৩৯ সেকেন্ডের একটি ভিডিও। সেখানে দেখা যায়, একটি কক্ষের এক কোনায় মেঝেতে শুয়ে কাতরাচ্ছে চোখ বাঁধা এক ব্যক্তি। পাশেই জবুথবু হয়ে বসে আছেন আরও দুজন। তাঁদের চোখও কাপড়ে বাঁধা, হাতকড়া পরানো। যে কক্ষের কথা বলা হচ্ছে, সেটি কোনো টর্চার সেল নয়, টেকনাফ থানার ওসি ওসমান গনির অফিসকক্ষ।
২০২০ সালের জুলাই মাসে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হওয়ার পর দেশব্যাপী তুমুল আলোচনায় উঠে আসে টেকনাফ থানা-পুলিশের কার্যক্রম। মাঝে কিছুদিন সেখানে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড কমে এলেও এখন আবার পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। স্থানীয় কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, টেকনাফ থানায় পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভিডিওর চোখ বাঁধা ওই তিন ব্যক্তিকে গত ২২ এপ্রিল সোমবার রাত ২টায় থানায় ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। থানার কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাঁদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করেন। পরদিন সকালে ওসির কক্ষে এনে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চোখ বেঁধে ফেলে রাখা হয়। পরে এক মাস আগের একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয় তাঁদের। ওই তিন ব্যক্তির দুজন হলেন মো. আব্দুর রহিম (১৯) ও আব্দুল আমিন (১৬)। সম্পর্কে তাঁরা আপন ভাই। অন্যজন ওমর ফারুক (২৪)। তিনি পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। গত বুধবার তাঁদের কক্সবাজার আদালতে তোলা হয়। সেখান থেকে পাঠানো হয় কারাগারে।
ওমর ফারুকের বাড়ি টেকনাফের অলিয়াবাদ এলাকায়। গ্রেপ্তারের আগে তিনি কক্সবাজার সদরের নাজিরারটেক এলাকায় থাকতেন। তিনিসহ তিনজনকে মোস্তাক আহমেদ নামের এক টমটম-চালককে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে টেকনাফ থানা-পুলিশ। গত ৬ মার্চ টেকনাফের অলিয়াবাদে খুন হয়েছিলেন মোস্তাক।
তবে ওমর ফারুকের স্ত্রী নুসরাত বেগম আজকের পত্রিকার কাছে দাবি করেন, তাঁর স্বামী কাউকে খুন করতে পারেন না। আব্দুল আমিনের স্ত্রী শারমিন আক্তারের দাবি, টমটমচালক নিখোঁজের দিন আব্দুল আমিন বাড়ি থেকে বের হননি। কারণ, তিনি অসুস্থ ছিলেন।
গ্রেপ্তার হওয়া ওই তিনজনের পরিবারের সদস্যরা জানান, সোমবার রাতে হঠাৎ পুলিশ এসে তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। পরে রাতে ৫ লাখ টাকা চাওয়া হয়। টাকা না দেওয়ায় বেধড়ক মারধর করা হয়। রাতভর চোখ, হাত-পা বেঁধে ওসির কক্ষেই ফেলে রাখা হয়।
টেকনাফ থানার পাশে ডিএসবি অফিস। এর পাশে একতলা একটি ভবন। সেখানে একটি কক্ষে থাকেন থানার উপপরিদর্শক মো. সোহেল। তাঁর কক্ষের পাশে আছে একটি টর্চাল সেল। অভিযোগ আছে, ওসির নির্দেশে সেখানে আটক ব্যক্তিদের নির্যাতন করেন উপপরিদর্শক সোহেলসহ আরও কয়েকজন। নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে নিরপরাধ ব্যক্তি যেমন আছেন, তেমনি ইয়াবা ব্যবসায়ীরাও রয়েছেন। ওসি ওসমান গনি এই থানায় যোগ দেওয়ার পর থেকে ৫ মাসে ২৫ জনকে এই টর্চার সেলে নির্যাতনের তথ্য পাওয়া গেছে।
নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে উপপরিদর্শক মো. সোহেল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একটি কক্ষ আছে। আসামিদের ধরে এনে এখানে জিজ্ঞাসাবাদ করি। যাঁরা মারধর বা নির্যাতন করেছি বলেছেন, তাঁরা আমাকে বিপদে ফেলার জন্য বলেছেন। আর আমি পুলিশ। সবাইকে তো সন্তুষ্ট করতে পারব না।’
একই প্রশ্নের জবাবে ওসি ওসমান গণিও সবকিছু অস্বীকার করে বলেন, ‘আমার কক্ষে নির্যাতনের বিষয়টি জানা নেই।’ এই প্রতিবেদকের কাছে ছবি ও ভিডিও আছে মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘তাহলে আমার খোঁজ নিতে হবে।’ থানার উপপরিদর্শক সোহেলের টর্চার সেলের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমাকে তথ্য দেন। ব্যবস্থা নেব। ওইখানে ওই রকম টর্চার সেল নেই।’
ওসি ওসমান গণি ও উপপরিদর্শক সোহেল থানায় নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করলেও নির্যাতনের শিকার এমন একজনের সঙ্গে কথা হয়েছে আজকের পত্রিকার। তাঁর বাড়ি টেকনাফের সাবরাংয়ে। ওই ব্যক্তি বলেন, থানায় একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হয়। বলা হয়, টাকা না দিলে অপহরণসহ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করবেন। পরে নিয়মিত টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে ছেড়ে দেয়।
টেকনাফের শাপলা চত্বর এলাকার এক মুদিদোকানি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কিছুদিন আগে থানার পুলিশ এসে হুমকি দিয়ে গেছে মাসিক চাঁদা দিতে। আমি নাকি ইয়াবা ব্যবসা করি।’
আগের রূপে টেকনাফ থানা, অপহরণ-নির্যাতন চলছেই
অপরাধের স্বর্গরাজ্য টেকনাফ
মিয়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ায় আগে থেকেই অপরাধপ্রবণ এলাকা টেকনাফ। মাদক ও পণ্য চোরাচালান এখানকার অপরাধীদের মূল কারবার। তবে এখন যুক্ত হয়েছে অপহরণ ও মুক্তিপণ-বাণিজ্য। রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে খুন-অপহরণ চরম আকার ধারণ করেছে সেখানে। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ সালের ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১২০ জনকে অপহরণ করা হয়। তাঁদের মধ্যে ৬২ জন স্থানীয় বাসিন্দা, বাকিরা রোহিঙ্গা নাগরিক। ভুক্তভোগী পরিবারের তথ্যমতে, অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ৫৩ জন মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার উখিয়া উপজেলার পল্লিচিকিৎসক মো. জহির উদ্দিন (৫১) ও মোহাম্মদ রফিক (৩২) অপহৃত হন। যদিও মুক্তিপণ ছাড়া ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁরা ছাড়া পেয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। গত বছর অপহরণের পর মুক্তিপণ দিতে না পারায় টমটম ও সিএনজিচালক এবং কক্সবাজার থেকে টেকনাফে বেড়াতে আসা তিন যুবকসহ মোট পাঁচজনকে দুর্বৃত্তরা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।
অপহরণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) শাকিল আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অপহরণের বেশির ভাগই মাদকসংক্রান্ত। কিছু হয় জেনুইন অপহরণ। আমরা এই বিষয়ে কাজ করছি। আমাদের কাছে গত বছরের মার্চ থেকে এই বছরের মার্চ পর্যন্ত ৬২ জন অপহরণের তথ্য আছে।’
পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া টর্চার সেলসহ অন্যান্য অভিযোগ আমরা তদন্ত করব। ইতিমধ্যে এসপি স্যারকে বলেছি। আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। দেশবিরোধী কাজ করলে সে যে-ই হোক, আমরা ব্যবস্থা নেব।’
আগের রূপে টেকনাফ থানা, অপহরণ-নির্যাতন চলছেই
৬ পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমারে নিত্যপণ্য পাচার
টেকনাফ দিয়ে মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যেমন চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, চিনি ও শুঁটকি। আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে পাওয়া খাদ্য সহায়তা (রেশন) রোহিঙ্গারা সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সেনা ও আরাকান আর্মির সদস্যদের কাছে পাচার করছে। বিনিময়ে তারা মাদকদ্রব্য আনছে বলে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গত রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হয়।
আজকের পত্রিকার সরেজমিন অনুসন্ধানে টেকনাফের ৬টি পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমারে পণ্য পাচারের তথ্য মিলেছে। পয়েন্টগুলো হলো শাহপরীর দ্বীপের দক্ষিণ পাড়া ঘাট, পশ্চিম পাড়া ঘাট, সাবরাং জিরো পয়েন্ট, মহেশখালিয়া পাড়া, বাহারছড়া ঘাট ও কচ্চিপ পাড়া ঘাট। গত বুধবার বিকেলে সরেজমিন সাবরাং জিরো পয়েন্ট দিয়ে পণ্য পাচার করতে দেখা গেছে।
সেখানে দেখা যায়, শ্রমিকেরা সারিবদ্ধভাবে কাঁধে করে পণ্য বোটে তুলছেন; বিশেষ করে রাতে ১২টার পর এসব ঘাট দিয়ে পণ্য পাচার করা হয়। এটির সঙ্গে থানা-পুলিশের হাত আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।