পার্বত্য বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার প্রাচীন নিদর্শন ও অন্যতম পুরাকীর্তির আলীর সুড়ঙ্গ। রহস্যময় এ সুড়ঙ্গ ঘিরে নানা কিংবদন্তি ও রূপকথা প্রচলিত আছে। স্থানীয়দের নিকট এটি আলীর সুড়ঙ্গ বা আলীর সুরম নামে সমধিক পরিচিত। উপজেলার সরকারী পরিসংখ্যন অফিস এ আলীর সুড়ঙ্গকে স্থান মর্যাদা দিয়ে নিথিভূক্ত করেছে। নানা উপকথা ও রূপকাহিনীর ভিড়ে ইতিহাসের সঠিক তথ্য-উপাত্ত খুঁজে পাওয়া না গেলেও কিংবদন্তির এই আলীর সুড়ঙ্গ অন্যতম পুরাকীর্তি হিসাবেই এ উপজেলায় পরিগণিত। আলীকদম উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণ দিকের পাহাড়ের নাম আলীর পাহাড়। এই আলীর পাহাড়েই রহস্যজনক ৪টি সুড়ঙ্গের অবস্থান। এসব সুড়ঙ্গ নিয়ে প্রচলিত আছে নানা রূপকথা ও ভৌতিক কল্পকাহিনী। একই সাথে আছে সত্য কাহিনীও। এ সুড়ঙ্গ দেখতে প্রতিবছর ভিন্ন দেশের সবপ্রান্ত থেকে শত শত পর্যটক ও কৌতুহলি লোকজন ছুটে আসেন। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির বদৌলতে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে আলীর সুড়ঙ্গ অভিযানের নানা কাহিনী ও চিত্র। আলীর সুড়ঙ্গ নিয়ে নানা রূপকথা ও ভৌতিক কল্প কাহিনীর পাশাপাশি সত্য কাহিনীর নজিরও রয়েছে বলে জানা যায়। পুরাকালে নিস্তব্দ পাহাড়ের বুকে বৃত্তকার সুড়ঙ্গ কিভাবে তৈরী হলো তা নিয়ে সুনির্দ্ধিষ্ট নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র পাওয়া যায়নি। তবে এ সুড়ঙ্গকে ঘিরে রয়েছে নানা রূপকথা ও কিংবদন্তি। পার্বত্য আলীকদম উপজেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে আলীকদম প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাংবাদিক মমতাজ উদ্দিন আহমদ কর্তৃক রচিত গিরিনন্দিনী আলীকদম বইয়ে আলীর সুড়ঙ্গ নিয়ে একটি চমৎকার রূপকথার অবতারণা করা হয়েছে।
রূপকথাটি নিন্মরূপ:-
......কথিত আছে, প্রাচীন আলীকদমের সভ্যতার লোকালয় থেকে মাতামুহুরী নদী তীরবর্তী আলীর পাহাড়ে একদল মেহনতি কাঠুরিয়া জীবিকার সন্ধানে কাঠ, বাঁশ আহরণে যায়। প্রতিদিনের মত পরিশ্রমি কাঠুরিয়ার দল নদীর ঢালুর পারে নির্মিত এক চালা ঝুপড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছিল। সে সময় একজন ঝটাধারী লোক হঠাৎ তাদের সামনে আভির্ভূত হলে কাঠুরিয়াগণ ভীত-বিহ্বল হন। কাঠুরিয়ারা লোকটির প্রতি তেড়ে যায়। তখন লোকটি অপরাধীর ন্যায় করুণভাবে হাত জোড় করে বলে উঠে,আমাকে মেরো না। আমি কোন জ্বিন, ভূত, পাগল বা দস্যু নই। আমি এক বিপন্ন, হতভাগ্য লোক। আমাকে আশ্রয় দাও। লোকটির করুণ মিনতিতে কাঠুরিয়াদের দয়া হলো। তাকে আশ্রয় দিয়ে তার আদ্যোপান্ত জানতে চাইলো। তখন লোকটি তাদের কাছে যে কাহিনীটি বর্ণণা করলো তার সংক্ষিপ্তি রূপ এই- লোকটি বললঃ সেই অনেকদিন আগে আমরা তোমাদের মত একদল কাঠুরিয়া আলীর সুড়ঙ্গ সংলগ্ন স্থানে বাঁশ কাঠতে এসেছিলাম। একদিন সবাই গভীর অরণ্যে বাঁশ কাঠতে যাই। এ সময় আমি সঙ্গীদের থেকে একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই কোত্থেকে আদিম এক রূপসী কন্যা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। তার পরণে ছিল গাছের পত্রপল্লব। আমার সঙ্গী সাথীরা অনেক খোঁজাখুজির পর আমাকে না পেয়ে ব্যর্থ মনোরথে বাসায় ফিরে গেলো। তারা মনে করলো, আমি কোন হিং¯্র জীবজন্তুর শিকারে পরিণত হয়েছি। সঙ্গীদের খোঁজাখোঁজি আমি লক্ষ্য করলাম কিন্তু আওয়াজ করার মতো শক্তি তখন আমার ছিলনা। পরে ঐ রূপসী কন্যা আমাকে নিয়ে আলীর সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়লো! লোকটি আরো জানাল, আলীর পাহাড়ে সুড়ঙ্গ রয়েছে পর পর তিনটি। আমাকে নিয়ে ঐ রূপসী সুড়ঙ্গের তৃতীয়টিতে প্রবেশ করলো। সে থেকে আমি অন্ধকারে বন্ধি হলাম। আমার মনে হয় মহিলাটির উদ্দেশ্য ছিল আমাকে তার সঙ্গী করা। বাস্তবেও ঘটেছিল তাই। মাঝে মধ্যে ঐ রূপসী শ্বেতকায়ার বিশাল দেহী ইয়া লম্বা মহিলায় রূপ নিত। তার অবয়ব হয়ে যেত অদ্ভুত আকৃতির। তার পরণে থাকতো পশুর চামড়া। পাখির পলক ছাড়া কোন অলংকার ছিলনা। আগুনের ব্যবহার জানতো না। পশু পাখির গোশত ও ফলমুল খেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। ক্ষুধার জ্বালায় আমিও আস্তে আস্তে সে সব খেতে বাধ্য হলাম। মহিলাটি আমকে সুড়ঙ্গে রেখে গহীন অরণ্যে একাকী ঘুরে বেড়াতো। শিকারে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সে গুহা মুখে একটি বড় পাথর চাপা দিয়ে রাখতো। যাতে আমি সুড়ঙ্গ থেকে কোনমতে বের হতে না পারি। দিন যায়, মাস যায় এভাবে বছর পার হয়। ক্রমান্বয়ে মহিলাটি আমার সাথে ভাব জমাতে শুরু করে। সৌহার্দ্য সম্প্রীতি ও ভাবের আদান প্রদানের মাধ্যমে আমরা একে অপরের কাছাকাছি আসতে থাকি। কখন দিন রাত হয় গুহার মধ্য থেকে আমি কিছুই জানতে পারতাম না। তিমির সুড়ঙ্গের বন্দিজীবন আমার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠলো। লোকটি জানাল: মহিলাটি তার মানস কামনা চরিতার্থ করতে আমাকে কাছে টানতে থাকে। আমিও তার ভয়ে সবকিছু করতে বাধ্য হতাম। এক পর্যায়ে আমাদের অভিসারের ফলে মহিলাটির গর্ভে সন্তান আসে। যথারীতি মহিলাটি একটি ফুটফুটে সন্তান প্রসব করে। ডাইনিটি তখন মনে করলো আমি তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে গেছি। কিন্তু আদৌ তার প্রতি আমার আসক্তি ছিলনা। আমরা একে অপরের ভাষা বুঝতাম না। ইশারা ইঙ্গিতে আমাদের কথাবার্তা হতো। একদিন ডাইনি শিকারে যাওয়ার সময় গুহামুখে পাথর চাপা দিয়ে যায়নি। এতে করে বাহির থেকে সূর্যের আলোর ঝলকানি ছিদ্র পথে গুহার ভিতর প্রবেশ করে। তখন আমি এই সুযোগটি গ্রহণ করি এবং গুহা থেকে বেরিয়ে আসি। বাইরে এসে এই মায়াময় পৃথিবীর আকাশ, হৃদয় দোলানো বাতাস আমার অস্তিত্ব নতুনভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। প্রকৃতির কোলাহল মনকে দোলা দিতে থাকে। সুন্দর পৃথিবীর অতীত স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে উঠে। ডাইনীর কথা মনে পড়তেই আমি সেখান থেকে এইতো পালিয়ে তোমাদের সামনে এলাম! তাদের সেই পারস্পরিক আলাপচারিতার শেষ হতে না হতেই হঠাৎ ডাইনী মহিলা তার শিশুকে বুকে জড়িয়ে সেখানে উপস্থিত হয়। সকলে হতভম্ব ও দিকভ্রান্ত হলো। তখন ডাইনী রক্তচক্ষে পালিয়ে আসা লোকটির দিকে তীক্ষè দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তর্জন গর্জন করতে থাকে। সেখানে দাড়িয়ে ডাইনী অনেক্ষণ অরণ্যরোদন করলো। তার সেই কান্নায় বিরহের সুর ফুটে উঠে। একপর্যায়ে তার আচরণে হিং¯্রতা প্রকাশ পায়। তখন দুর্বোধ্য ভাষায় কুলের শিশুকে কি যেনো বলতো চাইলো। অত:পর বাচ্চাটির দু‘পা ধরে টান দিয়ে আকস্মিক দ্বিখন্ডিত করে ফেললো। এর এক খন্ড তার প্রণয়ী লোকটির প্রতি নিক্ষেপ করলো অপর খন্ড ডাইনী মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে গহীন অরণ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলো। সে হতে সভ্য জগতের কোন লোকচক্ষুর আড়ালে ডাইনিটি দৃশ্যমান হয়নি।