সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে অনেক আগেই আগ্রহ প্রকাশ করেছিল চীন। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং’র বৈঠকে এ বিষয়ে ইতিবাচক কোন সিদ্ধান্ত আসতে পারে, এমন প্রত্যাশা ছিল দেশবাসীর। যদিও শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে ফলপ্রসূ বহু আলোচনার ভিড়ে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রসঙ্গটি আড়ালেই থেকে গেল। তবে গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে বাংলাশে ও চীন সরকারের মধ্যে আলোচনা না হওয়ার বিষয়টি ওঠে এসেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। ‘চীনা প্রেসিডেন্টের সফরে কী পেল বাংলাদেশ’ শিরোনামে করা ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ‘চীন বাংলাদেশের উপকূলে গভীর সমুদ্রে একটি বন্দর নির্মাণেও আগ্রহী ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতের এ নিয়ে আপত্তি আছে। যার ফলে এই প্রকল্পটি নিয়ে কথা-বার্তা আর এগোয়নি বলেই মনে করা হয়’। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও ইউজিসি অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম দৈনিক আজাদীকে বলেন, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ নিয়ে সমাঝোতা স্মারক হওয়ার কথা ছিল ২০১৪ সালে। কিন্তু ভারতের সাথে চীনের ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণেই শেষ মুহূর্তে সেটি হয়নি। এখন সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর এজেন্ডায় নেই। তাই এবারের (১৪ অক্টোবর) সফরে গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে আলোচনার সম্ভাবনা ছিল না। আসলে ভারতকে ‘চটিয়ে’ বাংলাদেশ এমন কিছু (গভীর সমুদ্রবন্দর) করবে না। ভারতের সেন্টিমেন্টের বাইরে যাবে না বাংলাদেশ।’ এমন পরিস্থিতিতে সেনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরের ভবিষ্যৎ কি? এ প্রশ্নের উত্তরে ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘নতুন বা বিকল্প চিন্তা না হওয়া পর্যন্ত গভীর সমুদ্রবন্দরের আশা করা যায় না’। এর আগে গত ১৯ মার্চ নগরীর থিয়েটার ইন্সটিটিউটে অনুষ্ঠিত অর্থনীতি সমিতি চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের অনুষ্ঠানে এ অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, ‘সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর অদূর ভবিষ্যতে হবে না। এটা ভূ-রাজনৈতিক কারণে। ভারত চীনকে বঙ্গোপসাগরে আসতে দিতে চায় না। এতে ভারতের ভেটো (আপত্তি) রয়েছে। সেদিন তিনি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘চীনকে না দিন, গভীর সমুদ্র বন্দরের বিষয়ে অন্য অনেকের আগ্রহ আছে। হল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও আবুধাবি আগ্রহ দেখিয়েছে। তাদের প্রাধান্য দিন।’ এ প্রসঙ্গে ফোর্ট ইউজার্স ফোরাম ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘হয়তো গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে আলোচনা পরে হবে। গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে বহু ব্যাপারও জড়িত। তবে চীনের সঙ্গে গত শুক্রবার টানেলসহ যেসব বিষয়ে চুক্তি হয়েছে সেগুলোর বাস্তবায়ন যেন দ্রুত হয় সেদিকেই আমাদের জোর দিতে হবে এখন। এগুলোর ‘ফলোআপ’ করতে হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গভীর সমুদ্রবন্দরের অবশ্যই প্রয়োজন আছে। গভীর সমুদ্রবন্দর হোক, এ দাবি আমাদের থাকবে।
গভীর সমুদ্রবন্দরের সর্বশেষ অগ্রগতি : নৌ- মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছিল ২০০৯ সালে। কিন্তুু অর্থের অভাবে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ শুরু করতে পারছে না সরকার। জাপানি প্রতিষ্ঠান ‘প্যাসিফিক কনসালট্যান্ট ইন্টারন্যাশনাল কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়ায় এ গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সুপারিশ করেছিল। এর আগে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য চট্টগ্রামের পতেঙ্গা, কুতুবদিয়া, মহেশখালি, সোনাদিয়া, সন্দ্বীপ এবং খুলনাসহ দেশের আটটটি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছিল। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হিসেবে সোনাদিয়া চ্যানেলকে নির্ধারণ করে। এতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪২ হাজার কোটি টাকা। ২০৫৫ সালের মধ্যে তিন পর্যায়ে বন্দর নির্মাণের কাজ শেষ হবে বলে তখন আশা করা হয়েছিল। ২০১১ সালে শুরু হয়ে প্রথম ধাপের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালে। প্রথম ধাপে ১৬ হাজার কোটি টাকার কাজ হবার কথা ছিল। এরমধ্যে মহেশখালী দ্বীপের সাথে সড়ক যোগাযোগ ও রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা, নয়টি জেটি নির্মাণ, ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ, কন্টেনার ইয়ার্ড নির্মাণ, সিএফএস নির্মাণ ইত্যাদি করার কথা ছিল। যার কিছুই হয়নি এখনো।
উল্লেখ্য, জাপানের প্রতিষ্ঠানটির সাথে এশিয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেন্ট কর্পোরেশন অব থাইল্যান্ড, ডেক্সটোরিয়াস কনসালটেন্ট লিমিটেড অব বাংলাদেশ এবং জেপিজেড কনসালটেন্ট বিডি লিমিটেড নামের কোম্পানিও কাজ করেছিল। জাপানি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটির দেয়া গভীর সমুদ্রবন্দর সংক্রান্ত ফিজিবিলিটি স্টাডি করে বিস্তারিত রিপোর্ট দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে এই রিপোর্ট রিভিউ করে সরকারের গঠিত কমিটি।
এদিকে ২০১২ সালের ২৮ মার্চ নগরীর পলোগ্রাউন্ড মাঠে অনুষ্ঠিত ১৪ দলের সমাবেশে ‘গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ’র ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে দুদেশের মধ্যে সমাঝোতা স্মারক হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত হয়নি।
এদিকে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্টদূত মা মিং কিয়াং গত ২১ মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত কূটনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ‘ডিকাব’র এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘পায়রা কিংবা সোনাদিয়া, বাংলাদেশ যেখানে চাইবে সেখানেই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে সহযোগিতা দিতে আগ্রহী চীন। বঙ্গোপসাগরে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রক্রিয়ায় অন্য দেশকে যুক্ত করে (যৌথভাবে) এটি বাস্তবায়ন করতে চাইলেও চীন রাজি আছে। গত ১১ মে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্কর। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘বেশ কয়েকটি ভারতীয় কোম্পানি বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনে আগ্রহী। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটি কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন করা যেতে পারে।’
এছাড়া গত বছরের নভেবম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেদারল্যান্ডস সফরের সময় দেশটির প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। এর বাইরেও বিভিন্ন সময়ে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও আবুধাবি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ দেখিয়েছিল।
উল্লেখ্য, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে বন্দরটি ব্যবহার করে পরিবহন ব্যয় ১৫ শতাংশ কমে আসবে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্রে এ অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিণত হবে। জাপানি পরমর্শক প্রতিষ্ঠান ‘প্যাসিফিক কনসালট্যান্ট ইন্টারন্যাশনাল’ প্রতিবেদনে বলা হয়, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে আন্তর্জাতিক নৌপথগুলোর সংযোগ সাধন করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাবে। সুত্র.আজাদী