অনিয়মের অভিযোগে বাংলাদেশে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) সব ধরনের আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন কাস্টমস বিভাগ।
গত ২১ জুন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস সংস্থাটির বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর বা বিন বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সঙ্গে দেশের সব কাস্টমস হাউসকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানায়।
ওই চিঠির একটি অনুলিপি বেনারের হাতে এসেছে।
উল্লেখ্য, বিন হলো নির্দিষ্ট একটি নম্বর, যা আমদানি-রপ্তানি করার ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের উপকমিশনার মো. আব্দুল হান্নান স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে ইউএনএইচসিআরের কাছ থেকে ৭৬ কোটি টাকা আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের আমদানিকৃত পণ্য বন্দর থেকে খালাস না করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, “৭৬ কোটি দুই লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে আদায় না হওয়া পর্যন্ত এবং এ দপ্তরের (চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের) ছাড়পত্র ছাড়া আমদানিকারক কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ অব বাংলাদেশ ইউএনএইচসিআরের বিন বন্ধ করাসহ ওই প্রতিষ্ঠান বা তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের বন্দরের পণ্য খালাস বন্ধ রাখা ও সেবা সরবরাহ স্থগিত রাখার অনুরোধ করা হলো।”
সংস্থাটির ৪৬টি আমদানিকৃত গাড়ি হস্তান্তরে অনিয়মের অভিযোগে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বেনারকে বলেন, “এই সিদ্ধান্তের কারণে যদি সংস্থাটির আমদানি ব্যাহত হয়, তাহলে তারা রোহিঙ্গাদের জন্য কাজ করবে কীভাবে? যেহেতু তারা বৃহত্তর, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বার্থে কাজ করছে, সে জন্য ছোটখাটো ভুল না ধরে এর হৃদ্যতাপূর্ণ সমাধান হওয়া উচিত।”
২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১০ লাখের ওপরে। এসব শরণার্থীকে যেসব আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা সহায়তা করছে, তার মধ্যে অন্যতম ইউএনএইচসিআর।
বাংলাদেশে যেসব বিদেশি উন্নয়ন সংস্থা কাজ করে তারা এনবিআরের আদেশ অনুযায়ী গাড়িসহ বিভিন্ন পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি ও তা ব্যবহার করতে পারে। এসব পণ্য অন্য কেউ ব্যবহার করতে চাইলে যথাযথ শুল্ককর পরিশোধ করতে হয় এবং কাস্টমস বিভাগের পূর্ব অনুমতি নিতে হয়।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে আমদানিকৃত গাড়ির শুল্ককর পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি, যা গাড়ির প্রকার ভেদে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৮০০ শতাংশেরও বেশি।
‘ইউএনএইচসিআর নিয়মের ব্যত্যয় করেছে’
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের উপকমিশনার মো. বদরুজ্জামান মুন্সি সংস্থাটির আমদানি বন্ধ করা তথা বিন বন্ধ করার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বেনারকে বলেন, “ইউএনএইচসিআর নিয়মের ব্যত্যয় করেছে। এ জন্য তাদের কাছে আমদানিকৃত গাড়ির বিপরীতে শুল্ককর দিতে বলা হয়েছে।”
এ বিষয়ে জানতে ইউএনএইচসিআরের স্থানীয় মুখপাত্র মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। এ সংক্রান্ত মেইল পাঠানো হলেও এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাঁর জবাব পাওয়া যায়নি।
স্থানীয় দ্য ফিন্যানসিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকায় সংস্থাটির বরাত দিয়ে বলা হয়, “ইউএনএইচসিআর সরকারের কোনো নিয়ম লঙ্ঘন করেনি। ইউএনএইচসিআর এই বিষয়টি সমাধান করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।”
বিন বন্ধ সংক্রান্ত চিঠির তথ্য অনুসারে, ইউএনএইচসিআরের শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত ৪৬টি গাড়ি এনবিআরের অনুমতি ছাড়াই সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক ব্যবহৃত হচ্ছে।
এসব গাড়ির প্রায় সবগুলোই ২০১৮ সালে আমদানিকৃত। এ তালিকায় রয়েছে ল্যান্ড ক্রুজার, ট্রাক, হাইয়েস ও পিকআপ ভ্যান।
কাস্টমস হাউসের চিঠিতে বলা হয়, “৪৬টি গাড়ি নিজেদের অফিসিয়াল কাজে ব্যবহারের জন্য আমদানি করা হলেও এনবিআরের নিয়ম ভঙ্গ করে তা শুল্কমুক্ত সুবিধায় হস্তান্তর করা হয়েছে। এরপর শুল্ককরসহ সব মিলিয়ে সংস্থাটিকে ৭৬ কোটি দুই লাখ টাকা পরিশোধের জন্য তিন দফায় তাগাদা ও চূড়ান্ত তাগিদপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু দাবিনামার কোনো টাকা পরিশোধ করা হয়নি।”
এনবিআরের ২০০০ সালের এ সংক্রান্ত একটি আদেশে বলা হয়েছে, “কূটনৈতিক মিশন, কূটনীতিক, অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত সংস্থা ও ব্যক্তি এ ধরনের পণ্য কেবল শুল্কমুক্ত সুবিধায় বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারবে অন্য কোনো একই ধরনের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে।”
বদরুজ্জামান মুন্সি বলেন, “শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত গাড়ি অন্য দপ্তরকে হস্তান্তর করলে শুল্ককর পরিশোধের বিধান রয়েছে। কিন্তু তারা এই নিয়ম মানেনি কিংবা এনবিআরকেও জানায়নি। এ জন্য তাদের ওপর প্রথমে ২৫ কোটি টাকা শুল্ককর দাবিনামা জারি করা হয়। তাদের এ বিষয়ে শুনানিতে ডাকা হলেও আসেননি। এরপর বিচার আদেশ করে ৫০ কোটি টাকা জরিমানা ও সুদসহ ৭৬ কোটি টাকা পরিশোধের জন্য বলা হয়েছে।”
সংস্থাটি কী পরিমাণ আমদানি করে কিংবা কী ধরনের পণ্য আমদানি করে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেনি চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস।
‘দ্রুত শান্তিপূর্ণ সমাধান করা উচিত’
একটি আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থার প্রতি সরকারের এমন সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছেন ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, “তারা তো গাড়ি বিক্রি করে দেয়নি। হয়তো অন্য কোনো সংস্থা ব্যবহার করছে। দেখতে হবে বৃহত্তর বা জাতীয় স্বার্থে ব্যবহার করছে কি না।”
তারা (ইউএনএইচসিআর) যেহেতু বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কাজ করছে, সে জন্য তাদের কিছু ছোটখাটো ভুল হলেও তা ধরা উচিত নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তারা ত্রাণ এনে দিচ্ছে, খাওয়াচ্ছে, আবার ট্যাক্সও দেবে!”
“এখন তারা যদি আমদানি করতে না পারে, তাহলেও তো সরকারকেই রোহিঙ্গাদের খাওয়াতে হবে,” বলেন তিনি।
এই টাকা সরকার পাবে না এবং সম্পর্ক খারাপ হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “দ্রুত এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করা উচিত।”
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. এম মাশরুর রিয়াজ বেনাকে বলেন, “ইউএনএইচসিআরের নিয়মনীতি মানা উচিত ছিল। এনবিআর তার আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে; স্বাভাবিক।”
“তবে এসব গাড়ির ক্ষেত্রে যদি বড়ো ধরনের ভুল না হয়ে থাকে, এনবিআরের এই বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তিতে এগিয়ে আসা উচিত। বিশেষত, বিন লক করা খুবই কঠিন সিদ্ধান্ত,” যোগ করেন তিনি। সুত্র: বেনারনিউজ