আমার মেয়ে বাংলাদেশে গিয়ে বিরাট বিরাট ওড়না পরে ঘুরছে। আমি তাকে জিজ্ঞ্যেস করলাম, কী ব্যাপার? সে বললো, ‘সবার মতো করতে হবে, নইলে নাকি পচা বলবে?’ ওর ধারণা এটা না করলে সবাই ওকে বিদেশী ভাববে। যা হোক আমার মেয়ে অতি দ্রুত কী বুঝলো কী জানি, আমি কিন্তু আজও বুঝলাম না, আর মানলামও না এই ওড়না প্রথা।
আমার এই নারী দেহ নিয়ে জন্মানো এই বাংলাদেশে কেন এটা ভাবতে ভাবতে আমি সাদা চুল জন্ম দিয়ে ফেললাম। নারীদেহ মানে একটি ‘পাপ বহন করা শরীর’ এটা নানা ভাবে বুঝতে শুরু করলাম। যার প্রথম পাঠ শুরু হলো ওড়না দিয়ে। মা খালি বলতো ওড়না পরো, ওড়না ঠিক করো। এই যে বুকজোড়া ঠিকমতো ঢাকা হচ্ছে না তা শুনতে শুনতেই বড় হলাম। স্কুল-কলেজে বান্ধবী অনেকে বিশেষ ভঙ্গিতে বলতো, অমুক মেয়েটা তো অসভ্য। ওড়না ঠিক থাকে না। কিন্তু ওড়না যে মেয়ের সবচেয়ে বেশি ঠিক থাকতো সেই এমন চরম অসাধু আর অসভ্য কাজ করে বসতো, যা আমি নিজে দেখেছি।
এক খণ্ড কাপড়ের টুকরা কী সুন্দর করে ভাল আর খারাপ মেয়ের পাৰ্থক্য তৈরি করতো! আমার মায়ের অত্যাচারে ওড়না খণ্ড ঘরে নিরাপদ স্থানে রাখতাম। বাড়িতে কেউ এলে কলিংবেল বাজামাত্র ওটা বুকের উপর বসিয়ে দৌড়। কিন্ত ওড়না আমাকে বাঁচায়নি। বহু বাংগালী পুরুষ কথা বলার সময় মুখ না বুকের দিকে তাকিয়ে কথা বলেছে। ইচ্ছা হয়েছে ওদের গলায় ওড়নাটা পেঁচিয়ে টান মারি।
বরং ইউরোপে কোনো ছেলে এ কাজটি করেছে বলে মনে পড়ে না। যতো ঢাকনা ততো নাকি মেয়েরা আকর্ষণ করে, এমনটিই ভাবে আমাদের ছেলেরা। কিন্তু ঢাকা বা না ঢাকা, সব বুকই তাদের দৃষ্টিতে পড়ে। পুরুষের চোখে যেন স্ক্যান করার ক্ষমতা আছে।
আরেকটা বিষয়, আমাদের দেশে ব্রা কেনা কতোই না কঠিন। ইচ্ছা করে দোকানদার ইঙ্গিতপূর্ণ সুরে গলা ফাটিয়ে বলেছে, ‘আপা এটা লাগবো লাগবো’। অথচ এই আমি এখানে দোকানে যাই, মাপ দিয়ে আমার ব্রা কিনি। কক্সবাজারে বেড়াতে গেলে ছেলেরা দেখি, খালি গায়ে হাফ প্যান্ট পরে ঘুরছে আর মেয়েরা শাড়ী-সালোয়ার-কামিজ পড়ে। এটি যে কতো বিপজ্জনক। বিকিনি পরতে নাই বা পারে, কিন্তু লেগিংস বা ওয়াটার প্রুফ কিছু কি পরা যায় না? এটি বলায় একজন বললো, এটা আমাদের কালচার। কালচার মানে কি জলস্রোতে ওড়না ঠিক রাখা?
এই বাংগালী কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকায় ঘুরেও তার চিন্তা-চেতনা বদলাতে পারিনি। এদেশে এসে দেখলাম সমালোচনার কোন পর্যায়ে মানুষ যেতে পারে। অমুক ভাবী জার্মান হয়ে গেছে, তমুক ঠ্যাঙ বের করে আছে। কিন্ত ঠ্যাঙ তারা দেখেও, আবার সমালোচনাও করে। একটি সম্পূর্ণ আলাদা দেশ, যেখানে আবহাওয়া আমাদের দেশী পোষাকের বৈরী। সেখানে মানুষের সমালোচনা করার অভ্যাস বিদেশ এসেও ঠিক হয় না।
গত বছর তুরস্কে ছুটি কাটানোর জন্য গিয়েছিলাম। হোটেল মালিক মুসলমান। তার স্ত্রী মিনি থেকে লং সব পোশাক পরছে। রাস্তাঘাটে মেয়েরা সব ধরনের পোশাক পরে হাঁটছে, কেউ তো কুৎসিত কথা বলছে না।
আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শহীদুল্লাহ কলাভবনে আসার আগে প্রতিদিন প্রায় শরীর নিয়ে কমেন্ট শুনতে হতো মেয়েদের। একদিন এক ছেলেকে বলেছি, আচ্ছা ভাই, তুই প্রতিদিন মেয়েদের বুক নিয়া বলিস কেন? মায়ের বুকের দুধ খেয়ে তো বড় হইছিস। ওড়না পরবে, তা গলায় রাখবে না, বুকে রাখবে, এটা প্রতিটি মেয়ের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা।
অশ্লীলতা বাস করে মনে, দেখবার দৃষ্টিতে। আর এই দৃষ্টির ব্যবহার এমন পর্যায়ে যায় একজন পুরুষ নারীকে আর সম্মান দিতে পারে না। আমাদের বুক কাপড়ের টুকরা দিয়ে ঢাকা থাকা সত্ত্বেও ধর্ষণ কমেনি। ছেলেরা টাইট জিন্স পরে, আন্ডারওয়্যার বের করা প্যান্ট পরে, অশ্লীলভাবে লুঙ্গি পরে। কই মেয়েরা তো সিটি বাজায় না, বা কমেন্ট করে না!
মেয়েদের শরীর নিয়ে পুরুষ অনবরত ছেঁড়া কাটা করছে, আর তসলিমা নাসরীন শরীর নিয়ে কথা বললেই চরিত্রহীন হয়ে যাচ্ছেন। নারীর আত্মসম্মান খুব প্রয়োজন। সে নিজে সিদ্ধান্ত নেবে ওড়না পরবো, হিজাব পরবো, না জিন্স পরে হাঁটবো। নারী মানে বুক, নিতম্ব, যোনি নয়- আর এটা যেদিন পুরুষরা ভাববে আর বুঝতে শিখবে, সেদিনই নারী তার পোষাকের স্বাধীনতা পাবে।
womenchapter