়তপুরের বাবুরচরে বাসিন্দা ফয়সাল হোসেন। সেখানকার স্থানীয় বাজারে রয়েছে তার একটি কাপড়ের দোকান। দোকানের আয়ের উপর নির্ভর করে তার সংসার। বৃদ্ধ বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তান নিয়ে তার সংসার। দোকানের আয়ে বেশ ভালোভাবেই চলছিল সংসারের যোগান। ফয়সালের কাপড়ের দোকানে টিভি থাকায় আইপিএল বিপিএল খেলা হলে রাতে জমে উঠত খেলা দেখার আসর। সেই খেলা দেখায় অংশ নিত স্থানীয় দোকান ব্যবসায়ীরা স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েরাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
একদিন ফয়সালের নজরে এলো ফারুক আর অনিক এক ওভারে কত রান হবে তা নিয়ে বাজি ধরছেন। আর মাত্র দশ মিনিটেই তারা পাল্টাপাল্টি আয় করছেন হাজার হাজার টাকা। ফয়সাল ওদেরকে জিজ্ঞেস করলেন- এই তোমরা এতো টাকা কই পাও। তারা তখন জানালেন বড় ভাই আপনি দিনে বড়জোর আয় করেন পাঁচ হাজার টাকা। কিন্তু আমরা দিনে আয় করি লাখ টাকা। বিশ্বাস না করলে খেলে দেখেন। ফয়সাল তখন দেখলেন অনিকের এই অনলাইন জুয়ার আয় করা টাকা দিয়ে অনিক মোটর সাইকেল কিনেছেন। বাড়িতে চৌচালা ঘর উঠিয়েছেন।
ফয়সাল ভাবলেন, যদি আমিও ওদের মতো টাকা কামাইতে পারি তাহলে তো আমি আরো বড় করে দোকান দিতে পারবো। পরে ফয়সাল তাদের সহযোগিতায় একটি মোবাইল অ্যাপসে লগইন করে তার দোকানে বসেই আয় করেছেন ১৭ লাখ টাকা। পরে মার্কেটে কেনেন আরেকটি বড় দোকান। এখন আর ফয়সাল অনিকদের সঙ্গে অনলাইনে জুয়া খেলেন না। এখন তিনি জুয়া খেলেন বড় বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। কিন্তু হঠাৎ শোনা যায় ফয়সাল তার এলাকায় নাই।
অনলাইনে জুয়া শুরুর বেশ কিছুদিন পর তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসেন কয়েকজন ব্যক্তি। তারা ফয়সালের কাছে ২০ লাখ টাকা পাবেন বলে দাবি করেন। পরে ফয়সালের বাবা ফয়সালকে ফোন করলে ফয়সাল জবাবে বলেন আমার থেকে তারা টাকা পাওয়ার বিষয় সঠিক। ফয়সালের বাবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। উপায় না দেখে বাজারের দুটো দোকান বিক্রি করে দিয়েছেন ফয়সালের বাবা। পরে তাদের দেনা শোধ করতে বিক্রি করে ফয়সালের দাদার আমলে রেখে যাওয়া জমিজমা। নিঃস্ব হয়ে ফয়সালের বাবা-মা এখন থাকেন সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘শিগগিরই অনলাইনে জুয়ার অ্যাপস শতভাগ বন্ধ করা হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবৈধ প্রোপাগান্ডা ছড়ানো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের জন্য ভয়ঙ্কও ক্ষতিকর। যেকোনো মূল্যে তা বন্ধ করতে সংশ্লিষ্টদের দিয়ে কঠোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
অনলাইন জুয়া বন্ধে তৎপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। তবে জুয়ায় অংশগ্রহণের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় কর্মকর্তারাও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। সিআইডির প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মিয়া ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান অব্যাহত রেখেছি। তবে একটি বন্ধ করলে সঙ্গে সঙ্গে আরও ১০টি জুয়ার সাইট খুলে যায়। কিছু গণমাধ্যম জুয়ার বিজ্ঞাপনও প্রচার করে। অনলাইন জুয়া বন্ধ করতে গণমাধ্যম, পুলিশ, মোবাইল ব্যাংকিং অপারেটর সবার একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তাহলে এ ধরনের সাইবার অপরাধ বন্ধ করা সহজ হবে।’
জুয়ার অ্যাপসগুলোর বিজ্ঞাপনে দেশের কয়েকটি ব্যাংক এবং মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পেমেন্টের সুযোগ থাকার টোপ দিয়ে তরুণদের আকৃষ্ট করা হচ্ছে। জুয়ার বিভিন্ন কোম্পানি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবে অবাধে তাদের বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। ফলে অনলাইন জুয়া শহরের পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছে।
দেশে প্রকাশ্য জুয়া আইন-১৮৬৭-এর ধারা ও প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। কিছু দুর্বলতার কারণে বর্তমানে এর প্রয়োগ বেশ কঠিন। ওই আইনে ক্যাসিনো শব্দটি নেই। অনলাইন জুয়ার প্রতিরোধের জন্য সময়োপযোগী আইন তৈরি করা এখন সময়ের দাবি বলেও জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
আইনগতভাবে জুয়া নিষিদ্ধ হলেও জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা মানা হচ্ছে না। বিশেষ করে বিভিন্ন দেশের ক্রিকেট-ফুটবল লিগের খেলা টিভি চ্যানেলে খেলা দেখানোর সময় জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার হয়।
সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা বিষয়ক জাতীয় কমিটির সদস্য প্রকৌশলী মো. মুশফিকুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘অ্যাপগুলো ব্যবহার করার সময় একটু খেয়াল রাখতে হবে যেসব ওয়েবলিংক আসে সেগুলো অ্যাপের মাধ্যমে আসে কিনা। জুয়া ছাড়াও টাকা পয়সা আত্মসাতের লিংক থাকে। তাতে ক্লিক করলে অনেকের মোবাইল বা কম্পিউটারে থাকা বিভিন্ন মোবাইল নাম্বার, ব্যাক্তিগত ছবি, ভিডিওসহ নানা তথ্যাদি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে প্রতারক চক্র। যারাই অনলাইন জুয়ায় ঝুঁকছে তারা বেশিরভাগই নিঃস্ব হয়ে গেছে। এ নিয়ে বেড়েছে অপরাধ।
প্রকৌশলী মুশফিক বলেন, আগে দেখা যেতো খেলা ঘিরে লটারির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের পুরষ্কার দেওয়া হতো। আর এখন এসব অ্যাপে জুয়া খেলতে গিয়ে কোনো কিছু পাওয়া তো দূরের কথা বরং জুয়ায় টাকা হেরে চাঁদাবাজি, ছিনতাই এমনকি সন্ত্রাসের মতো বড় বড় অপরাধের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। আর এতে সমাজে অপরাধের প্রবনতা ক্রমেই বাড়ছে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ডিআইজি (অর্গানাইজড ক্রাইম) কুসুম দেওয়ান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘অনলাইন জুয়া খেলার অ্যাপস সংক্রান্ত নানা অভিযোগ আমাদের কাছে আসছে, আমরা কাজ করছি। এগুলো তো আমরা ইচ্ছা করলেই বন্ধ করতে পারবো না। ভিপিএনের মাধ্যমে অনেকেই এটা ডাউনলোড করে অনলাইনে জুয়া খেলে। তবুও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের তৎপরতায় বেশ কিছু অ্যাপস বন্ধও হয়েছে। আমরা এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
সিআইডির এই কর্মকর্তা জানান, জুয়ার ২০০ সাইট, অ্যাপ, ইউটিউব ও ফেসবুক লিংকের তথ্য পেয়েছেন তারা। প্রতিটির বিষয়ে আলাদা তদন্ত হচ্ছে। এসবের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।