শুধু বিশ্বজিৎ নন, আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাকর্মী নৃশংস হত্যার শিকার হয়েছেন। গুম করা হয়েছে অনেককে। সে সময় বিএনপি নেতা ইলিয়াছ আলী ও চৌধুরী আলম গুম, নারায়ণগঞ্জে সাত খুন, গাইবান্ধার সাবেক এমপি লিটন হত্যাকাণ্ড ব্যাপক আড়োলন তোলে।
আবার ক্ষমতাসীন দলটির অন্তর্কোন্দলেও একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটেছে। তাদের মধ্যে নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান, রাজধানীতে যুবলীগ নেতা মিল্কী, আওয়ামী লীগ নেতা টিপু, সবশেষ ভারতে এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ড ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে।
পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, আওয়ামী লীগের শাসনামলের ১৫ বছরে (২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত) সারা দেশে কমপক্ষে ৬০ হাজার হত্যার ঘটনা ঘটেছে। সে হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ৪ হাজারের মতো খুন হয়েছে। গুমের পর খুনের শিকার হওয়া, বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা এবং রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে সহিংসতায় হত্যাকাণ্ড এই হিসাবের বাইরে।
সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী শাসনের ১৫ বছরে সারা দেশে গড়ে মাসে ৩২৯ জন খুনের শিকার হয়েছে। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন হত্যার শিকার হয়েছে ১১ জন। রাজনৈতিক বিরোধে হত্যার বাইরেও পারিবারিক বিরোধ, ব্যক্তিগত বিরোধ, ব্যবসায়িক ও আর্থিক বিরোধ, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা ঘটনায় হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
নিহতদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, আইনজীবী, সাংবাদিক, পুলিশসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছে। ধর্মীয় বক্তা, ব্লগার, লেখক, কবিসহ অনেকেই টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছে। আর এসব হত্যার ঘটনায় হওয়া মামলার অধিকাংশই তদন্ত, আসামি গ্রেপ্তার না হওয়া, বিচার ঝুলে থাকার পর্যায়ে রয়ে গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত ১৫ বছর ৮ মাসে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে খুব একটা ভালো ছিল তা মোটেও বলা যাবে না। দীর্ঘ এই সময়কালে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ছিল দৃশ্যমান বাস্তবতা। বিশেষ করে, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গুমের ঘটনা ছিল উদ্বেগজনক। গুমের শিকারদের অধিকাংশকেই নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।
বন্দুকযুদ্ধের নামেও অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যেসব ঘটনায় মামলা পর্যন্ত হয়নি। আবার টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনায় মামলা হলেও খুনিরা গ্রেপ্তার হয়নি। কোনো কোনো ঘটনায় গ্রেপ্তার হলেও খুনিরা জামিনে বেরিয়ে গেছে। হত্যাকাণ্ডের বিচারে দীর্ঘসূত্রতাও দেখা গেছে। চাঞ্চল্যকর অনেক খুনের মামলায় আসামিদের উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে যাওয়ারও নজির দেখা গেছে।
১৫ বছরে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে হত্যা দুই হাজারের বেশি
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারের’ নাটক সাজিয়ে ২ হাজার ব্যক্তিকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালে সরকার পতনের আগ পর্যন্ত কথিত বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে অন্তত ১ হাজার ৯২৬ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হয়েছে। প্রতিটি ঘটনার পর আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে একই ধরনের বক্তব্য দেওয়া হয়েছে।
তবে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সাত বছরে ক্রসফায়ারের তথ্য সংরক্ষণ করেছে। এসবির সাত বছরের হিসাবে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে ১ হাজার ২৯৩ জন।
দেশের এমন কোনো জেলা নেই যেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেনি। হত্যার শিকারদের মধ্যে অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মীও রয়েছেন। তবে ওই সাত বছরে এসবির হিসাবের চেয়ে আসকের হিসাবে ১২০ জন বেশি নিহত হয়েছে। প্রতিটি ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে ক্রসফায়ারের সাজানো বর্ণনা উল্লেখ করে মামলা দেওয়া হয়। তাতে নিহত ব্যক্তির সহযোগী হিসেবে আরও অনেককে আসামি করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর পরিবারগুলো মামলা করার সাহস পেত না।
উল্লেখযোগ্য হত্যাকাণ্ড
২০১২ সালে বিএনপির নেতৃত্বে অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে শিবিরকর্মী ভেবে পুরান ঢাকার দর্জি বিশ্বজিৎ দাসকে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনার সিসি ফুটেজ পর্যালোচনা করে আসামিদের শনাক্ত করে পুলিশ। এ ঘটনায় হত্যা মামলা হয়। ২০১৮ সালে এ মামলায় আটজনকে ফাঁসি ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন সাজা দেন আদালত। কিন্তু সেই রায় আজও বাস্তবায়ন হয়নি। আসামিদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়নি।
২০১৬ সালে অজ্ঞাত অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিজ বাড়িতে খুন হন গাইবান্ধা-১ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলাম লিটন। পরে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ড তদন্ত করতে গিয়ে ওই আসনের জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য ডা. আবদুল কাদের খানের সংশ্লিষ্টতা পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিচারে আবদুল কাদির খানসহ সাতজনকে ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয়। সম্প্রতি কারা হেফাজতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আবদুল কাদের মারা যান। অন্য আসামিরা এখনও জেলে।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে র্যাবের নেতৃত্বে আইনজীবীসহ সাতজনকে তুলে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ড দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতা নুর হোসেনসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে জড়িত হিসেবে নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি শামীম ওসমানের নামও আসে। সাত খুনের এ ঘটনায় র্যাব-১১-এর সিও লে. কর্নেল তারেক সাঈদকে প্রথমে বরখাস্ত এবং পরে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করে বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। আবরার হত্যার ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে নিহতের বাবা বরকত উল্লাহ ঢাকার চকবাজার থানায় মামলা করেন। ওই হত্যা মামলায় ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড আর পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছিলেন ঢাকার একটি আদালত। তবে রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল আবেদনের এখনও নিষ্পত্তি হয়নি।
ফলে পাঁচ বছর পার হয়ে গেলেও বহুল আলোচিত এ হত্যা মামলার রায় কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার আপিল দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে। সবশেষ আবরার ফাহাদের পরিবারকে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে নাÑ তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
আওয়ামী লীগের আমলে বিএনপি নেতা ইলিয়াছ আলী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমকে গুম করা হয়। তাদের আর খোঁজ মেলেনি। এ দুটি হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।
২০১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর যশোর বিএনপির সভাপতি নাজমুল ইসলামকে অপহরণ করে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। পরদিন গাজীপুর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
২০১০ সালের ৮ অক্টোবর নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া শহরে বিএনপির বিক্ষোভ কর্মসূচি চলাকালে বড়াইগ্রাম উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা সানাউল্লাহ নূর বাবুকে পুলিশের সামনেই পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনার পরদিন তার স্ত্রী মহুয়া নূর কচি বাদী হয়ে বড়াইগ্রাম থানায় ২৭ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ঘটনার ১১ বছর পর ২০২১ সালে প্রধান আসামি বনপাড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা কেএম জাকির হোসেন, পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক খোকন মোল্লা, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি কেএম জিল্লুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলামসহ ৪৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগত্র দাখিল করে।
২০১১ সালের ১ নভেম্বর নরসিংদীর জনপ্রিয় পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা লোকমান হোসেনকে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নিহতের ছোট ভাই মো. কামরুজ্জামান কামরুল বাদী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে প্রধান করে ১৪ জনের নামে মামলা করেন। পুলিশ মামলাটির চার্জশিট দিলেও আজও বিচার শেষ হয়নি।
২০১৩ সালের ২৯ জুলাই গুলশানে শপার্স ওয়ার্ল্ড নামে একটি বিপণিবিতানের সামনে যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক মিল্কীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরদিন তার ছোট ভাই বাদী হয়ে গুলশান থানায় ১১ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও চার-পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করেন। আজও সেই হত্যা মামলার বিচার হয়নি।
মিল্কী হত্যাকাণ্ডে জড়িত হিসেবে অন্যতম সন্দেহভাজন আসামি মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকেও একই কায়দায় ২০২৪ সালের ২৪ মার্চ গুলি করে হত্যা করা হয়। রাজধানীর শাহজাহানপুরে ওই হামলার সময় প্রীতি নামে এক কলেজছাত্রীও নিহত হন সন্ত্রাসীদের গুলিতে। ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ আদালতে চার্জশিট দিলেও আসামিরা জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়।
সাভারের আমিনবাজারে ২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবেবরাতের রাতে পিটিয়ে হত্যা করা হয় ছয় ছাত্রকে। তারা হলোÑ ধানমন্ডির ম্যাপল লিফ স্কুলের এ লেভেলের ছাত্র শামস রহিম, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক শ্রেণির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ইব্রাহিম খলিল, বাঙলা কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তৌহিদুর রহমান পলাশ, তেজগাঁও কলেজের ব্যবস্থাপনা প্রথম বর্ষের ছাত্র টিপু সুলতান, মিরপুরের বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সিতাব জাবীর মুনিব এবং বাঙলা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র কামরুজ্জামান কান্ত। আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হলে ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৯ জনকে যাবজ্জীবন সাজা এবং ২৫ জনকে খালাস দেওয়া হয়।
২০১২ সালের ৫ মার্চ গুলশানে গুলিবিদ্ধ হন ঢাকায় সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা খালাফ আল আলি। পরদিন ভোরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। খালাফ হত্যার ঘটনায় ৭ মার্চ গুলশান থানায় মামলা করে পুলিশ। একই বছরের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪ মামলার রায়ে পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। নিম্ন আদালতের রায়ের পর আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) জন্য হাইকোর্টে এলে আসামিরা আপিল করেন। শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে এক আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। তিন আসামির মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এক আসামিকে খালাস দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ৩ মার্চ আসামি সাইফুল ইসলাম মামুনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে।
ওয়েবসাইট থেকে অপরাধের পরিসংখ্যান সরিয়ে নেয় পুলিশ সদর দপ্তর
পুলিশের ওয়েবসাইটে ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অপরাধের পরিসংখ্যানের তথ্য রয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অপরাধের কোনো পরিসংখ্যান প্রকাশ করেনি পুলিশ সদর দপ্তর। মূলত ২০১৭ সাল থেকে পুলিশ সদর দপ্তর অপরাধ পরিসংখ্যান তাদের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাংবাদিকরা তথ্য না পাওয়া এবং ওয়েবসাইটে তথ্য প্রকাশ না করার কারণ জানতে চেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এরপর ওয়েবসাইটে আগের মতোই তথ্য প্রকাশ শুরু করে পুলিশ সদর দপ্তর।
পুলিশের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে সারা দেশে ৩ হাজার ৬৫৩টি হত্যার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে পুলিশের আটটি মেট্রোপলিটন এরিয়ায় সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এলাকায়Ñ ২০৮ জন। আর বিভাগ বা রেঞ্জ বিবেচনায় ওই বছর সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে চট্টগ্রাম রেঞ্জেÑ ৭৭৭ জন। এরপর ঢাকা বিভাগে ৭৭০ ও খুলনায় ৩৮১ জন খুন হয়েছে।
২০২০ সালে সারা দেশে হত্যার শিকার হয় মোট ৩ হাজার ৫৪৯ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭২৭ জন চট্টগ্রামে ও ৭০১ জন ঢাকা রেঞ্জে। ওই বছর মেট্রোপলিটন পুলিশ এলাকার মধ্যে ডিএমপিতে বেশি হত্যার শিকার হয় ২১৯ জন, আর চট্টগ্রামে ৭৭ জন।
২০২১ সালে সারা দেশে ৩ হাজার ২১৪টি খুনের ঘটনা ঘটে। তাদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৭০৮ ও চট্টগ্রাম বিভাগে ৫৮৬ জন। মেট্রোপলিটন এলাকার মধ্যে ডিএমপিতে ১৬৬ ও চট্টগ্রামে ৬৬ জন হত্যার শিকার হয়।
২০২২ সালে সারা দেশে হত্যার শিকার হয় ৩ হাজার ১২৬ জন। তাদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৭৬২ ও চট্টগ্রামে ৫২১ জন রয়েছে। আর মেট্রোপলিটন এলাকা বিবেচনায় ডিএমপিতে ১৬৬ আর চট্টগ্রামে ৬৬ জন খুন হয়েছে।
২০২৩ সালে খুন হওয়া ৩ হাজার ২৩ জনের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৬৭০ জন আর চট্টগ্রাম বিভাগে ৬২২ জন রয়েছে। আর মেট্রোপলিটন এলাকার মধ্যে ডিএমপিতে ১৬৫ ও সিএমপিতে ৫৩ জন খুনের শিকার হয়।
আর ২০২৪ সালে সারা দেশে হত্যার শিকার হয় ৩ হাজার ৪৩২ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৪০৪ ও চট্টগ্রাম বিভাগে ৫৭০টি হত্যার ঘটনা ঘটে। মেট্রোপলিটন এলাকা বিবেচনায় ডিএমপিতে ৩৩৯টি আর সিএমপিতে ৯০টি হত্যাকাণ্ড ঘটে।
পুলিশের পরিসংখ্যানে মামলার হিসাব
পুলিশের অপরাধ পরিসংখ্যান বলছে, বিগত ১৫ বছরে পুলিশের আটটি রেঞ্জের (৮ বিভাগ) মধ্যে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ঢাকা ও চট্টগ্রামে। মেট্রোপলিটন এলাকা হিসেবেও ডিএমপি ও সিএমপিতে খুনের ঘটনা বেশি ঘটেছে। এ ছাড়া খুলনা, সিলেট, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, বরিশাল বিভাগেও (রেঞ্জ) খুনের ঘটনা ছিল দৃশ্যমান। মেট্রোপলিটন এলাকার মধ্যেও এসব এলাকায় কমবেশি খুনের ঘটনা ছিল অহরহ।
পুলিশের অপরাধ গবেষণা বিভাগের (ক্রাইম অ্যানালাইসিস বিভাগ) পরিসংখ্যান অনুযায়ীÑ ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে খুনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৫৯ হাজার ৮২৩টি।
পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে ২০ লাখ ৮৩ হাজার ২৭৮টি। এসব মামলার মধ্যে পুলিশ তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ৭০৭টির। চার্জশিট দেওয়া মামলায় বিচারিক কার্যক্রম শেষে ২ লাখ ১ হাজার ৫২০টির রায় হয়েছে। তবে ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত মোট মামলার কতগুলো চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, কতগুলো মামলায় অপরাধীদের শাস্তির রায় এসেছে, সে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে।
সুত্র: প্রতিদিনের বাংলাদেশ
পাঠকের মতামত