মুহাম্মদ আলী জিন্নাত::
ত্রিকালদর্শী জয়নাব বেগম। বৃটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দেখেছেন। জন্মেছিলেন মুহুরীপাড়ায়, বিবাহ সূত্রে স্থায়ী হয়েছিলেন শহরের বাহার ছড়া গ্রামে। এই বিদূষী নারী জীবনব্যাপী ভজন (ধর্মীয় আতœাধিক গান) গাইতেন। তাই সঙ্গত কারণে এই নারীর আদরের সন্তানের রক্তে সংগীত সঞ্চারিত হবে এটি তো স্বাভাবিক। এমন আরও অসংখ্য কথার ফুলঝুরিতে মুখরিত ও প্রাণময় হয়ে ওঠেছিলো ছোট একটি মিলনায়তন।
মিলনায়তনটি এই জেলার অসংখ্য উজ্জ্বল, আলোকিত, বর্ণাঢ্য, সফল মানুষের উপস্থিতিতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ। এতো কীর্তিমান মানুষের উপস্থিতির একমাত্র উপলক্ষ ছিলো বিরলপ্রজ, তুলনাহীন মেধাবী, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, সাগর পাড়ের এই শহরের মৃত্তিকার সন্তান আব্দুল্লাহ আল মামুনের ‘তোমার জন্য’ গানের অ্যালবামের মোড়ক উন্মোচন।
মামুন বাহারছড়া গ্রামের প্রয়াত নজির আহমদ-জয়নাব বেগম দম্পতির ১১ সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। তারা ৯ সহোদর। সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে কৃর্তীমান, সুপ্রতিষ্ঠিত। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, এই জেলায় সবচেয়ে সফল দম্পতি নজির-জয়নাব দম্পতি। তারা রতœগর্ভা। একটু অন্যভাবে বললে মামুন হচ্ছেন জেলা আইনজীবী সমিতির বর্তমানে সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ সদস্য অ্যাডভোকেট সালামত উল্লাহ’র আপন অনুজ।
‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’ ‘এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে’ ‘মুখরিত জীবন’ ‘ছোট্ট বেলার সাথী ’ সহ অসংখ্য কালজয়ী গানের গীতিকার ও শিল্পী হচ্ছেন মামুন। সত্তর ও আশির দশকে গাওয়া তুমুল-তুখোড় জনপ্রিয় ওই গানগুলো এখনও মানুষের অন্তরে বাজে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-চুয়েট থেকে প্রকৌশল ডিগ্রি অর্জন করে পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষা এবং জীবিকার তাগিদে স্থায়ীভাবে তিনি পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। সুদূর প্রবাসে থাকলেও তার লেখা জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গীত ভুবনে তার অস্তিত্ব ছিলো নিরন্তর বিদ্যমান। দীর্ঘ তিন যুগ পরেও ওই গানগুলোর প্রতি শ্রোতাদের অদম্য ভালোবাসা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মাণ করেছেন নিজের গাওয়া মৌলিক এ্যালবাম ‘তোমার জন্য’। বাংলাদেশের সঙ্গীত ভুবনে এ যেন তার দ্বিতীয়বার ফিরে আসা। ‘তোমার জন্য’ অ্যালবামের জন্য কাজ করেছেন আলী হোসেন, শেখ সাদী খান, আলম খান, লাকী আখন্দ, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, মোঃ রফিকুজ্জামান এবং অনুপ ভট্টচার্য্যরে মতো কিংবদন্তীতুল্য সঙ্গীতজ্ঞ। আর কোনো এ্যালবামে তারা একসাথে কাজ করেননি। আধুনিক, ফোক ও সেমি-ক্লাসিক্যালসহ বিভিন্ন ধারার আটটি গান রয়েছে এই অ্যালবামে। ইতোমধ্যে তিনটি গানের মিউজিক ভিডিও বের হয়েছে। প্রতিটি মিউজিক ভিডিওতে রয়েছে একটি হৃদয় ছোঁয়া গল্প। দেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে মিউজিক ভিডিওগুলো প্রদর্শিত হয়েছে। ইতিমধ্যে অ্যালবামের ‘মিথ্যে অভিমানে’ গানটি জননন্দিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলোর মিউজিক স্টোর, আইটিউন, জিপিমিউজিক, রবি ইয়ন্ডার মিউজিকসহ প্রায় দুই ডজন অনলাইন মিউজিক স্টোরে এই অ্যালবাম পাওয়া যাচ্ছে। কর্মজীবনে শিল্পী মামুন একজন সফল প্রকৌশলী। যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত দ্বিভাষিক ম্যাগাজিন ‘মিলেনিয়াম’-এর চোখে নিজস্ব ক্ষেত্রে কীর্তি বিবেচনায় ২০১৩ সালের সেরা অনাবাসী বাংলাদেশের তালিকায় প্রথম দশজনের একজন নির্বাচিত হন। মামুন হলেন একের ভেতর অনেক। তিনি একজন দক্ষ রেডিও সাংবাদিক ও উপস্থাপক, কলামলেখক এবং কবি। কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে তার কাব্যগ্রন্থ ‘খুঁজে পেয়েছি প্রিয়তমা’। নিটোল মেলোডিনির্ভর গান বাংলাদেশে প্রান্তিক মানুষদের কাছে পৌঁছানো এবং বাংলা গান যাতে অকৃত্রিমতা থেকে বিচ্যুত না হয়, সে জন্যই তৈরি করেছেন শিল্পী মামুন এই অ্যালবাম ‘তোমার জন্য’।
অনুষ্ঠানে নিজের অ্যালবামের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান কক্সবাজার শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের প্রাচীন শুদ্ধ সংগীত শিক্ষালয় সংগীতায়তন মিলনায়তনে কেন আয়োজন করলেন তার কারণ ব্যাখ্যা করে মামুন জানালেন, তার আট বছর বয়সে সংগীতের হাতে খড়ি হয়েছিল সংগীতায়তনের প্রতিষ্ঠাতা ঋষিতুল্য ব্যক্তিত্ব ওস্তাদ স,আ,ম, আবু বকর সিদ্দিকীর কাছে। তাই এখানে আয়োজন মানে পূজনীয় ওস্তাদকে স্মরণ করা পাশাপাশি নতুনভাবে শেকড়ের কাছে ফিরে আসা।
সংগীতায়তন পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি অধ্যাপক রায়হান উদ্দিনের সভাপতিত্বে ও বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী শামীম আকতার ও প্রতিভা দাশের যৌথ সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে মোড়ক উন্মোচন করেন আব্দুল্লাহ আল মামুনের স্কুল জীবনের বন্ধু, বিশিষ্ট রাজনীতিক মুজিবুর রহমান (সাধারণ সম্পাদক, জেলা আওয়ামী লীগ)। মামুনের জানা-অজানা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন তার বন্ধু সুহৃদ যথাক্রমে প্রফেসর মোহাম্মদ সানাউল্লাহ (অধ্যক্ষ-সাতকানিয়া সরকারি কলেজ), বিশিষ্ট রাজনীতিক, ক্রীড়া সংগঠক আব্দুল খালেক, ব্যাংকার-কবি খোরশেদ আলম, ব্যবসায়ী মনজুরুল হাসান ও লেখক- কবি আবু নাসের চৌধুরী। অন্যান্যদের মধ্যে সাংবাদিক, লেখক-সংস্কৃতিকর্মী মুহাম্মদ আলী জিন্নাত, অধ্যাপক আকতার চৌধুরী, দৈনিক সৈকত সম্পাদক মাহবুবর রহমান, শিক্ষক-প্রাবন্ধিক নুরুল আজীজ চৌধুরী, শিক্ষক রাজবিহারী চৌধুরী, কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক পিন্টু আরেং, প্রকৌশলী-সংগঠক বদিউল আলম ও শিল্পী তালেব মাহমুদ। মামুনের পরিবারের পক্ষ থেকে তার অগ্রজ মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলম আবেগঘন স্মৃতির কথা বলেন।
কথামালায় অংশ নিয়ে সুধীজনরা বলেন, মামুন বাহারছড়া গ্রাম নয়, কক্সবাজার নয় শুধু, গোটা বাংলাদেশের অহংকার এবং গর্বের ধন। তার বর্তমান নিবাস সহধর্মিনী ও দুই কন্যা সন্তানকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়াতে হলেও কর্মসূত্রে কাতারে থাকছেন। ২০২২ সালে কাতারে যে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসবে, সে মহাযজ্ঞের আয়োজনে তিনি একজন অন্যতম পরিকল্পনাকারী প্রকৌশলী। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যম মামুনকে নিয়ে ইতোমধ্যে বিশাল ফিচার প্রতিবেদন ছাপিয়েছে। যার শিরোনাম হয়েছে ‘কাতার সাজাচ্ছেন বাংলাদেশের মামুন’।
তোমার জন্য অ্যালবামে মামুনের আটটি গান স্থান পেয়েছে। গানগুলো হলো ‘আমার মন পড়ে রয়’, ‘বেহায়া মনটা আমার’, ‘আমি সুখের জন্য’, ‘মিথ্যে অভিমানে’, ‘আমার অনেক দিনের আশা’, ‘যেতেই হবে’, ‘এক বরষার’, ও ‘তোমার জন্য’। গানগুলো গ্রামীণ, রবি, এয়ারটেল ও টেলিটক মুঠোফোন টোনে ও শোনা যাবে। অ্যালবামের গানের আয়োজনে সুদীপ্ত সাহা তবলা, উদয় মুখার্জী সেতার, রাহুল ব্যানার্জী বাঁশী, সুবীর রায় রিদম ও বেজ গিটার, চিন্ময় শী ভায়োলিন, সওকত খান সেক্সোফোন, কুন্দন সাহা ঢোলক, পারকাশন ও তুম্বা, মনোহিত রায় অক্টোপ্যাড, নীলোৎপল চক্রবর্তী ম্যান্ডোলিন ও ব্যাঞ্জো সংগত করেছেন। সংগীত সমন্বয়ক ছিলেন প্রিয়ব্রত চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে মামুন ও তার পরিবার বর্গের আরও সাফল্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করে এবং অভ্যাগত সকলে প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শুভ কামনা জানান সংগীতায়তনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সেলিম নেওয়াজ। তিনি ফুলেল শুভেচ্ছা ও জানান মামুনকে। অনুষ্ঠানের সার্বিক পরিকল্পনা ও সহযোগিতায় ছিলেন আবু হায়দার ওসমানী, আব্দুল মতিন আজাদ, নাসির উদ্দিন বিপু, মুহাম্মদ আলম শাহ, হারুন অর রশীদ, জুলফিকার আলী, দেলোয়ার হোসেনসহ আরো অনেকে।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে মামুনের বর্ণাঢ্য সংগীত জীবন নিয়ে নির্মান করা স্মৃতি ও ইতিহাসস্পর্শী তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।