কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনে ঋণখেলাপির দায়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমদের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। নৌকাশূন্য মাঠে হাতঘড়ি প্রতীক নিয়ে ভোটারের দ্বারে দ্বারে ছুটছেন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। অচেনা ভোটের মাঠে তাঁর সঙ্গী হয়েছেন আওয়ামী লীগের জেলার নেতা-কর্মীরা। গত কয়েক দিন ধরে নির্বাচনী মাঠে সরব ইবরাহিম।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ‘অসৌজন্যমূলক’ বক্তৃতা দেওয়ার পর দল থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সংসদ জাফর আলম এখন কিছুটা নমনীয়। প্রচারণা, পথসভায় বক্তব্যে আগের মতো বিষোদ্গার করছেন না। তিনি স্থানীয় ইস্যু কাজে লাগিয়ে তাঁর প্রতীক ট্রাকে ভোট দিতে আহ্বান জানাচ্ছেন।
রবি ও সোমবার চকরিয়া-পেকুয়ার সরেজমিনে ঘুরে ভোটার, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিসহ জেলার শীর্ষ নেতারা এবং স্থানীয় কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ইবরাহিমের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিলেও চকরিয়া-পেকুয়া উপজেলা, মাতামুহুরী সাংগঠনিক উপজেলা ও চকরিয়া পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ দলের অনেকেই জাফর আলমের পক্ষে মাঠে নেমেছেন। তাতে আওয়ামী সমর্থক ভোটাররা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের ওই চারটি কমিটির সভাপতি-সম্পাদকেরা জাফর আলমের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এলাকায় তাঁদের প্রভাবও রয়েছে অনেক।
উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের তথ্যমতে, এ আসনের বর্তমান ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৩৮৩। এর মধ্যে চকরিয়ায় ৩ লাখ ৫১ হাজার ৫১৯ জন ও পেকুয়ায় ১ লাখ ৩২ হাজার ৮৬৪ জন। স্বাধীনতার পর থেকে এ আসনে আওয়ামী লীগ দুবার, জাতীয় পার্টি তিনবার, বিএনপি পাঁচবার ও জামায়াতে ইসলামী একবার জয়লাভ করে।
চকরিয়া-পেকুয়া উপজেলার ভোটারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপি অধ্যুষিত এ আসনে জাফর আলমকে ঠেকাতে হলে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমকে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপির ভোটও টানতে হবে। তা না হলে জয়লাভ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জাফর আলম।
আলোচনায় ইবরাহিম-জাফর
চকরিয়া-পেকুয়ার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ইবরাহিম ও জাফরকে নিয়ে ভোটারদের মধ্যে আলোচনা। এই দুই প্রার্থীর পোস্টারে ছেয়ে গেছে হাটবাজার, অলিগলি। গণসংযোগ-পথসভাতেও সরব এই দুই নেতা। গণসংযোগে অন্য প্রার্থীর তৎপরতা কম। তবে বিভিন্ন এলাকায় জাতীয় পার্টির প্রার্থী হোসনে আরার (লাঙ্গল) পক্ষে মাইকিং করতে দেখা গেছে।
কক্সবাজার-১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সাতজন প্রার্থী। অপর চার প্রার্থী হলেন ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী আবু মোহাম্মদ বশিরুল আলম (হাতুড়ি), ইসলামী ফ্রন্টের প্রার্থী মুহাম্মদ বেলাল উদ্দিন (মোমবাতি), স্বতন্ত্র প্রার্থী কমর উদ্দিন আরমান (কলার ছড়ি) ও তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী (ঈগল)।
২৩ ডিসেম্বর কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান ইবরাহিমকে দলের সমর্থন দেয়। এ প্রসঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কক্সবাজার-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নেই। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ও দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশনামতে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে।
কয়েক দিন আগে পেকুয়ার একটি পথসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ‘অসৌজন্যমূলক বক্তব্য’ দেওয়ার অভিযোগে চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে জাফর আলমকে সাময়িক অব্যাহতি দেয় জেলা আওয়ামী লীগ। সাত দিন সময়ের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব না দিলে জাফর আলমকে দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের জন্য কেন্দ্রে সুপারিশ পাঠানোর কথা জানান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী। চাঁদাবাজি, জমি দখলের বিচার চেয়ে গত শুক্রবার দুপুরে চকরিয়া পৌরসভায় জাফর আলমের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা।
গত শনিবার চকরিয়ার বদরখালী, দরবেশকাটা এলাকায় পথসভা করেন সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। ভোটারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘চকরিয়া-পেকুয়ার মানুষের সামনে দুটি পথ। একটি ভালো পথ, অন্যটি মন্দ পথ। আমাকে ভোট দেওয়া মানে ভালো পথকে বেছে নেওয়া।’
গত পাঁচ বছর চকরিয়া-পেকুয়ার মানুষ ভয়ভীতির মধ্যে ছিলেন জানিয়ে ইবরাহিম জাফর আলমকে উদ্দেশ্য করে বলেন, চকরিয়া-পেকুয়ায় নিরাপদে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে দখলবাজ ও চাঁদাবাজ চক্র থেকে মুক্ত থাকতে হলে হাতঘড়ি মার্কায় ভোট প্রদানের বিকল্প নেই।
ইবরাহিমের গণসংযোগ ও পথসভায় বক্তব্য দেন চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী, চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী, পেকুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম, বদরখালীর ইউপি চেয়ারম্যান নুরে হোছাইন আরিফ, মগনামা ইউপি চেয়ারম্যান ইউনুছ চৌধুরী প্রমুখ।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, ১০ ভাগের মধ্যে ৯ ভাগ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী হাতঘড়ি প্রতীকের জন্য নির্বাচনী প্রচারণায় যুক্ত হয়েছেন। অবশিষ্ট এক ভাগ শিগগিরই তাঁর প্রচারণায় যুক্ত হবে।
জাফরের পক্ষে স্থানীয় আওয়ামী লীগ
জাফর আলমও বসে নেই। তিনিও প্রতিদিন বিভিন্ন স্থানে গণসংযোগ ও পথসভা করছেন। গত রোববার বিকেলে চকরিয়ার হারবাং এলাকায় গণসংযোগ করেন জাফর আলম। শনিবার রাতে চকরিয়া পৌরসভার ভাঙারমুখসহ বিভিন্ন এলাকায়, শুক্রবার পেকুয়ার রাজাখালী ইউনিয়নের সবুজ বাজারে গণসংযোগ ও পথসভা করেন।
পথসভায় জাফর আলম বলেন, ‘আমি ভালো হলেও আপনাদের ছেলে, খারাপ হলেও আপনাদের ছেলে। আমি আপনাদের ঘরের ছেলে। আমি হাটহাজারী থেকে আসিনি। বিপদে-আপদে পাশে ছিলাম। আমার বিশ্বাস অধিকাংশ ভোট ট্রাক মার্কার পড়বে।’
চকরিয়ার একটি পথসভায় ইবরাহিমকে উদ্দেশ্য করে জাফর আলম বলেন, ‘যে ব্যক্তি (ইবরাহিম) এক মাস আগেও বঙ্গবন্ধুকে গালি দিয়েছেন, আওয়ামী লীগকে নিয়ে কটাক্ষ করেছেন, এখন তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থী বনে গেছেন। চিরিঙ্গা স্টেশনে নামিয়ে দিলে যিনি ( ইব্রাহিম) কোনাখালী চিনবেন না, যিনি ২৮ বছর আগে একবার পেকুয়ায় গিয়েছিলেন, যিনি ভোটার চেনেন না, এলাকা চেনেন না, কারও জানাজায় আসেননি; তাঁকে ভোট দিয়ে কী লাভ?’
জাফর আলমকে সমর্থনের বিষয়ে চকরিয়া পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী জাফর আলমের পক্ষে আমরা কাজ করছি শেখ হাসিনার নির্দেশনার আলোকে।’
মাতামুহুরী সাংগঠনিক উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও জাফর আলমের পক্ষে। তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ বলছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে ভোট করতে সমস্যা নেই। বিভিন্ন আসনেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা প্রচারণা চালাচ্ছেন। আমরা মানুষকে বার্তা দিচ্ছি ভোটকেন্দ্রে আসতে।’
চকরিয়া চিরিঙ্গা বাজারের ভোটার আজিজুর রহমান ও সালাহ উদ্দিন বলেন, দুই প্রার্থীর মধ্যে জমজমাট প্রচারণা চললেও যেকোনো মুহূর্তে সংঘর্ষ বেধে যেতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত মারামারি, হামলা ঘটেনি। চলছে কথার লড়াই। ভোটাররাও চান সুষ্ঠু নির্বাচন। সুত্র: প্রথম আলো
পাঠকের মতামত