জুনাইদ কবির চৌধুরী
জন্ম: ১৯৪০ সালের ২৩ জুন কক্সবাজার মহকুমার বর্তমান রামু উপজেলার নোনাছড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরী। মাত্র ৫ বছর বয়সে তিনি শ্রদ্ধেয় পিতা ও কক্সবাজার আইনজীবী সমিতির সাবেক সদস্য গোলাম কবির চৌধুরীকে হারান। আর গ্র্যাজুয়েশনের আগেই মাতা গুলনর বেগম চৌধুরী ইন্তেকাল করেন। আমি সবসময় বড় আব্বাকে (বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরী) দেখতাম বাবা-মা’র স্মৃতিচারণ করতে। বিশেষ করে মা’র প্রতিটি কথা তাঁর জীবনের চলার ক্ষেত্রে অনুসরণ করেছেন। সবসময় বলতেন, আমার মায়ের দোয়া আমার বড় শক্তি। কম বয়সে পিতা-মাতা হারানোর ফলে বড় আব্বাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। তাঁর অধ্যাবসায় কর্মনিষ্টা, সমাজ ও দেশের প্রতি ভালবাসায় তাঁকে দেশের বরেণ্য ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তোলে।
শিক্ষা: ১৯৫৫ সালে কক্সবাজার হাইস্কুল থেকে পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশনে লেটার মার্কস ১ম বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৫৯ সালে কৃতিত্বের সাথে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে বিএ (ডিগ্রি) অর্জন করেন। ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম আইন কলেজ থেকে এলএলবি পাশ করে চট্টগ্রাম জজ কোর্টে আইন পেশায় যোগদান করেন। উল্লেখ্য, মেট্রিক পরীক্ষায় তিনি বোর্ড থেকে পারমিশন নিয়ে সকল বিষয়ে ইংরেজিতে পরীক্ষা দিয়েছিল।
জীবন সংগ্রাম ও সমাজসেবা: বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরী ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে ও ২০০৪ সালে আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে নিযুক্ত হন। এছাড়া তিনি কক্সবাজার জেলার প্রথম বিচারপতি। বিচার বিভাগে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কক্সবাজার জেলার আইনজীবী সমিতি কর্তৃক ২০০৪ পাতা ৩ : কলাম ৫
বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরী
সালে সমিতির প্রথম সম্মানিত সদস্য পদ প্রদান করা হয়।
তিনি আইনজীবী হিসেবে অত্যন্ত সৎ ও নিষ্টাবান ছিলেন। তৎকালিন রীমা হত্যাকান্ডের বাদীপক্ষের আইনজীবী ছিলেন তিনি। এ মামলা পরিচালনাকালীন সময় তাঁকে অনেক বাঁধা বিপত্তির সম্মুখ হতে হয়। ন্যায় বিচারের স্বার্থে তিনি পিছ পা হননি। এছাড়া তিনি আরো বহু আলোচিত মামলার আইনজীবী ছিলেন। বিচারপতি থাকাকালিন সময়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় প্রদান করেন। তাঁর প্রতিটি লেখা, কথায় দেশ ও সমাজের জন্য তাঁর ভালবাসা প্রকাশ পেতো। তিনি সবসময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। সারা জীবন সৎ থেকে নিরলস ভাবে কাজ করে গেছেন। বর্তমানে এমন সৎ ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া খুব দুস্কর।
২০০৭ সালে বিচারপতি হিসেবে অবসর গ্রহণের পর সরকার কর্তৃক শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিযুক্ত, ২০০৮ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠার পর কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান পদে অভিষিক্ত হন।
আইন পেশার পাশাপাশি সমাজ সেবায়ও নিরবিচ্ছিন্ন অংশগ্রহণ করতেন। বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরী জাতীয় আইনজীবী সমিতির প্রতিষ্ঠাকল্পে সাংগঠনিক কমিটির সদস্য, ১৯৮৭-১৯৮৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট চট্টগ্রাম বেঞ্চ আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক, ১৯৫৩-১৯৫৪ সালে কক্সবাজার হাই স্কুল ডিবেটিং সোসাইটি’র সাধারণ সম্পাদক, রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ির পল্লী মঙ্গল সমিতি, কক্সবাজারের লিয়াকত মেমোরিয়াল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। ১৯৫৩-১৯৫৮ সালে কক্সবাজার মহকুমা মুসলিম ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৫৫-১৯৫৮ সালে কক্সবাজার জেলা মুসলিম ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক, ১৯৬৪-১৯৯০ সালে পর্যন্ত কক্সবাজার সমিতি চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, ১৯৭৩-১৯৯০ সালে বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় সমাজকল্যাণ কাউন্সিলের সদস্য ও ১৯৮৪-১৯৯০ সালে সরকার কর্তৃক গঠিত কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলা সমাজকল্যাণ কাউন্সিলের সহ-সভাপতি ছিলেন। বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের আগ পর্যন্ত চট্টগ্রামের অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসন সংস্থা, সমাজকল্যাণ ত্রাণ কমিটি, খরুলিয়া পল্লী ধর্ম ভান্ডারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। তিনি ১ ও ৩ নম্বর চট্টগ্রাম শহর সমাজসেবা প্রকল্প ও চট্টগ্রাম ফুলকুঁড়ি আসরের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এছাড়া রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, নাটাব, ডায়াবেটিক সোসাইটি সহ বহু সংখ্যক প্রতিষ্ঠানের আজীবন সদস্য, সমাজসেবার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৫৩-১৯৫৪ সালে বাঁশখালী সমাজসেবা সংসদ, কুতুবদিয়া সমিতি চট্টগ্রাম ও সাতকানিয়া-লোহাগাড়া সমিতি ঢাকার সম্মানিত সদস্য ছিলেন। ইসলামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বায়তুশ শরফ কর্তৃক ফেলোশিপ প্রদান করা হয়। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক শ্রেষ্ঠ সমাজকর্মী পদক, ১৯৯২ সালে চট্টগ্রামের সেবা নিকেতন পদক, ২০০০ সালে কক্সবাজার প্রেসক্লাব পদক এবং ১৯৯৫ সালে আঞ্জুমান ইত্তেহাদ কর্তৃক গুণীজন সংবর্ধনা, ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, বাংলাদেশের রোটারী ক্লাবসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সম্মাননা প্রদান করা হয়।
১৯৭৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে আন্তর্জাতিক সমাজকল্যাণ সম্মেলন, ২০০১ সালে দিল্লীতে দক্ষিণ এশিয়ার বিচারপতিদের ওয়ার্কশপ, ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ‘গ্লোবাল জাজেস ফোরাম’ এ বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের উচ্চ আদালত কার্যবলী অবলোকন, ২০০৫ সালে ইতালিতে অনুষ্ঠিত আইডিপি সংক্রান্ত কোর্সে অংশগ্রহণ, ২০০৬ সালে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বিচারপতি সম্মেলন এবং ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে অনুষ্ঠিত ১৫তম আন্তর্জাতিক বিচারপতি সম্মেলনে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান। ভারত, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্যে, যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত মানবাধিকার বিষয়ক সম্মেলন ও ওয়ার্কশপে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব প্রদান, যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্স ও হাউস অব লর্ডসে অধিবেশন প্রত্যক্ষ করেন, যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রী কর্তৃক আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উক্ত দেশের মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশনা উৎসবে যোগদান ও যুক্তরাজ্যে এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবাধিকার সম্পর্কিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ প্রদান। বিচারপতি আমিরুল কবির ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, অষ্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ইতালি, কাতার, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান ভ্রমণ করেন। আইন ও সমাজসেবা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রবন্ধ জাতীয় দৈনিক ও সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম থাকাকালিন বাংলাদেশ বেতারে সমাজ কল্যাণ ও আইন বিষয়ে বাথিকা উপস্থাপন।
একটি কথা না বললেই নয়, আমি ব্যাংকে চাকুরি করা অবস্থায় জেঠার কাছে এডভোকেটশীপের পরিক্ষার খাতা আসতো। উনি যখন পরীক্ষায় খাতায় মার্ক দিতেন, পাস মার্ক ছিল মনে হয় ৩৬। কোন খাতায় যদি মোট নং ২৮/৩০ কেউ পেতো, আমি দেখতাম উনি অনেক চিন্তায় পরে যেতেন এবং এটা কিভাবে ৩৬ করা যায় সে চিন্তা করতো। একদিন বললেন, ছেলেটিকে যদি ৩৬ দিয়ে পাস করায় দিই, তাহলে অন্তত ওকালতি করবে। না হলে তো বেকার হয়ে বন্দুক হাতে নিতে পারে। এ রকম চিন্তা ধারার মানুষ ছিলেন উনি।
মৃত্যু : বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরী ২০১৮ সালের ১লা মে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। কিন্তু মানুষ হিসেবে সমাজ সংস্কারক, দেশপ্রেমিক হিসেবে সর্বোপরি অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে অতন্দ্র প্রহরি হিসেবে বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরী জনগণের হৃদয়ে সদাজাগ্রত থাকবেন। বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরী কক্সবাজার জেলার গর্ব। তিনি থাকবেন, তিনি আছেন কক্সবাজার জেলাবাসির হৃদয়ে। তাঁর কর্ম তাকে করেছে অমর, অবিনশ্বর। ওপারে ভাল থাকুন বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরী।