প্রকাশিত: ২৯/১১/২০২০ ৯:১৬ এএম

আমি কি তোমাদের ঘুমকে একধরনের বিরতি, রাতকে একরকম আবরণ এবং জীবিকা অন্বেষণের জন্য দিন তৈরি করে দিইনি? —আন-নাবা ৯-১১

ঘুম আল্লাহর تعالى পক্ষ থেকে এক বিরাট উপহার। ধনী, গরিব, জ্ঞানী, মূর্খ সবাইকে সমানভাবে এই উপহার ভোগ করার সুযোগ দিয়েছেন। বরং এই উপহারটি তিনি গরিবদেরকে বেশি দিয়েছেন ধনীদের থেকে। অনেক ধনীরা আছেন, যারা তাদের আলিশান বাড়িতে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে, নরম বিছানায়, দু-তিনটা বালিশ দিয়েও  আরামে ঘুমাতে পারেন না। ঠিকমতো ঘুমের জন্য তাদেরকে নিয়মিত ঘুমের ওষুধ খেতে হয়। অন্যদিকে গরিবরা তাদের কুঁড়ে ঘরের মাটিতে মাদুর বিছিয়ে শক্ত বালিশে আরাম করে সারারাত ঘুমায়। কিছু মানুষের জীবনে প্রাচুর্যের শেষ নেই, কিন্তু এক রাত ঘুমের জন্য তারা এমন কোনো চেষ্টা নেই যে তারা করছে না। মাসের পর মাস ঘুমের পিল খেয়ে যাচ্ছে রাতে কয়েক ঘণ্টা ঘুমের জন্য। একসময় গিয়ে পিল কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। —ঘুম যে কত বড় একটি উপহার, সেটা তারাই বোঝে, যারা রাতের ঘুম হারিয়ে ফেলে।

ঘুমকে আল্লাহ تعالى বলেছেন سبات সুবাত, অর্থাৎ বিরতি, থামা, বন্ধ করা। ক্লান্ত দেহ, মনকে পুনরায় সতেজ করার জন্য ঘুমের বিকল্প নেই। চা, কফি, এনার্জি ড্রিঙ্ক ইত্যাদি যা কিছুই মানুষ পান করুক না কেন, ঘুম মানুষকে যতটা সতেজ করে, ততটা আর কোনো কিছুই পারে না। দুপুর বেলা দশ-বিশ মিনিট ঘুমিয়ে নিলে বাকি দিন এবং সন্ধ্যায় দেহ-মন যতটা সতেজ, চাঙ্গা থাকে; মাথা যতটা ঠাণ্ডা থাকে; চিন্তাভাবনা যতটা পরিষ্কার হয়— তা অন্য কোনো বিকল্প পানীয় বা ওষুধ থেকে পাওয়া যায় না।

একইভাবে ঘুম মানুষকে মানসিক শান্তি দেয়। সারাদিনের মানসিক চাপ, অশান্তির পর রাতের বেলা যখন ঘুমিয়ে পরে, পরেরদিন জেগে উঠে সেই চাপ এবং অশান্তি অনেকখানি দূর হয়ে মন শান্ত হয়ে যায়। আজকে পৃথিবীতে লক্ষ মানুষকে নানা ধরনের ওষুধ এবং পানীয় পান করে মন শান্ত করতে হয়, অস্থিরতা কমাতে হয়। অথচ আল্লাহ تعالى মানুষকে ঘুম দিয়েছেন প্রতিদিন নানা ব্যস্ততার মাঝে শান্তি, স্থিরতা খুঁজে পাওয়ার জন্য।

আর মানুষ ইচ্ছে করলেও না ঘুমিয়ে বেশি দিন থাকতে পারবে না। দুই দিন এক নাগাড়ে জেগে থাকলেই শরীরে জটিল সমস্যা শুরু হয়ে যাবে, মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেতে থাকবে। তিন দিন জেগে থাকলে শরীরে অঙ্গ প্রত্যঙ্গে স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যাবে। চার দিন পর মানুষ যতই জেগে থাকার চেষ্টা করুক, কিছুক্ষণ পর পর ঘুমিয়ে পড়বে। জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিতে এত উন্নত, এত ক্ষমতাবান একটি প্রাণী, হাজার চেষ্টা করেও ঘুমকে জয় করতে পারেনি। প্রতিদিন তারা ঘুমের কাছে পরাজিত হয়।  ঘুম প্রতিদিন মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, সে কত অসহায়, কত দুর্বল একটা প্রাণী।

ঘুম শুধু মানুষের শারীরিক এবং মানসিক চাহিদাই পূরণ করে না, একই সাথে এটি প্রতিদিনের জীবন সংগ্রাম থেকে আত্মাকে একটু সময়ের জন্য হলেও বিরতি দেয়।  ঘুমের মধ্যে এক অনাবিল প্রশান্তিতে ডুবে যাওয়ার এই যে চাহিদা মানুষের রয়েছে, তা খাবার এবং পানীয়ের চাহিদা থেকে কোনো অংশে কম নয়।

ঘুমের প্রয়োজনীয়তা

পৃথিবীতে যত প্রাণীর স্নায়ুতন্ত্র আছে, যার মধ্যে মানুষ একটি, তাদের সবার জন্য ঘুম অত্যাবশ্যকীয়। সম্প্রতি আবিষ্কার হয়েছে যে, এই ধরনের প্রাণীরা যতক্ষণ বেঁচে থাকে ততক্ষণ তাদের কোষের ক্রোমোজোমে নানা ধরনের ক্ষতি হতে থাকে। ঘুমের সময় শরীরের কোষগুলো তাদের ডিএনএর মধ্যে এই ক্ষতিগুলোকে মেরামত করে ফেলে। যতক্ষণ ঘুমাতে থাকে, ততক্ষণ শরীরের এই স্বয়ংক্রিয় মেরামত প্রক্রিয়া সচল থাকে। নিয়মিত মেরামতের ফলে কোষগুলো সুস্থ সবল থাকে। যদি দেহ নিয়মিত যথেষ্ট সময় না পায় কোষগুলোকে মেরামত করার জন্য, তাহলে কোষগুলোর মধ্যে নানা ধরনের সমস্যা জমতে জমতে একসময় কোষগুলো অসুস্থ হয়ে নানা অসুখের জন্ম দেয়। আল্লাহ تعالى আমাদের ঘুম দিয়েছেন যেন শরীরের কোষগুলো প্রতিদিন মেরামত করে সুস্থ থাকতে পারে।[৪৭৩][৪৭৪]

গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের মস্তিষ্ক জেগে থাকার সময় ক্রমাগত কাজ করতে থাকলে নানা ধরণের টক্সিন জমা হয়। ঘুমের সময় মস্তিষ্ক এই টক্সিনগুলো পরিষ্কার করার সুযোগ পায়। একারণে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম না হলে মস্তিষ্কে টক্সিন জমতে জমতে মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে থাকে, যা থেকে হতাশা, অবসাদ, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, স্কিটজোফ্রেনিয়া সহ নানা ধরণের জটিল মানসিক সমস্যা তৈরি হয়। মলমূত্র ত্যাগ করে শরীর যেভাবে ক্ষতিকারক পদার্থ পরিষ্কার করে, তেমনি ঘুমের সময় মস্তিষ্কের গ্লিমফেটিক সিস্টেম মস্তিষ্কে জমে থাকা ক্ষতিকারক পদার্থ পরিষ্কার করে ফেলে। এ কারণেই দেখা যায় যে, যারা রাতের বেলা ঠিকমতো ঘুমায় না, তাদের মানসিক সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আর যাদের মানসিক সমস্যা ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে, তারা যখন রাতের বেলা ঠিকমতো ঘুমাতে পারে না, তখন তাদের সমস্যা আরও প্রকট হতে থাকে। মানসিক রোগীদের একারণেই ঘুমের ওষুধ দিয়ে বেশিক্ষণ ঘুমাতে দেয়া হয়। কারণ ঘুম হচ্ছে মস্তিষ্কের স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেকে মেরামত করার অত্যন্ত কার্যকরী একটি ব্যবস্থা।[৪৭৫]

যারা নিয়মিত ঠিকমতো ঘুমায় না, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যেতে থাকে এবং তারা সহজেই নানা ধরনের অসুখের আক্রমণের শিকার হয়। কেউ যদি ঘন ঘন সর্দিকাশিতে ভোগে, তাহলে তার জন্য ঘুম ঠিকমতো না হওয়াটা দায়ী হতে পারে, কারণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাওয়ার একটা কারণ পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব।

যারা দিনে সাত ঘন্টার কম ঘুমায়, তাদের মোটা হয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। কারণ যারা কম ঘুমায়, তাদের খাবার খেয়ে তৃপ্ত হওয়ার বোধ কমে যায় এবং তাদের ক্ষুধার হরমোন বেশি বের হয়। একারণে তারা বেশি বেশি খায় এবং মোটা হতে থাকে।

রাতকে আবরণ

আল্লাহ تعالى মানুষকে শুধু ঘুমই দেননি, একইসাথে ঘুমের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা তৈরি করে দিয়েছেন। পৃথিবীতে তিনি দিন এবং রাতের ব্যবস্থা করেছেন, যেন মানুষ রাতের অন্ধকারে শান্তিতে ঘুমাতে পারে। রাত কোনো সহজ ব্যাপার নয়। রাত সৃষ্টি করার জন্য পুরো মহাবিশ্বে এক বিশাল ঘটনা ঘটাতে হয়েছে। আমরা মহাবিশ্বের যেদিকেই তাকাই না কেন, প্রতিটি বিন্দুতেই কোনো না কোনো গ্যালাক্সি রয়েছে। এই গ্যালাক্সিগুলোর প্রত্যেকটির মধ্যে রয়েছে শত কোটি তারা। এই সবগুলো গ্যালাক্সির কোটি-কোটি-কোটি-কোটি তারা থেকে যদি পৃথিবীতে আলো এসে পৌছাতো, তাহলে রাতের আকাশের প্রতিটি বিন্দু দিনের মতোই জ্বলজ্বল করত। আমরা কোথাও কোনো অন্ধকার দেখতে পেতাম না।

কিন্তু সেটা হয় না। রাতের আকাশের দিকে তাকালে অনেক জায়গা অন্ধকার দেখতে পাই। এর কারণ হলো আমাদের গ্যালাক্সি থেকে অন্যান্য গ্যালাক্সিগুলোর বেশিরভাগই আলোর থেকেও বেশি গতিবেগে সরে গেছে। যার কারনে সে গ্যালাক্সিগুলো থেকে আলো এসে কখনো পৃথিবীতে পৌঁছায় নি। এ কারণেই রাতের আকাশের ওই জায়গাগুলোতে এখনো আমরা অন্ধকার দেখতে পাই।

এই অসাধারণ ঘটনাটি ঘটছে কারণ মহাবিশ্ব এক সময় আলোর থেকেও বেশি গতি বেগে সম্প্রসারিত হয়েছে। যার ফলে বহু গ্যালাক্সি আমাদের গ্যালাক্সি থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। শুধু তাই না, এখনো মহাবিশ্ব প্রতি সেকেন্ডে সম্প্রসারিত হচ্ছে। মহাবিশ্বের সবকিছুই একে অন্যের থেকে ভীষণ গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। —কেন এমনটা হচ্ছে তা এখনো বিজ্ঞানীদের কাছে এক বিস্ময়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে, মহাবিশ্বে কোনো এক অজানা শক্তি রয়েছে, যা এই সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে। একে নাম দিয়েছেন ডার্ক-এনার্জি বা অজানা-শক্তি। এই শক্তির প্রকৃতি কী, এটা কীভাবে কাজ করে, এটা কোথা থেকে আসলো— কিছুই বিজ্ঞানীরা ধারণা করতে পারছেন না। এই ডার্ক-এনার্জি মহাবিশ্বকে শুধু সম্প্রসারণই করছে না, একইসাথে সম্প্রসারণের গতিকেও বৃদ্ধি করছে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন মহাবিশ্ব ছিঁড়ে ফেটে যাবে।[৪৭৬]

এই ডার্ক-এনার্জি না থাকলে মহাবিশ্বের অস্বাভাবিক সম্প্রসারণ কখনো হতো না। আর এরকম অস্বাভাবিক সম্প্রসারণ না হলে গ্যালাক্সিগুলো কখনো আমাদের গ্যালাক্সি থেকে আলোর থেকেও বেশি গতিবেগে দূরে সরে যেত না। আর যদি তা না হতো, তাহলে রাতে আমরা অন্ধকার পেতাম না।

অন্ধকার ছাড়াও পুরো প্রকৃতিকে আল্লাহ تعالى রাতের বেলা প্রস্তুত করেন মানুষের বিশ্রামের জন্য। গাছপালা এবং প্রাণিজগৎ রাতের বেলা এমন এক অবস্থায় চলে যায়, যা মানুষের বিশ্রামের জন্য অনুকূল। প্রকৃতিতে শব্দ এবং কোলাহল রাতের বেলা অপেক্ষাকৃত কম থাকে। একই সাথে রাতের বেলা আবহাওয়া শীতল হয়ে যায়, যেন মানুষ বিশ্রাম নিতে পারে। যদি উল্টোটা হতো যে, রাতের বেলা প্রাণিজগৎ জেগে উঠত এবং কোলাহল শুরু করে দিত, খাবারের জন্য গবাদি পশুগুলো চিৎকার শুরু করে দিত, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যেত। মানুষ আর শান্তিতে ঘুমাতে পারত না। আর রাতে যদি দিনের থেকে গরম বেশি হতো, তাহলে মানুষ আরামে ঘুমাতে পারত না।

আল্লাহ تعالى আমাদেরকে প্রতিদিন রাতের এই আবরণ দিয়েছেন, যেন আমরা দিনের শত কোলাহল, ব্যস্ততা থেকে একটু বিরতি নিতে পারি। রাতের অন্ধকারের আবরণে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে শান্তিতে বিশ্রাম নিতে পারি। কুরআনে অন্য জায়গায় আল্লাহ تعالى বলেছেন যে, রাতকে তিনি বিশ্রামের জন্য তৈরি করেছেন—

দিনের উম্মোচনকারী তিনি। রাতকে তিনি বিশ্রামের জন্য দিয়েছেন। সূর্য ও চাঁদকে দিয়েছেন গণনার জন্য —সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান, সর্বজ্ঞানীর নির্ধারণ সেটি। — আল-আনআম ৬:৯৬

যারা রাত জেগে কাজ করে এবং দিনে ঘুমায়, তাদের নানা ধরনের শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা হয়। রাতের শিফটে কাজ করা মানুষদের উপর গবেষণায় দেখা গেছে যে, তাদের উল্লেখযোগ্য হারে ডিএনএ-তে ক্ষতি হয়। এই ক্ষতি থেকে পরবর্তীতে বড় ধরনের অসুখ এবং ক্যান্সারের সূত্রপাত হয়। দিনের বেলা ঘুমালেও এই ক্ষতি পুরোপুরি মেরামত হয় না, কারণ রাতের বেলা মানুষের দেহে মেলাটোনিন সহ অন্যান্য মেরামতকারী হরমোনগুলো যে পরিমাণে বের হয়ে ডিএনএ মেরামত যতটা ভালভাবে করতে পারে, দিনের বেলায় ততটা পারে না।[৪৭৭]

আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, আজকাল যেসব তরুণরা রাতের শিফটে কাজের দিকে ঝুঁকছেন, কারণ তারা মনে করেন যে, রাতের বেলা তারা ভালভাবে কাজের চাপ সামলাতে পারেন  —তাদেরকে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, তাদের দেহের কোষে অক্সিডেটিভ ক্ষতি এবং ডিএনএ-এর ক্ষতি অপেক্ষাকৃত বেশি। এই দুই ক্ষতি ডায়াবিটিস, হার্ট এটাক এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়।[৪৭৮]

জীবিকা অন্বেষণের জন্য দিন

প্রায় সব প্রাণীর মস্তিষ্কে একটি ঘড়ি রয়েছে, যা দেহের বেশিরভাগ শারীরিক প্রক্রিয়া এবং আচরণকে সময় অনুসারে নিয়ন্ত্রণ করে। একে বলা হয় ‘সার্কেডিয়ান রিদম’। মানব দেহে প্রায় বিশ হাজার নিউরন নিয়ে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে এই ঘড়িটি গঠিত, যা চব্বিশ ঘণ্টার একটি চক্র নিয়ন্ত্রণ করে। দিনের আলো চোখের রেটিনাতে আঘাত করলে তা মস্তিষ্কের সেই অংশে এক ধরনের সিগনাল পাঠায়, যা মস্তিষ্ককে ধারণা দেয় যে, এখন কি দিন, নাকি রাত? মস্তিষ্কের এই ঘড়িটি প্রভাবিত হয় আলোর উপস্থিতিতে।

এই ঘড়ি অনুসারে দেহের বেশিরভাগ শারীরিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয়। এই ঘড়ি বলে দেয় যে, দিনের বেলা বেশি করে রক্ত সঞ্চালন করতে হবে; শ্বাসে অক্সিজেন বেশি নিতে হবে, বেশি করে কোষের খাদ্য ভাণ্ডার খরচ করে শক্তি যোগান দিতে হবে; শরীরের পেশিগুলোকে বেশি পরিশ্রমের জন্য দুপুর থেকে প্রস্তুত রাখতে হবে; সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত স্মৃতি এবং মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা বেশি সক্রিয় রাখতে হবে; শরীরের তাপমাত্রাকে ভোরের আলো ফোটা থেকে শুরু করে দুপুর পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে হবে ইত্যাদি। আর এই ঘড়িটিকে তৈরি করা হয়েছে এমনভাবে যে, এটি দিনের বেলা দেহকে কাজের জন্য বেশি প্রস্তুত রাখবে এবং রাতের বেলা দেহকে কম সক্রিয় করে বিশ্রাম নেবার জন্য প্রস্তুত করবে —ঠিক যেভাবে আল্লাহ تعالى এই আয়াতটিতে বলেছেন।

যারা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করেন, তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো সময় হচ্ছে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত। ভোর থেকে দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি হওয়া শুরু করে, যা দুপুর পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে থাকে। একারণে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মানুষের কার্যকর স্মৃতি, সতর্কতা, সক্রিয়তা এবং মনোযোগ দেবার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি থাকে। সকাল বেলা হালকা গরম পানিতে গোসল করলে তা আরও সহায়তা করে।

অন্যদিকে যারা শারীরিক কাজ করেন, দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দেহে সেই সব হরমোন বেশি নিঃসরণ হয়, যা পেশির শক্তি বৃদ্ধি এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া করতে সাহায্য করে। এই সময় পেশির জোড়াগুলো ২০% বেশি নমনীয় থাকে। একারণে এই সময় খেলাধুলা, ব্যায়াম এবং অন্যান্য শারীরিক কাজ করা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়।

শরীরের এই স্বাভাবিক ঘড়িতে যদি ব্যঘাত ঘটানো হয়, তাহলে ডিপ্রেশন, ডায়াবিটিস, ডেমেনশিয়া এবং অতিরিক্ত মেদ জনিত সমস্যা সৃষ্টি হয়। রাতে জেগে থেকে মানুষ স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারে না। রাতে জেগে থাকার জন্য তাকে ঘন ঘন চা-কফির আশ্রয় নিতে হয়, যা তার শরীরে আরও ক্ষতি করে। অনেক সময় চা-কফি খেয়েও রাতের বেলা যথেষ্ট কর্মক্ষমতা আসে না। তখন নানা ধরনের ওষুধে ঝুঁকতে হয়। তার উপর দিনের বেলা আলোর উপস্থিতি, বাতাসে তেজস্ক্রিয়তা এবং চারিদিকের কোলাহলের কারণে ঠিকমতো ঘুম হয় না। যার ফলে দেহের নিয়মিত মেরামতও ঠিক মতো হয় না। এভাবে মানুষ ধীরে ধীরে জটিল অসুখের দিকে এগিয়ে যায়।

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেহের এই স্বাভাবিক দিন এবং রাতের চক্র ব্যহত হলে এবং রাতে আগে ঘুমিয়ে ভোর বেলা না উঠলে মানুষের ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। একসাথে এই চক্র দেহের ইনসুলিন নিঃসরণ, গ্লুকোজ শোষণ নিয়ন্ত্রণ করে। যখন এই চক্র ব্যাহত হয় ঠিকমতো না ঘুমানোর কারণে, তখন মানুষের টাইপ ২ ডায়াবিটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।[৪৭৯][৪৮০]

আধুনিক যুগে মানব দেহ এক নতুন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। রাতের বেলা টিভি, উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক বাতি এবং মোবাইল ফোনের আলোর কারণে মানুষের স্বাভাবিক দিন এবং রাতের চক্র ব্যাপকভাবে ব্যহত হচ্ছে। বিশেষ করে রাতে বিছানায় শুয়ে মোবাইল করার কারণে এই সমস্যা মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে। রাতের বেলা চোখে সাদা আলো পড়ার কারণে দেহের ঘড়িটি উল্টোপাল্টা হয়ে যাচ্ছে। দেহ বুঝতে পারছে না যে, এখন কি দিন, নাকি রাত? রাতে কীভাবে দিনের মতো তীব্র আলো আসছে? —একারণে দেহ ঠিকমতো রাতের মেরামত কাজ করে না। যার ফলে নিয়মিত দেহে ক্ষতি বেড়ে যায়, মেরামত কমে যায়। রাতে ঘুম কম হয়, বা হলেও ঘুমের মান কমে যায়। যার ফলে মানুষ আর ভোর বেলা উঠতে পারে না, যা মানুষের দেহের জন্য স্বাভাবিক। দেরী করে সকালে উঠে দেহ ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্থ হয়ে থাকে। কাজেকর্মে যথেষ্ট আগ্রহ, উদ্যম আসে না। সকাল বেলা উঠে মন প্রফুল্ল হয় না। ঘুম থেকে উঠে জড়তা এবং বিরক্তি নিয়ে। সারাদিন কাজে কর্মে পুরোপুরি আগ্রহ আসে না। ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখার আগ্রহ কম থাকে, মান খারাপ হয়। দিনের বেলা দেহ চাঙ্গা করার জন্য চা-কফি, এনার্জি ড্রিঙ্কের আশ্রয় নিতে হয়। দেহের স্বতঃস্ফূর্ত শক্তি, উদ্যম তখন নষ্ট হয়ে যায়। নিয়মিত কৃত্রিম কোনো ব্যবস্থা ছাড়া মানুষ আর স্বাভাবিক কাজের ক্ষমতা ফিরে পায় না। সেই কৃত্রিম ব্যবস্থার উপর মানুষ তখন আসক্ত হয়ে যায়।[৪৮১]

এই ‘সার্কেডিয়ান রিদম’ এমন এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, যা তিনজন বিজ্ঞানীকে ২০১৭ সালে নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছে। তারা অবিস্কার করেন কোষের ভেতরে বিশেষ কিছু প্রোটিন কীভাবে চব্বিশ ঘণ্টার একটি চক্র অত্যন্ত সুন্দরভাবে ছোট বেলা থেকে একদম বুড়ো বয়স পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে। দেহের উপর সার্কেডিয়ান রিদম-এর ব্যাপক ভূমিকা আবিষ্কার করে সেই তিন বিজ্ঞানী এই অনন্য সম্মান লাভ করেন।

এই হলো শুধু দেহের মধ্যে ব্যবস্থা যেন মানুষ দিনের বেলা ভালভাবে জীবিকা অন্বেষণ করতে পারে। এছাড়া রয়েছে চারপাশের প্রকৃতিতে হাজারো ব্যবস্থা, যা দিনের বেলা মানুষের জীবিকা অন্বেষণের ব্যবস্থাকে সহজ করে দেয়। গাছপালা, পশুপাখি, আবহাওয়া, তাপমাত্রা ইত্যাদি বহু ব্যাপার আল্লাহ تعالى দিনের বেলা মানুষের কাজের অনুকূলে করে দেন। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে আমরা আজ বুঝতে পারছি প্রকৃতির অসংখ্য ব্যবস্থাপনায় দিন এবং রাতের মধ্যে কী ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।

পাঠকের মতামত

তুরস্কে কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম হলেন বাংলাদেশি হাফেজ

ইসলামী ঐতিহ্যের স্মৃতি বিজড়িত তুরস্কে অনুষ্ঠিত ৯ম আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম হলেন বাংলাদেশি হাফেজ, ...