আন্তর্জাতিক তকমা পেতে যাচ্ছে রাকৃতিক সৌন্দর্যঘেরা কক্সবাজার বিমানবন্দর । আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বিমানবন্দরের সম্প্রসারিত রানওয়ের উদ্বোধন করার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। এর মাধ্যমে দেশের চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হতে যাচ্ছে কক্সবাজার। সমুদ্রজলের এই বিমানবন্দরের রানওয়ে হবে দেশের দীর্ঘতম।
উদ্বোধনের পর সাগরজল ছুঁয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ওঠানামা করবে এই রানওয়েতে। এর ফলে কক্সবাজারের পর্যটন অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পর্যটন নগরী কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ প্রায় শেষপর্যায়ে। সাড়ে ১৮ কোটি মার্কিন ডলার খরচে বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ চলছে। অর্থাৎ এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকার বেশি খরচ পড়ছে।
প্রথমবারের মতো দেশে সমুদ্রবক্ষের ওপর ১ হাজার ৭০০ ফুট রানওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে; মহেশখালী চ্যানেলের দিকে এ বিমানবন্দর সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য হবে ১০ হাজার ৭০০ ফুট। এরপরের অবস্থান হবে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের; যার দৈর্ঘ্য ১০ হাজার ৫০০ ফুট। ইতিমধ্যে প্রকল্পের ৭৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এ প্রকল্পের মূল্য লক্ষ্য কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ২০২১ সালে চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (সিসিইসিসি) সঙ্গে চুক্তি করে। এই কোম্পানি চীনের আরেক প্রকৌশল কোম্পানি চাংজিয়াং ইচাং ওয়াটার ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরোকে (সিওয়াইডব্লিউসিবি) সঙ্গে নিয়ে ২০২১ সালের আগস্ট মাসে প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শুরু করছে। এর আগে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য ছিল ৯ হাজার ফুট।
বেবিচক সূত্রে জানা যায়, কর্তৃপক্ষ ২০১২ সালে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে ৬ হাজার ৭৭৫ ফুট থেকে সম্প্রসারণ করে ৯ হাজার ফুট করে। সে সময় প্রস্থ ১২০ ফুট থেকে বাড়িয়ে ২০০ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়। ওই প্রকল্পের আওতায় রানওয়ের লোড ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছিল। পাশাপাশি আলোরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নতুন করে সমুদ্রজলরাশি বিস্তৃত রানওয়ের ফলে কক্সবাজার বিমানবন্দরে বড় বড় উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে পারবে। যেটা আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার পথ প্রশস্ত করবে।
বেবিচক সূত্র আরও জানা যায়, আগামী ৫০ বছরের চাহিদা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সরকার কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ শেষ হলেই এখানে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা ওঠানামা করতে পারবে ৩৮০-এর মতো সুপরিসর এয়ারবাস। কক্সবাজার বিমানবন্দর পরিণত হবে আন্তর্জাতিক অ্যাভিয়েশন হাব হিসেবে। সেখানে আন্তর্জাতিক টার্মিনালও নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে বেবিচকের।
একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে ধাপে ধাপে বিমানবন্দরের উন্নয়নকাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে কক্সবাজার থেকে সরাসরি পূর্ণ লোডে সুপরিসর আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা, সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন লাইটিং সিস্টেম সংস্থাপনের ফলে রাত্রিকালীন বিমান পরিচালনা, বিমানবন্দরের যাত্রী ও কার্গো পরিবহন সক্ষমতা বৃদ্ধি, সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আকাশপথে দ্রুত যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপন সম্ভব হবে। কক্সবাজার বিমানবন্দরে বর্তমানে বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, ইউএস-বাংলা, নভোএয়ার, এয়ার অ্যাস্ট্রার ২০ থেকে ২২টি ফ্লাইট পরিচালিত হচ্ছে। কক্সবাজার-যশোর রুটে চিংড়ি পোনা সরবরাহ করছে কয়েকটি কোর্গো বিমান।
এলাকাবাসী জানান, কক্সবাজার শহরের উত্তর প্রান্তে নাজিরারটেক উপকূল। এই রানওয়ে তৈরির কাজের জন্য উপকূলের জলবায়ু উদ¦াস্তুরা ভিটেমাটি হারিয়েছিলেন। তাদের বহুতল ভবন নির্মাণ করে নামমাত্র মূল্যে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। বেশ আগেই ঝুপড়ি ঘর ছেড়ে উদ্বাস্তুরা ফ্ল্যাটে উঠেছেন। ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট বুঝে পেয়েছেন তারা মাত্র এক হাজার এক টাকা পরিশোধে; এমন পরিবারের সংখ্যা ৬ শতাধিক।
সিসিইসিসির কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পের সাইট ম্যানেজার মিলি গুয়াংকি বলেন, ইতিমধ্যে প্রকল্পের ৭৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদকাল ৩৩ মাস হলেও নির্ধারিত সময়ের আগেই তারা কাজ করতে পারবেন বলে জানান।
তিনি বলেন, প্রকল্প গ্রহণ করার পর করোনা মহামারী কাজ বাধাগ্রস্ত করেছিল। এর পরও সবদিক ঠিক রেখে নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ করার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। রানওয়ে ছাড়াও কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় ভূমি উন্নয়ন, বাঁধ সুরক্ষা, ফুটপাত নির্মাণ, নিষ্কাশন, সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ করছেন তারা।
প্রসঙ্গত, ১৯৫৬ সালে অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর হিসেবে কক্সবাজার বিমানবন্দর যাত্রা শুরু করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিমানবন্দর ক্ষতিগ্রস্ত হয়; পরে সংস্কার করে আবার বিমানবন্দর সচল করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে কক্সবাজার বিমানবন্দরের আধুনিকায়ন করা হয়েছে। যেটা এখন আন্তর্জাতিক তকমা পাওয়ারঅপেক্ষায় রয়েছে।