প্রকাশিত: ০৪/০৮/২০১৬ ৯:৫৬ পিএম

maikকক্সবাজার তথা বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় একটি সেক্টরে ঘটে গেছে নিরব এক বিপ্লব। বিগত প্রায় দেড় দশকব্যাপী নীরবে নিভৃতে সংঘটিত এ বিপ্লব দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকার মাধ্যমে সম্ভাবনাময় এক উজ্জল আগামীর মজবুত ভিত্তি স্থাপন করলেও এখনো তা সবার প্রায় অগোচরেই রয়ে গেছে। এ বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করার জন্যই এ লেখার অবতারণা। মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে একটু ফ্লাশব্যাক করা প্রয়োজন।  বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সম্ভাবনাময় এক জেলা আমাদের প্রিয় কক্সবাজার। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর সদ্য স্বাধীন হওয়া আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে বিভিন্ন সম্ভাবনার বিকাশ ও প্রকাশ ঘটতে শুরু করে। তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার সাথে সাথে বৈদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও আমদানি রপ্তানির নতুন নতুন দ্বার উম্মোচিত হতে থাকে দিনের পর দিন। তখনই সত্তর দশকের অগ্রসরমান বিশ্বের সাথে তাল মিলাতে সদ্য স্বাধীন  বাংলাদেশের শিল্প-বাণিজ্যে নিত্য নতুন ধারার সৃষ্টি হতে থাকে। বৈশ্বিক বাণিজ্য ও চাহিদার সাথে তাল মিলাতে তখন দেশের  উপকূলীয় এলাকায় বাণিজ্যিক ভাবে চিংড়িচাষ ও রপ্তানি শুরু হয়, যার বেশীর ভাগই লবণাক্ত পানির বাগদা চিংড়ি। তখন সনাতনী পদ্ধতিতে চাষ হলেও আশির দশক থেকে বাংলাদেশে নিবিড় ও আধা নিবিড় বৈজ্ঞানিক চিংড়ি চাষ পদ্ধতির পালা শুরু হয়। তখনও পর্যন্ত নদদ-নদী ও সাগর মোহনার প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহরিত চিংড়ি পোনা দিয়েই মূলত চাষ করা হত। স্বাধীনতা পরবর্তী দুই দশকের মধ্যেই বাংলাদেশে উৎপাদিত চিংড়ি বিশ্ববাজারে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নেয়। হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতে থাকে প্রতিবছর। বিশ্ববাজারে ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রেক্ষিতে সারা দেশের উপকূলীয় এলাকায় বাগদা চিংড়ি চাষ সম্প্রসারিত হয়। চাষের পরিধি বাড়ার সাথে সাথে চিংড়ির রেনু পোনা (পোস্ট লার্ভা বা পি এল) এর ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়। এ চাহিদার যোগান দিতে ৯০ দশকে কক্সবাজার কলাতলী, উখিয়া সোনার পাড়া ও টেকনাফের সৈকত এলাকায় শুরু হয় বেসরকারী উদ্যোগে বাণিজ্যিক হ্যাচারী স্হাপন ও উৎপাদনের পালাক্রম। স্থানীয় উদ্যোক্তারা ছাড়াও দেশের শীর্ষ স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিল্পগ্রুপ সমূহ এখানে হ্যাচারী স্থাপন করেন। এভাবে ২০০০ সালের মধ্যেই প্রায় ৭০টি হ্যাচারী স্থাপিত হয় ও বাণিজ্যিকভাবে চিংড়ি পোনা উৎপাদন শুরু করে। কিন্তু গভীর সমুদ্র থেকে আহরিত মা চিংড়ি থেকে পোনা উৎপাদনের জন্য বিদেশী টেকনিশিয়ানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে হ্যাচারীগুলো। কারণ, নবপ্রতিষ্ঠিত এ শিল্পে পোনা উৎপাদন প্রযুক্তি বাংলাদেশীরা জানতনা। হ্যাচারীতে মা চিংড়ি থেকে ডিম স্পুনিং, হ্যাচিং ও পোনা রেয়ারিং করে সরবরাহ উপযোগী পি এল এ রূপান্তরিত করার প্রতিটি ধাপই অত্যন্ত জটিল বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করতে হয়। হ্যাচিং ও স্পুনিং ট্যাংকে মা চিংড়ি থেকে ডিম নির্গত হওয়ার পর নপলি, জুইয়া ও মাইসিস স্টেজ অতিক্রম করার পর সরবরাহযোগ্য পোস্ট লার্ভায় পরিনত হয়, যাকে আমরা চিংড়ি পোনা বা পি এল বলি। হ্যাচারীর প্রোডাকশন ইউনিটের বিভিন্ন পর্যায়ে  উপরোক্ত সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সময় বিন্দুমাত্র ভূল হলেই ভাইরাস সংক্রমিত হয়ে সব পোনা মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু ডিমওয়ালা মা চিংড়ি থেকে পোনা উৎপাদনের উপরোক্ত বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি বাংলাদেশীরা জানতনা। আর এ অজ্ঞতাকে পুঁজি করে ভারত, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, ফিলিপাইন ও তাইওয়ানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আগত হ্যাচারী টেকনিশিয়ানরা মালিকদেরকে জিম্মি করে পার্সেন্টিজের ভিত্তিতে গলাকাটা মজুরি আদায় করতে থাকে। বিদেশী টেকনিশিয়ানরা হ্যাচারীতে কাজ করার সময় এতই গোপনীয়তা রক্ষা করতো যে  বাঙ্গালী কোন স্টাফতো দূরের কথা এমনকি স্বয়ং মালিককেও হ্যাচারীর প্রোডাকশন শেডে ঢুকতে দিতনা। যদি তাদের কাজ দেখে বাঙ্গালীরা প্রযুক্তি আয়ত্ব করে ফেলে, এ ভয়ে। এরা সময় অথবা মাসিক ভিত্তিতে বেতন নিতনা, বরং মোট উৎপাদন ও বিক্রির উপর নির্দিষ্ট কমিশন হিসেবে মোটা অংকের টাকা আদায় করত। অনেক সময় দেখা যেত, মৌসুম শেষে হ্যাচারীর মালিক পক্ষ যে লভ্যাংশ পেত, ক্ষেত্রবিশেষে বিদেশী টেকনিশিয়ানরা তার চেয়েও আরো বেশী পেত। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে চিংড়ি হ্যাচারী খাত বিদেশী টেকনিশিয়ানদের কাছে জিম্মি হয়ে যায় ও শত শত কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যেত এরা। এ অবস্থা চলে দীর্ঘ দিন। দেশের চিংড়ি হ্যাচারী শিল্পকে বিদেশী  টেকনিশিয়ানদের একচেটিয়া আধিপত্য থেকে মুক্ত করতে ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত দেশী টেকনিশিয়ান সৃষ্টি করতে উদ্যোগ নেন মৎস্য অধিদপ্তরের দেশপ্রেমিক ও নিবেদিতপ্রাণ কতিপয় অফিসার। এ সেক্টরের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু উদ্যোক্তা-কর্মী এবং মৎস্য অধিদপ্তরের সৎ-দেশ প্রেমিক কতিপয় কর্মকর্তার ঐক্যান্তিক প্রচেষ্টায় ২০০২ সালে তৎকালীন সরকারের মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রনালয় “বাগদা চিংড়ি চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্প” নামে একটি প্রকল্প গ্রহন করে। এ প্রকল্পের অাওতায় কক্সবাজার পৌরসভার সমিতিপাড়া সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন এলাকায় মৎস্য অধিদপ্ততরাধীন এডিবি চিংড়ি হ্যাচারী ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে শুরু হয় হাতে কলমে নিবিড় প্রশিক্ষণ। “বাগদা চিংড়ি পোনা উৎপাদন, হ্যাচারী পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা” শীর্ষক দুই মাসের আবাসিক এ প্রশিক্ষণের বিভিন্ন ব্যাচে বাণিজ্যিক হ্যাচারীগুলোর মালিক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অংশ নেন। প্রতি ব্যাচে ২০ জন করে এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষিত বেকার যুবকরা অংশ নেন। প্রশিক্ষনার্থীগণকে সংলগ্ন ছাত্রাবাসে সার্বক্ষনিক অবস্থান  বাধ্যতামূলক করে হ্যাচারীতে হাতে-কলমে ব্যবহারিক ও তত্ত্বীয় প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত করে তোলা হয় এবং তাদের দ্বারা মা চিংড়ি থেকে মানসম্মত পোনা উৎপাদন করা হয়। এছাড়াও গ্রুপ ডিস্কাসন, বিভিন্ন বাণিজ্যিক হ্যাচারী পরিদর্শন, হ্যাচারী সেক্টরের বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে মতবিনিময়, বিভিন্ন কার্যক্রমের উপর এসাইনমেন্ট তৈরীসহ ইত্যাদি কর্মকান্ডের মাধ্যমে এক এক জন প্রশিক্ষণার্থীকে পূর্ণাঙ্গ হ্যাচারী টেকনিশিয়ান হিসেবে গড়ে তোলা হয়। প্রশিক্ষনের ব্যবহারিক ও তত্ত্বীয় ক্লাসে সারা দেশ থেকে আসা মৎস্য অধিদপ্তরীয় অভিজ্ঞ কর্মকর্তাগন, বিভিন্ন   বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষকবৃন্দ, বিভিন্ন হ্যাচারীর টেকনিশিয়ান ও মালিকরাসহ অপরাপর অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান ও ক্লাস নেন। প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান তৈরীর এ কর্মযজ্ঞ প্রথম পর্যায়ে ২০০৭ সাল পর্যন্ত চলে। এর পর ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ গুরুত্ব উপলদ্ধি করে আবারও ৫ বছরের জন্য এ প্রকল্প নবায়ন করে। ২য় পর্যায়ে এ প্রকল্প ও প্রশিক্ষন ২০১২ সাল পর্যন্ত চলে। এভাবে ১১ বছরের প্রশিক্ষনে বিভিন্ন ব্যাচে প্রায় ৪০০ দক্ষ হ্যাচারী টেকনিশিয়ান সৃষ্টি হয়েছে, যারা পরবর্তীতে অত্যন্ত সফলতার সাথে হ্যাচারী পরিচালনা করতে সক্ষম হয় ও বিভিন্ন হ্যাচারীতে এখন এরা কর্মরত আছে। মাত্র ১০ বছর আগেও যেখানে হ্যাচারী খাত বিদেশী টেকনিশিয়ানদের হাতে জিম্মি ছিল, এখন বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। এখন মাত্র ৩% হ্যাচারীতে বিদেশী টেকনিশিয়ান কর্মরত আছে আর বাকী ৯৭% হ্যাচারী বাংলাদেশী টেকনিশিয়ানরাই পরিচালনা করতেছে। বর্তমানে কক্সবাজার, খুলনা, বাগের হাট ও সাতক্ষীরার শতাধিক চিংড়ি হ্যাচারীতে প্রতিবছর প্রায় ১ হাজার কোটি চিংড়ি পোনা উৎপাদন হচ্ছে, যার শতকরা ৯৭ ভাগই সফলতার সাথে অপারেট করতেছেন বাংলাদেশী টেকনিশিয়ানরা। আর এতে প্রতিবছর সাশ্রয় হচ্ছে শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। এখন দেশের আভ্যন্তরিন চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও চিংড়ি পোনা রপ্তানী করতে সক্ষম বাংলাদেশ। এভাবেই সংঘটিত হয়েছে নিরব এক বিপ্লব। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাসে উপরোক্ত হ্যাচারী অপারেটিং প্রশিক্ষনে অংশ নিয়েছিলাম আমিও। নিবেদিতপ্রাণ প্রশিক্ষকমন্ডলীর তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষনে কিভাবে একেকজন দক্ষ টেকনিশিয়ান গড়ে উঠে তা দেখার সুযোগ হয়েছে খুব কাছ থেকে। কক্সবাজারের তৎকালীন জেলা প্রশাসক গিয়াস উদ্দীন আহমদ এ প্রশিক্ষনের গুরুত্ব সম্বন্ধে অবগত ও আগ্রহী ছিলেন। ২০১১। সালের মার্চ মাসের কোন একদিন তিনি এডিবি হ্যাচারী ক্যাম্পাসে ছুটে গিয়োছিলেন এ কর্মযজ্ঞ দেখতে। প্রশিক্ষনের ব্যবহারিক ক্লাস ও পোনা উৎপাদন কার্যক্রম দেখে আবিভূত হয়ে জেলা প্রশাসক মন্তব্য করেছিলে “এ প্রকল্পের প্রতিটি প্রশিক্ষনার্থী যেন এক একটি স্বর্ণখন্ড, দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটা শিল্পখাত এদের হাতে বিকশিত হবে”। হয়েছেও তাই, দেশের চিংড়ি হ্যাচারীখাত আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বনির্ভর এক শিল্পে পরিণত হয়েছে। বিদেশী টেকনিশিয়ানরা পাততাড়ি গুটিয়েছে অনেক আগেই। উদ্যোগী কিছু কর্মী-উদ্যোক্তা ও দেশ প্রেমিক কতিপয় সরকারী কর্মকর্তা দেখিয়ে দিয়েছেন, “আমরাও পারি”। কক্সবাজার তথা দেশের চিংড়ি হ্যাচারী খাতে সংঘটিত এ নিরব বিপ্লব যেন পজিটিভ বাংলাদেশেরই প্রতিরূপ। বাংলাদেশের ব্যবসা-শিল্প-বাণিজ্যের অপরাপর রুগ্ন ও সমস্যা সংকূল বিভিন্ন সেক্টরের জন্য উপরোক্ত সফল প্রকল্পের কর্মযজ্ঞ হতে পারে একটি রুল-মডেল।
===================
আতিকুর রহমান মানিক
ফিশারীজ কনসালটেন্ট ও সংবাদকর্মী,
সিনিয়র ষ্টাফ রিপোর্টার,
দৈনিক আমাদের কক্সবাজার।
মুঠেফোন – ০১৮১৮০০০২২০
ই মেইল- [email protected]

পাঠকের মতামত

আসলে কি বয়কট করছি!

আমরা বাঙালি নতুন ইস্যু পেলে দৌড়ে তা দেখার জন্য উৎকণ্ঠা প্রকাশ করি। আজ বয়কট নিয়ে ...