মোহাম্মদ শামীম ছিদ্দিকীঃ বিজলি বাতির ঝলক
শামীম ছিদ্দিকীর পৈত্রিক নিবাস কক্সবাজার’র রত্নাপালং। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বি.এ.(সম্মান) এম.এ. ডিগ্রিধারী। জাহেদের মাধ্যমেই তার সাথে আমার আনুষ্টানিক পরিচয় এবং পরবর্তীতে তা ঘনিষ্টতর হয়। তার জগৎ বলতে শুধু জাহেদ আর আমি। অবশ্য আমার আর শামীমের ক্ষেত্রে ও জাহেদ ছিলো সেরকম। ছাত্রজীবনে আমাকে দাবার ঘুটির মতো ঘুরতে হয়েছে। পরিশেষে, শামীমের সাথে পরিচয় হওয়ার পর শামীম আমাকে তার আস্থানায় স্থিত করলো। ক্লাসকক্ষ, লাইব্রেরি- চ.বি. লাইব্রেরি, পাবলিক লাইব্রেরি, ব্রিটিশ কাউন্সিল, চ.বি. বিভ্ন্নি বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরি’তে ব্যস্ত থাকতাম। জঠর যন্ত্রণা আর বইয়ের দোকানের কর্জ শোধের জন্য টিউশনি তো ছিলোই। শামীমের সাথে ঘনিষ্টতার পর থেকে অনেকের সাথে বন্ধুত্ব তৈরি হলো।
শামীমের আস্থানা হচ্ছে- ২৫৩, সোহরাওয়ার্দী হল, চ.বি.। শুধু কক্ষ না বলে আস্থানা বলার মাজেজা অন্যত্র। অনেকের আনাগোনা ছিলো সদা-হস্যোজ্জ্বল শামীমের কাছে। আমি তার এখানে আসার পর সে আরো অনেককে ডেকে নিয়ে আসতো। আমাকে এতো বেশি কদর করতো যে, আমি স্বয়ং বিব্রতবোধ করতাম। রাজনীতি, সাহিত্য, দর্শন, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ব্যক্তিগত সম্পর্ক’র অলিগলি, পরের তছনা থেকে শুরু করে মনে হয় কোনো কিছুই বাদ যেতো না। জাহেদ (রাজনীতি বিজ্ঞান), অনির্বাণ দাদা (ইংরেজি), নজরুল (বাংলা), সোলাইমান (রাজনীতি বিজ্ঞান), রেজু (চারুকলা), সরওয়ার (দর্শন), তুষার (আইন), ইয়াছিন (দর্শন), শুক্কুর (আরবি), কায়সার (বাংলা), আরো অনেকেই ছিলো। জগতের ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে ও আলাপ হতো। ঘটনা এমনো হয়েছে যে, রাত দশটায় আলাপ-আলোচনার শুরু আর সমাপ্তি তার পরের দিন সকাল আটটায় জিলানি হোটেলের খিচুড়ি চিবোতে চিবোতে।
ছোটো কক্ষে কষ্ট করে হলেও আমি আর শামীম ডাবলিং করতাম। পরবর্তীতে মাশেক (ব্যাংক কর্মকর্তা,কক্সবাজার) তার সিটটি আমাকে ছেড়ে দিয়ে ভাতিজা নাজমুলের (শিক্ষক, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ) কক্ষে চলে যায়। মাঝে মাঝে জাহেদ আসলে তার থাকার ব্যবস্থা ও করতে হতো। জাহেদ আর আমি এক সাথে হলে শামীম আমাদেরকে দিয়ে তার কিছু ব্যক্তিগত কাজ করিয়ে নিতো। শামীম গোছালো, পরিপাটি আর সৌখিন ছিলো। সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে প্রখর রসবোধ তো সাথে আছেই। তার সবচেয়ে বড়গুণ ছিলো বইয়ের প্রতি প্রচন্ড মমত্ববোধ। এটিই আমাকে সবচেয়ে বেশি প্ররোচিত করেছিলো তার সাথে ঘনিষ্ট হতে। আমি তার ব্যতিক্রমী কিছু গুণের মধ্যে বই সংগ্রহেকে পয়লা নম্বরে রাখতে চাই। আমার কাছ থেকে রেফারেন্স নিয়ে ও অনেক বই সংগ্রহ করেছিলো। বৈষয়িক কোনো চিন্তা আমি তার মধ্যে দেখিনি। সদা-হাস্যোজ্জ্বল- প্রাণবন্ত- প্রাণোচ্ছ্বল শামীমকে মাঝে মধ্যে বিচলিত হতে দেখে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হতাম। যে আমাকে আর আজাদকে (বাংলা) কাতুকুতু দিয়ে হাসাতে হাসাতে দম বন্ধ করে ফেলার উপক্রম করতো- সে শামীম ও কী তাহলে কিছু নিয়ে ভাবনায় নিমগ্ন, ভেবে কুল পেতাম না।
আমার মাস্টার্স পরীক্ষার ফলাফলে অভিভুত হয়ে বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ বইটি অটোগ্রাফসহ আমাকে দেয়। শামীম অটোগ্রাফে লেখে,‘ বন্ধুবরেষু আলম’কে, যে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে।- শামীম, ০৬.০১.২০০৪।’ বিভূতির পথের পাঁচালীর কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ আমি তাকে শোনাতাম। এ থেকেই ধরে নিয়েছিলো আমি বিভূতির ভক্ত। কথা প্রসঙ্গে আমি পরবর্তীতে তা খোলাসা ও করেছি। কারণ একটিই- বিভূতিকে পাঠ করতে গিয়ে আমার গ্রামে যাপিত জীবনের অবিকল সাক্ষাৎ পেতাম। আর বিভূতির নায়ক যেনো আমিই ছিলাম। গ্রামীণ জীবনের প্রকৃতির বিচিত্র ঢং, সাধারণ মানুষের অসাধারণ রসলীলা, মেঠোপথের শৈল্পিক বর্ণনা সবকিছু মিলে প্রকৃতি আর জীবনের এমন সরল ভাষ্যকার বাংলা সাহিত্যে বিরল।
শামীম মাঝে মধ্যে আমার সাথে বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি সম্পর্কে আলাপ করতো। বিশেষত চর্যাপদ, মধ্যযুগের গীতি কবিতা, আধুনিক কবি ও কবিতার বৈচিত্র ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা হতো বেশি। নাজিম হিকমত, মাহমুদ দারবিশ, পুশকিন, খাহলিল জিবরান, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, গোর্কি, ইয়েটস, জর্জ অরওয়েল, নিকোলাই গোগল, মায়াকোভস্কি, সাদী আর রুমি আলোচনায় হরদম থাকতো। শামীম স্বল্পভাষী- কিন্তু যখন কোনো বিষয়ে মনোযোগ দিতো তখন বেশি আবেগী হয়ে উঠতো।
সমাজব্যবস্থার হালহাকিকত নিয়ে হা-হুতাশ আমাদের মাঝে ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি, সামাজিক অবক্ষয়, তারেুণ্যের দেউলিয়াপনা, প্রতিবেশীর গৃহকর্তার ভুমিকা- ইত্যাদি বিষয়ে আমরা আমাদের করণীয় নিয়ে আলোচনায় মগ্ন হতাম। শামীম ক্লাস ফাঁকিবাজ শিক্ষকদের উপর প্রচন্ড বেজার ছিলো। আমি দেখেছি তার ভেতরে কি পরিমাণ অভিযোগ ছিলো। আমার হাত ধরে হঠাৎ একসময় বলে, ‘ভাই একটা অনুরোধ করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলে কখনো অহেতুক ক্লাস ফাঁকি দিয়োনা।’ আমি ইমোশনাল হয়ে গেলাম তার অভিযোগ প্রকাশের অভিব্যক্তি দেখে। আজো তার কথাটি আমার কানে বাজে। যার যা কর্তব্য তা যদি যথাযথভাবে না পালন করা হয়, তাহলে সমাজ কিভাবে এগুবে? কিন্তু আজো তো দেখি- মূল্যবোধের অবক্ষয় কিভাবে আমাদের তলানির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বিবেকবোধ যেনো আজ ঘুণপোকার আড্ডাখানা। উপরিকাঠামোর চাকচিক্য দেখে ঠাহর করার কোনো উপায় নেই যে সমাজ পচে কতটুকু তলানিতে এসেছে।
শামীমের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহীম আজাদ (বিএস.সি)। মরিচ্যাপালং হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। আমি যে বছর এস.এস.সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি- সে বছর তিনি কেন্দ্র প্রধান ছিলেন। অমায়িক মানুষ- যাকে দেখে মন থেকে আপনা- আপনিই শ্রদ্ধাবোধ জাগে। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে মরিচ্যাপালং উচ্চ বিদ্যালয়কে তিনি একটি কার্যকর শিক্ষায়তনে পরিণত করেছিলেন। তাঁর জীবনের পুরোটা সময় এখানে ব্যয় করেছেন। এই মানুষটিই স্কুল পরিচালনা কমিটির এঁদো রাজনীতির শিকার হয়ে অসহ্য যন্ত্রনা পেয়েছেন। পরবর্তীতে মহামান্য আদালত তাঁর যথাযথ প্রাপ্য তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছে। শামীমকে তখন খুব বিচলিত দেখতাম। আজকে ভাবতেই অবাক লাগে বীর মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহীম আজাদ (বিএস.সি )‘র মতো শিক্ষক ও জঘন্য ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন।
বিকেলে হাঁটতে বেরোলে আমার প্যাগোডায় অনির্বাণ দাদার কছে যেতাম। পথিমধ্যে অনেক কথার মধ্যে শামীম তার প্রিয় শিক্ষকদের কথা বলতো। আমরা ও বলতাম। শামীমের প্রিয় শিক্ষকদের তালিকায় ছিলো- ড. মনিরুজ্জামান, ড. ময়ুখ চৌধুরী, ড. শিরীণ আখতার (উপ-উপাচার্য, চ.বি) আর ড. মহিবুল আজীজ প্রমূখ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ক্যাম্পাসে ড. মনিরুজ্জামান স্যারের বাসায় গেলাম শামীম, নজরুল, আর আমি। খালাম্মা (স্যারের সহধর্মিণী) ও এসে যোগ দিলেন। মনিরুজ্জামান স্যার কিভাবে সাত ঘাট পেরিয়ে এ পর্যায়ে আসলেন- তা বর্ণনা করলেন। স্যারের মেয়ে মার্জিয়া জাবীন দোলা কিভাবে বাস অ্যাকসিডেন্টে দক্ষিণ ক্যাম্পাস মসজিদের পাশে মারা গেলো তা বিষাদাক্রান্ত হৃদয়ে আমাদের সাথে শেয়ার করলেন। দোলা’র নামেই দক্ষিণ ক্যাম্পাসের দোলা স্মরণি। বলা বাহুল্য, ড. মনিরুজ্জামান বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক অধ্যাপক আবদুল হাই’র জামাতা। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন’। নজরুল’র (শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম) মাধ্যমেই স্যারের সাথে আমার পরিচয়। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিই তখন স্যার কলা অনুষদের ডিন। যাক, নজরুলের সাথে কলা ভবনের নীচতলায় স্যারের সাথে দেখা করতে গেলে তিঁনি আমাকে অটোগ্রাফসহ তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘ইদানীং বিপন্ন বড়ো’ দেন। অটোগ্রাফে স্যার লেখেন, ‘সুপ্রিয় আলম (মোহাম্মদ আলম চৌধুরী)-র অসাধারণ ভালো ফলাফলে আমার আনন্দ- মনিরুজ্জামান, ১ লা মে ২০০৪ ।’ তারপর- তারপর থেকে তো মনিরুজ্জামান স্যার আমার আপনজন।
শামীম সম্পর্কে লিখতে বসে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অগোছালো ভাবের বহিঃপ্রকাশ কতো যে কষ্টের তা টের পাচ্ছি। কিছু স্মৃতি হৃদয়কে ব্রিকফিল্ডের আগুন যেভাবে কাঁচা ইটকে দাহ করে ঠিক তেমনি পুঁড়িয়ে শক্ত করে দেয়। শামীমের জন্য লেখা আমার প্রতিটি শব্দ আমার অন্তরকে ছিদ্র করেই আসছে।
শামীমের খোন্দকার পাড়ার বাসায় সর্বসাকুল্যে তিনবার গিয়েছি। দুইবার গিয়েছিলাম- দুই ঈদে। তৃতীয়বার সম্পর্কে এখনি বলছি না। এ লেখার একবারে শেষেই এটি থাকবে। শামীম আর জাহেদ ষষ্ট শ্রেণি থেকেই বন্ধু। দু’জনের সাথে আমার পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব আঙ্গিনায়।
শামীমের ২৫৩, সোহরাওয়ার্দী হল, চ.বি- এটিই ছিলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত উখিয়ার ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠন, উখিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’- এর আঁতুড় ঘর। শামীম’ই প্রথম এ সংগঠনের কথা ব্যক্ত করেছিলো। পরে ইয়াছিন, রাসেল, আমি মিলে একটি ফ্রেমে নিয়ে আসি। প্রথম দিকে কার্যক্রম চালাতে আমি টাকা দিয়েছিলাম। পরবর্তীতে এ সংগঠন নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছে।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের কিছু দিনের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ি। জাহেদ আর শামীম আমাকে দেখতে গিয়েছিলো। আমি তখন খালাতো ভাই ডা. জাবেদ জাহাঙ্গীর তুহিনের অধীনে চিকিৎসারত ছিলাম। তাদের দু’জনকে একসাথে পেয়ে আমি আবেগ সামলাতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেও শামীমকে দেখেছি- কিছু দিন পরপর তার পেট ব্যথা হতো। আমরা মেডিকেলে নিয়ে যেতাম। ইস! তখনো ঠাহর করতে পারিনি যে যমদূত তার সাথে বায়না করে গেছে।
ইতিমধ্যে বন্ধু জাহেদের বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছিলো। শামীমের কানেই প্রথম আওয়াজ আসে। হাসতে হাসতে আমাকে খবরটি বলে সে আরো জোরে হাসতে লাগলো। আমি হাসতে হাসতে বললাম এতো হাসির কী আছে? তারপর বহু জল্পনা আর কতো কল্পনা। এ দিকে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে আর শামীম প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েছে। নিয়তির কি নিষ্টুর পরিহাস। জাহেদের বিয়ে নিয়ে আমাদের যতো পরিকল্পনা ছিলো সব ভেস্তে গেছে। কোটবাজার এসে বিয়ের গাড়িতে বসেই আমি শামীমকে ফোন করি। তাকে বললাম, আমি জাহেদের বিয়েতে যাচ্ছি। ক্ষীণকন্ঠে বললো, ‘তুমি যাও। আমি তো পারছিনা।’ তার কন্ঠস্বর শুনে আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছিলো।
শামীমের অসুস্থতা বেড়ে গেলে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। যদিও আমি বলি এ মেডিকেল হচ্ছে চট্টগ্রমের সবচেয়ে পুরনো রোগী। আমি তাকে দেখতে গেলাম। হাড্ডিসার শরীরে শুধু হাসিটাই অবিকল রয়ে গেছে আর বাকী সব উধাও। আমার মনের ভেতরে তখন প্রচন্ড ঝড় বয়ে যাচ্ছে আর অনেক চিন্তা জড় হয়েছে মনের অলিন্দে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর আমি তাকে একটি খাম হাতে দিলাম। আবার শিশুসুলভ সরল হাসি। এ খামের মধ্যেই ছিলো তার জীবনের বড়ো স্বপ্নের অর্জন। সোনার হরিণ নামে খ্যাত সরকারি চাকুরির নিয়োগপত্র। এটি ছিলো কুতুবদিয়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান পত্র। ২৫৩ নং কক্ষ, সোহরাওয়ার্দী হল থেকে আমি নিয়োগপত্রটি নিয়ে গিয়েছিলাম। চলে আসার আগে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার ব্যারাম কী?সে বললো কলিজার মধ্যে একটি ছোটো ফোঁড়া উঠেছে। ইনজেকশনের সিরিঞ্জ দিয়ে ফেটে দিলে আর কোনো অসুবিধা থাকবে না। মৃত্যুকে জড়িয়ে ধরেও প্রচন্ড আশাবাদী শামীম ভেঙ্গে পড়েনি। আমি হ্যান্ডশেক করে চলে আসি।
আরেকটি ঘটনা বলি। ঈদুল ফিতরের তিনদিন বাকী। বাড়ি যেতে হবে। শামীম তখন একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকুরী করতো। আমি তাকে ফোন করে বলি, দু’জন একসাথেই যাবো। সেও রাজি হলো। বায়না ধরলো তাপানুকুল বাসে যাবার। খরচ কমাতে আমি বিভিন্ন অজুহাত দেখালাম। অবশেষে যাত্রা শুরু করলাম। বাসে সে বিভিন্ন বিষয়ে কথা তুললো। আবার বায়না ধরলো যে, এবার বাড়ি পৌঁছা পর্যন্ত সমস্ত ভাড়া আমাকে দিতে হবে। আমি রাজী হলাম। এ কথা সে কথার পর আমি বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য নিয়ে কথা তুললাম। শামীমের প্রিয় গালি ছিলো ‘ভন্ড’ সেটা সে আমাকে প্রয়োগ করে কথা শুরু করলো। কপাল কুন্ডলা থেকে কয়েকটি লাইন বললো। আমার এতো ভালো লাগলো যে, বললাম লিখে দাও। সে বললো পরে। আমি নাছোড় হয়ে বললাম, এখনিই লিখে দাও বলে বাসের টিকেটের অভিযোগ লেখার পৃষ্টাটি দিলাম। সে লিখলো। লেখাটি এখনো আমার সংরক্ষণে আছে। তার সাথে জড়িত স্মৃতিরা ও অবিকল আছে। আমার মনে এখনো সব অমলিন।
শুধু শামীম নেই—–এ ইহজগতে। তাকে নিয়ে আমার স্মৃতিময় ভাবনাগুলো আমাকে নীরবে পোঁড়াচ্ছে তুষের আগুনের মতো।
আমি তৃতীয়বারের মতো শামীমদের বাড়ি গিয়েছিলাম। নিথর নিস্তব্দ একটি দেহ খাটিয়ায় শোয়ানো। বহু মানুষের আহাজারী। তারপর…। আমি প্রিয় বন্ধুর কবরে একমুঠো মাটি দিয়ে চলে আসি- বেদনাসিক্ত মন নিয়ে।
আলম চৌধুরী:
সহযোগী অধ্যাপক
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
পাঠকের মতামত