বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অবস্থান আরও স্পষ্ক রেছে যুক্তরাষ্ট্র। ভারত আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বললেও সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক ভোটের তাগিদ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে শর্তমুক্ত সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যারা গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ভিসা নীতি প্রয়োগের হুঁশিয়ারিও দিয়েছে দেশটি।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে (জাপা) যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর চিঠিতে এসব কথা বলা হয়েছে। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস এ চিঠি পৌঁছে দিচ্ছে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপিসহ বিরোধী দলের ধারাবাহিক হরতাল-অবরোধ চললেও এ সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করতে পারে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের চিঠিকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
গত শুক্রবার দিল্লিতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের ‘টু প্লাস টু’ বৈঠক হয়। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারত নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে এ বৈঠকে। ওয়াশিংটন বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করলেও দিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংবাদ সম্মেলনে খোলাখুলি জানায়, উন্নয়ন ও নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এর মাধ্যমে ভারত আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার বার্তা দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষ্য, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বরাবরই যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতকে একই অবস্থানে দেখা যায়। তবে এবার বড় দুই শক্তির অবস্থানে ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। চীনের সঙ্গে প্রবল বিরোধ থাকলেও বেইজিংয়ের মতো দিল্লিও আওয়ামী লীগকে সমর্থন করছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তারা একই ভূমিকায় ছিল। আগের দুই নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের তেমন তৎপরতা না থাকলেও এবার পরাশক্তি দেশটি ব্যাপক সক্রিয়। ২০২১ সালে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর গত মে মাসে ভিসা নীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বরে ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ শুরুর কথা জানায় দেশটি। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায় থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, মার্কিন তৎপরতা বিএনপির প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট।
ডোনাল্ড লুর চিঠিতে নতুন কিছু না থাকলেও একে যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক বার্তা হিসেবে দেখছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির। তপশিলের আগে এই চিঠির তাৎপর্য কী– এ প্রশ্নে তিনি সমকালকে বলেন, তপশিল হয়ে গেলে নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। এর আগে চিঠি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো শেষ চেষ্টা করল।
দিল্লির ‘টু প্লাস টু’ বৈঠকের তিন দিনের মাথায় চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান স্পষ্ট হলো কিনা– এ প্রশ্নে হুমায়ুন কবির বলেন, ভারত ও মার্কিনিদের নিজস্ব নীতি রয়েছে। এটা স্পষ্ট, বাংলাদেশ বিষয়ে তাদের সহমত হয়নি। সে কারণেই হয়তো যুক্তরাষ্ট্র চিঠি দিয়ে আনুষ্ঠানিক বার্তা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া গতকাল রাতে সমকালকে বলেন, এখন পর্যন্ত চিঠি পায়নি আওয়ামী লীগ।
ডোনাল্ড লুর চিঠি পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা কারাগারে এবং গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে থাকায় বিএনপির কাছে কীভাবে চিঠি পৌঁছিয়েছে মার্কিন দূতাবাস– তা জানাননি তিনি। চিঠির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি বিএনপি। নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে নামা দলটির নেতারা জানিয়েছেন, ডোনাল্ড লুর চিঠি বিএনপির পক্ষে গেছে। ভারত আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রকাশ্যে দাঁড়িয়েছে। এমন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্পষ্ট অবস্থান নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে সহায়ক হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
আওয়ামী লীগ সূত্র জানিয়েছে, চিঠি পৌঁছে দিতে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছিল মার্কিন দূতাবাস। ওবায়দুল কাদের গতকাল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে খুলনায় থাকায় তাঁকে চিঠি দেওয়া যায়নি।
নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় আলাদাভাবে সমাবেশ ডেকেছিল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও সমমনা দলগুলো। সহিংসতায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হয়। এর পর থেকে মামলা ও গ্রেপ্তারে দলটি আরও বেশি চাপে পড়ে। সহিংসতার কারণে বিএনপির সঙ্গে সংলাপে সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে গত ৩১ অক্টোবর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে দেখা করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের আহ্বান জানান ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস।
ডোনাল্ড লুর চিঠিতে একই তাগিদ আসায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান সমকালকে বলেন, কার সঙ্গে সংলাপ হবে! বিএনপির সঙ্গে সংলাপে আপত্তি রয়েছে আওয়ামী লীগের। বিএনপি সরকারের পতন চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন চায়। তারা যদি এ বক্তব্য প্রত্যাহার করে প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ করে, তাহলে সংলাপের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে আওয়ামী লীগ।
সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রের তাগিদের বিষয়ে আবদুর রহমান বলেন, অবাধ নির্বাচন আওয়ামী লীগ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অঙ্গীকার। গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ভিসা নীতি প্রয়োগের হুঁশিয়ারি প্রসঙ্গে আবদুর রহমান বলেন, যারা শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে, তাদের বিরুদ্ধে ভিসা নীতি প্রয়োগ হলে স্বাগত জানাই।
আওয়ামী লীগও নির্বাচনকে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় আখ্যা দিয়ে বিদেশিদের তৎপরতার বিরোধিতা করছে। আবদুর রহমান বলেন, গণতান্ত্রিক ধারা সমুন্নত রাখতে বন্ধু দেশ ও উন্নয়ন সহযোগীরা তাদের আশাবাদ জানাতেই পারে। তবে হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়।
গতকাল সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে চিঠি পৌঁছে দেন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। তিনি বিকেল ৩টার দিকে জাপা চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়ে যান। সেখানে জি এম কাদেরের সঙ্গে ৪০ মিনিট বৈঠক করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ ও চেয়ারম্যানের বিশেষ দূত মশরুর মওলা।
ডোনাল্ড লুর চিঠিতে কী বলা হয়েছে– এ প্রশ্নে মুজিবুল হক চুন্নু সমকালকে বলেন, তিনটি বিষয় এসেছে। সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় যুক্তরাষ্ট্র। রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে বসতে আহ্বান জানিয়েছে। অবাধ নির্বাচনে বাধা তৈরিকারীদের বিরুদ্ধে ভিসা নীতি প্রয়োগ করার কথা বলা হয়েছে।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, পিটার হাস নিজে থেকে কিছু বলেননি। আগের বৈঠকগুলোর মতো জাপার অবস্থান জানতে প্রশ্নও করেননি। বরং ডোনাল লুর চিঠির ভাষ্য তুলে ধরেছেন। জাপার এক নেতা সমকালকে বলেন, মার্কিন চিঠি মানেই বিশেষ বার্তা। যুক্তরাষ্ট্র এতদিন মৌখিকভাবে বলে এসেছে, এখন তারা আনুষ্ঠানিকতার পর্যায়ে প্রবেশ করল। নিজেদের চাওয়া পূরণ করতে প্রভাবের ব্যবহার করতে পারে।
বৈঠকের পর মুজিবুল হক চুন্নু সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচনে জাপার ভূমিকা কী হবে– প্রশ্নে দলটির মহাসচিব বলেন, ‘আমরা কী চাই যুক্তরাষ্ট্রকে বলিনি। নির্বাচন আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু করতে ইসিকে বলব। সরকারকে বলব সহযোগিতা করতে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে মঙ্গলবার জাপার কেন্দ্রীয় কমিটি এবং পরদিন প্রেসিডিয়ামের সভায় সিদ্ধান্ত হবে। জাপার নির্বাচনী ইশতেহার এবং প্রার্থী তালিকা প্রায় প্রস্তুত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের উপনির্বাচনে খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে। জাপা অংশ নিয়েছিল নির্বাচনকে প্রতিযোগিতাপূর্ণ করতে। আওয়ামী লীগের সিল মারার দরকার ছিল না। জাতীয় পার্টি এমন পরিবেশ চায়, সেখানে জনগণ ভোট দিতে পারবে। তাহলে নির্বাচনে অংশ নেবে।
এদিকে মার্কিন দূতাবাসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রধান তিন রাজনৈতিক দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের অনুরোধ করেছেন পিটার হাস। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। সব পক্ষকে সহিংসতা পরিহার এবং সংযম দেখানোর আহ্বান জানাচ্ছে। কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে নেই যুক্তরাষ্ট্র।
পাঠকের মতামত