স্রষ্টার সুনিপুণ হাতে গড়া প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যঘেরা অপার সম্ভাবনার দ্বীপ ‘সোনাদিয়া’। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণ সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারের দ্বীপাঞ্চলীয় জনপদ মহেশখালীর কুতুবজোম ইউনিয়নের একটি দ্বীপ এটি। প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিনের মতো এ দ্বীপটি সমুদ্রের বুকে অবস্থিত। তবে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের মতো এখানে তেমন জনবসতি এখনো গড়ে ওঠেনি। এর পরও চারদিকে সাগর আর মাঝখানে চিরহরিৎ ঝাউ-কেউড়ার বনে ঘেরা সোনাদিয়া দেখলে মন জুড়িয়ে যায়।
উপকূলের এ দ্বীপে ১ হাজার ২১৫ প্রজাতির বৈচিত্র্যময় জীব রয়েছে। এর মধ্যে উদ্ভিদ ৫৬৭টি, শামুক ১৬২টি, কাঁকড়া ২১টি, চিংড়ি ১৯টি, লবস্টার দুটি, মাছ ২০৭টি, উভচর ১২টি, সরীসৃপ ১৯টি ও পাখির প্রজাতি রয়েছে ২০৬টি। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিনষ্টের কারণে এসব জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে রয়েছে এবং তা ক্রমে বিলুপ্ত হতে চলেছে। এ ছাড়া চামচঠুঁটো কাদাখোঁচা (স্যান্ডপাইপার) পাখির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শীতকালে সোনাদিয়া দ্বীপে দেখা যায়। ৪ হাজার ৯২৮ হেক্টর জমির ওপর পূর্ব-পশ্চিম লম্বালম্বি বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালার মধ্যে সৃষ্টিকর্তার সুনিপুণ সৃষ্টি শৈল্পিক আদলে গড়া সোনাদিয়ার অবস্থান। সোনাদিয়ায় ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির পাশাপাশি শুঁটকি মহাল, চিংড়ি চাষ ছাড়াও রয়েছে প্রাকৃতিক বনায়ন ও বালুময় চরাঞ্চল। এখানে রয়েছে বিশেষ ধরনের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত প্যারাবন এবং দূষণ ও কোলাহলমুক্ত সৈকত। লাল কাঁকড়া, বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিম, দ্বীপবাসীর নিজস্ব সংস্কৃতি, হজরত মারহা আউলিয়ার মাজার ও তার আদি ইতিহাস, সাগরে জেলেদের মাছধরার দৃশ্য, সূর্যাস্তের দৃশ্য, প্যারাবন-বেষ্টিত আঁকাবাঁকা নদীপথে নৌকা ভ্রমণ ও স্পিডবোট দিয়ে মহেশখালী চ্যানেল হয়ে সাগরের মাঝপথে বঙ্গোপসাগরের দৃশ্য অবলোকন পর্যটকদের জন্য অনন্য আকর্ষণ। সোনাদিয়ার অদূরে নিঝুম দ্বীপও চামচঠুঁটো কাদাখোঁচাদের আবাসস্থল। বিলুপ্তপ্রায় এ প্রজাতিকে রক্ষার জন্যই বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল সোনাদিয়াকে পাখির অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে। বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনালের ঘোষণায় বলা হয়, সোনাদিয়া দ্বীপ বাংলাদেশে পাখির ২০তম গুরুত্বপূর্ণ অভয়ারণ্য। প্রতিষ্ঠানটির মতে, চামচঠুঁটো পাখি বিলুপ্তপ্রায়। সারা বিশ্বে এ প্রজাতির মোট পাখির ১০ শতাংশ সোনাদিয়ায় রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সাম্প্রতিক এক জরিপে এ তথ্য উঠে আসে। ২০১২ সালের ভোটার তালিকা অনুযায়ী সোনাদিয়ার ভোটার সংখ্যা ৩৮৪ জন। অধিবাসীরা মূলত প্রধান পেশা হিসেবে মাছ শিকারে জড়িত। কিছু পরিবার চিংড়ি ও লবণ উত্পাদন করে জীবিকা নির্বাহ করে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও খুব পরিশ্রমী। সোনাদিয়া দ্বীপ সরকার ঘোষিত পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুযায়ী এ দ্বীপে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এমন কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ। এখানে প্রচলিত ট্যুরিজমের অনেক ধরনের ইতিবাচক দিক রয়েছে। তাই এ দ্বীপে পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটাতে ইকোট্যুরিজম অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। দ্বীপবাসীর সম্পৃক্ততায় এখানে কমিউনিটি-ভিত্তিক ইকোট্যুরিজমের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এটি দ্বীপবাসীর বিকল্প আয়ের ব্যবস্থাসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। সোনাদিয়া দ্বীপের নামকরণের সঠিক কোনো ঐতিহাসিক তথ্য নেই। তবে আদিকাল থেকে এখানে সোনাতুল্য দামি পণ্য মত্স্য সম্পদ আহরিত হতো বলে এটিকে সোনার দ্বীপ তথা সোনাদিয়া বলা হয়ে থাকে। দ্বীপটি সোনাদিয়া নামে বর্তমান বই-পুস্তকে স্থান পাচ্ছে। তবে এমন জনশ্রুতিও আছে, একসময় চট্টগ্রামের বাঁশখালী থেকে জেলে সম্প্রদায়ের কিছু লোক অস্থায়ীভাবে সোনাদিয়ায় মাছ শিকারে আসেন। দৈবক্রমে একজন জেলে একটি শিলাখণ্ড দেখতে পান, যা তার কাছে খুবই আর্কষণীয় ও মূল্যবান মনে হয়। এ কারণে তিনি এটিকে বাড়িতে নিয়ে যান এবং দরজার সামনে পা ধোয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন। কিছুদিন পর জেলেটি ওই শিলাখণ্ডে দা শান দিতে গেলে বুঝতে পারেন, আসলে একটি স্বর্ণখণ্ড। এ ঘটনার কারণে দ্বীপের নাম সোনাদিয়া হয়েছে বলেও শতবর্ষীদের মুখে শোনা যায়। তথ্যমতে, প্রাচীনকালে মানুষের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিল নদীপথ। আর মানুষের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম মাধ্যম ছিল মাছ শিকার। উভয় কারণে সোনাদিয়ার সঙ্গে মানুষের পরিচয় ঘটে অনেক আগেই।
স্থানীয়দের মতে, যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সরকারি বা বেসরকারি যথাযথ পদক্ষেপ না থাকায় এখানে গড়ে ওঠেনি দৃষ্টিনন্দন পর্যটন কেন্দ্র। সংশ্লিষ্টদের মতে, সঠিক পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন করা গেলে এ দ্বীপ পর্যটন বাণিজ্যের বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি দ্বীপবাসীর বিকল্প আয়ের ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে। বর্তমানে এ দ্বীপের জনসংখ্যা ৮১০। এখানকার মোট জমির পরিমাণ ২ হাজার ৯৬৫ দশমিক ৩৫ একর। এর মধ্য থেকে ১ হাজার ৪৭ দশমিক ৮৪ একর জমির ওপর সংরক্ষিত পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় সরকার। এ নিয়ে ২০১২ সালের ১৩ নভেম্বর একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়। কিন্তু সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়নি। এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, সরকারের পরিকল্পনামতে, প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে মিলিয়ে সোনাদিয়া দ্বীপে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ইকো-রিসোর্ট গড়ে তোলা হবে। তবে এমন একটা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে কিছুটা সময় তো লাগবেই। কারণ কাজ বাস্তবায়নের আগে সরকারকে অর্থায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে মিলিয়ে সোনাদিয়া দ্বীপ ঘিরে পরিবেশবান্ধব পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় পর্যটন মন্ত্রণালয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ৬ জানুয়ারি সোনাদিয়া দ্বীপ পরিদর্শন করেন পর্যটন সচিব খোরশেদ আলম চৌধুরী। পরিদর্শন শেষে কক্সবাজার বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির বৈঠকে সোনাদিয়া দ্বীপের কোনো জমি কাউকে লিজ না দিতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন তিনি। একই সঙ্গে নতুনভাবে বসতি করার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করতে এবং দ্বীপে বসবাসকারীদের অন্যত্র পুনর্বাসনের বিষয়েও একটি রূপরেখা তৈরি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া নিরাপত্তার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এরপর কিছুদিন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের তত্পরতা দেখা গেলেও বর্তমানে তা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো রূপরেখাও তৈরি হয়নি।