এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার::
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পর দায়েরকৃত মামলায় গ্রেপ্তারকৃত আওয়ামী দোসরদের পক্ষে জামিনে তদবির করছে বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবীরা। এ নিয়ে কক্সবাজার জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে পুলিশ সদর দপ্তরে একটি গোপন প্রতিবেদন দিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সদর দপ্তরের জ্যৈষ্ঠ এক কর্মকর্তা মঙ্গলবার (২৩ অক্টোবর) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশের পাঠানো ওই প্রতিবেদনে বিএনপি-জামায়াতপন্থী কক্সবাজার আদালতে কর্মরত শীর্ষ ৮ জন আইনজীবীর নাম উল্লেখ রয়েছে। এবং দোসরদের পক্ষে বিএনপি-জামায়াতপন্থী আরো ১৫-২০ জন আইনজীবী আসামিদের পক্ষে লড়ছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। পুলিশের এই প্রতিবেদনটি বিএনপির নীতিনির্ধারক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে পৌঁছেছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। তারেক রহমান বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজনকে দায়িত্ব দিয়েছেন বলে ওই সূত্রটি দাবি করেছেন।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের সূত্র মতে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পর সোমবার পর্যন্ত কক্সবাজারে ২২টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্য একটি মামলার বাদি পুলিশ। অন্য মামলার বাদি বিএনপির নেতাকর্মী ও ছাত্রদের পক্ষের লোকজন। ওই ২২টি মামলায় এজাহারনামীয় ৭২৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। এবং সন্দিগ্ধ আসামি ২১৩২ জন। ইতিমধ্যে পুলিশ বিশেষ অভিযান চালিয়ে এজাহারনামীয়সহ অর্ধশতাধিক আসামিকে গ্রেফতার করেছেন। এর মধ্যে অধিকাংশ আসামী বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবীদের লড়াইয়ে মুখে জামিন বেরিয়ে এসেছেন। এমন অভিযোগ উঠেছে, থানা থেকে আদালতের হাজতখানায় না ঢুকার আগেই জামিনমুক্ত হয়েছে। এই নিয়ে বিএনপির তৃনমুল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। অনেকেই বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
আদালতের একটি সূত্র মতে, গত ৫ আগস্ট থেকে আওয়ামী ৫৪ জন দোসরদের গ্রেফতার করেছেন আইনশৃঙ্খলাবাহী। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পর্যন্ত ৩১ জন জামিন পেয়েছে। অধিকাংশই জামিন শুনানিতে অংশ নিয়েছে বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবী। অপর একটি সূত বলছে, বিভিন্ন থানায় দায়েরকৃত এজাহারনামীয় কিছু সংখ্যক আসামিও বিএনপি -জামাতপন্থী আইনজীবীদের সহযোগিতায় কৌশলে জামিন নিয়েছেন গত কয়েকদিনে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা বিএনপির সদস্য ও জ্যৈষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আওয়ামী দোসররা ১৫ বছর জুলুম-লুটপাট করেছে। কিন্তু এখন আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবীরা তাদের জামিন করাচ্ছেন। এটা খুবই দুঃখজনক। আত্মীয়তার দোহাইয়ে যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে ছাত্র-জনতা অসংখ্য আত্মবিসর্জনে অর্জিত দ্বিতীয় স্বাধীনতার আদর্শ ভূলুণ্ঠিত হবে।
তিনি আরো বলেন, ইতিমধ্যে কয়েকজন দাগী আওয়ামী দোসর বিএনপি-জামায়াতের আইনজীবীদের ব্যবহার করে জামিন নিয়েছে। আদালতও জামিনের ক্ষেত্রে হালকা মনোভাব দেখাচ্ছে। সহজেই জামিন দিয়ে দিচ্ছে। আদালত এভাবে সহজে জামিন দিয়ে দিলে বিরোধীতাকারী আইনজীবীদের করার কিছু থাকেনা।
তিনি বলেন, বিচার ব্যবস্থায় এখনো আওয়ামী দোসর ঘাপটি মেরে রয়েছে। বিচারকদের কার্যক্রমে মনে হচ্ছে, আওয়ামী দোসরদের ইশারায় কক্সবাজার আদালত চলছে।
আপনি আইন পেশার পাশাপাশি একজন ত্যাগী বিএনপির নেতা বিষয়টি অভিযোগ আকারে বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দদের অবগত করেছেন কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু-ঈদগাহ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির মৎস্যজীবী বিষয়ক সম্পাদক, রাজনীতিবিদ লুৎফুর রহমান কাজলসহ সংশ্লিষ্ট মহলে অবগত করা হয়েছে।
পুলিশ এজাহারনামীয় আসামি না ধরে যে কাউকে ধরে অজ্ঞাত মামলায় চালান দিচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলেন এ আইনজীবী।
কক্সবাজারে কর্মরত ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি'র) এক কর্মকর্তা বলেন, অপরাধী যে মাপের হউক না কেন? তাকে আইনের আইনের আওতায় আনা আইনশৃঙ্খলাবাহীর জন্য অনেক কঠিন কাজ। আত্নগোপন থাকা একজন অপরাধীকে শনাক্ত করতে অনেক বেগ পেতে হয়। শত চেষ্টার মাধ্যমে গ্রেফতারের পর যদি একজন অপরাধী সহজেই আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে যায়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার মাঝে হতাশা বাড়ে। এতে করে অপরাধী চক্র দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়।
ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পর দায়েরকৃত মামলায় গ্রেফতারকৃত অনেক আসামি সহজেই জামিনে বের হচ্ছে। এতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কাজে আগ্রহ হারাচ্ছে।
তিনি কয়েকটি জামিনের উদ্বৃত্তি বলেন, বিচারক কোন দিকে যাবে। বড় মাপের কয়েকজন বিএনপি -জামায়াতপন্থী আইনজীবী দোসরদের পক্ষে আইনি লড়াইয়ে অংশ নিচ্ছেন। অপরাধরোধে জামিনের ক্ষেত্রে আরো সর্তকতা অবলম্বন করতে পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী, সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'আইন আদালতকে রাজনীতির উর্ধ্বে রাখা দেশ, জাতি ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে একান্ত আবশ্যক। আওয়ামী লীগ আইন আদালতকে নগ্নভাবে দলীয়করণ করে সুপ্রিম কোর্টের, বিচারকদের মানসম্মান, নিরপেক্ষতা শেষ করে দিয়েছে।তার পরিণতি কি হচ্ছে দেখছে সবাই। আদালতের বিচার, আদেশ, রায় আইন অনুযায়ী,কাগজপত্র ও সাক্ষীর ভিত্তিতে হওয়া উচিত, রাজনৈতিক পরিচিতির ভিত্তিতে নয়।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা বলছেন, যেভাবে বিএনপি-জামায়াতের আইনজীবীর স্বৈরাচারের দোসরদের জামিন নিয়ে দিচ্ছে তা অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক ও বিপজ্জনক। এভাবে যদি আন্দোলনে হামলাকারী ও হত্যাকারীরা পার পেয়ে যায় তাহলে আমাদের ভাইদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে। এটা আমরা মেনে নিতে পারি না। আর যদি কোনো হাসিনার দোসরদের জামিন পেতে সহায়তা করা হয় তাহলে আমরা বসে থাকবো না।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক ইউসুফ বদরী বলেন, 'যারা গণ-আন্দোলনে ছাত্র-জনতার উপর হামলা ও হত্যায় জড়িত ছিলো সেসব স্বৈরাচারের দোসরদের জামিনের পক্ষে বিএনপি-জামায়াদপন্থী আইনজীবীদের অত্যন্ত নিন্দনীয়, গর্হিত ও অনভিপ্রেত। এ ব্যাপারে দলের পক্ষ থেকে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দলের হাইকমান্ডকে জানানো হবে।
সূত্র আলোকিত বাংলাদেশ