বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেষা ২২.০৪ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ইউনিয়ন কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং। প্রায় ৫০ হাজার বাসিন্দার এই ইউনিয়নে নৌকা প্রতীক নিয়ে ১১ নভেম্বর ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত বিবর্তিত ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এস এম সৈয়দ আলম। স্বৈরাচারী সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের দলীয় চেয়ারম্যান হওয়ায় পর থেকে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন তিনি, তার সীমাহীন স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম-দুর্নীতিতে জিম্মি দশায় পড়ে অতিষ্ঠ সাধারণ নাগরিকরা। টাকা ছাড়া মেলেনা ইউনিয়ন পরিষদের নাগরিকসেবা, ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি প্রকল্প থেকে শুরু করে সবখানেই সমানতালে দুর্নীতির মহোৎসব সৃষ্টি করে যাচ্ছেন আলোচিত-বির্তকিত এই চেয়ারম্যান।
টাকা দিয়েও মিললো না মুজিববর্ষের ঘর- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে মুজিববর্ষ উদযাপনে দেশজুড়ে গৃহহীনদের ঘর ও জমি প্রদান করে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার। আশ্রয়ন প্রকল্প ২ এর আওতায় উখিয়া উপজেলা প্রশাসন বাস্তবায়িত এই উদ্যোগে উখিয়ার উপকারভোগীর সংখ্যা ৬৬৩ যার মধ্যে জালিয়াপালংয়ের বাসিন্দা ১৭৩ জন। ২০২৩ সালের মার্চে কার্যক্রমটির তৃতীয় পর্যায়ে জালিয়াপালং থেকে ৭৭ জন উপকারভোগী চূড়ান্ত করা হয়। ঐ সময় ঘর দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কমপক্ষে ১০৮ জনের কাছে মাথাপিছু ১৫ হাজার থেকে শুরু মাথাপিছু ৩০ হাজার পর্যন্ত প্রায় ২০ লক্ষ টাকা অনৈতিকভাবে আদায় করেছেন চেয়ারম্যান এসএম সৈয়দ আলম। বেশি টাকা প্রদান করা ৭৭ জন ঘর পেলেও বঞ্চিত থেকে গেছেন বাকিরা, যাদের একজন ৪নং ওয়ার্ডের ডেইল পাড়া বাসিন্দা নেজামুল করিম। পেশায় গাড়িচালক নেজামুল করিমের স্ত্রী মুঠোফোনে জানান, ‘৩০ হাজার টাকা দাবি করলে আমার স্বামী কষ্ট করে ১৫ হাজার টাকা জোগাড়ের পর চেয়ারম্যানের হাতে দিয়েছিলেন। টাকা কম হওয়ায় আমরা ঘর পাইনি আর এখন টাকা চাইতে গেলে উল্টো লাঞ্চিত ও মারধর করে চেয়ারম্যান তাড়িয়ে দেন।’ এ ছাড়াও স্থানীয় বাসিন্দা ইব্রাহীম, জব্বার, মোস্তাক সহ নিজের ডজনখানেক কথিত দালাল দিয়েও টাকা নিয়েছেন তিনি। সংরক্ষিত ইউপি সদস্য রুজিনার আক্তার স্বামী মোস্তাককে ১৯ হাজার টাকা দেন ৯নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আব্দুর রহিম। রহিমের দাবি, স্ত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকার অজুহাত দেখিয়ে ঘর দেয়া হয়নি তাকে এবং মোস্তাক টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। মুঠোফোনে মোস্তাক ১০ হাজার টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করে সে টাকা চেয়ারম্যানকে দিয়েছেন বলে জানান।
দুই হাজার জেলের ১২ মেট্টিক টন চাল আত্মসাৎ- মানবিক খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির অংশ হিসেবে জালিয়াপালং নিবন্ধিত ২০৭৫ জন জেলের জন্য ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে জনপ্রতি ৫৬ কেজি করে বরাদ্দ দেয়া হয় ১১৬ মেট্রিক টন চাল। বিশেষ ভিজিএফের আওতায় গত ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিনের জন্য সাগরে ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা থাকাকালীন জেলেদের মাঝে জালিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে চালগুলো বিতরণ কার্যক্রম সম্পন্ন করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ত্রাণ ও পুর্নবাসন শাখা। বিতরণের সময় বরাদ্দকৃত অংশ থেকে জনপ্রতি ৬ কেজি করে চাল না দিয়ে জালিয়াপালংয়ের প্রত্যেক জেলেদের হাত ধরিয়ে দেয়া হয় ৫০ কেজি ওজনের একটি চালের বস্তা। কৌশলে হাতিয়ে নেয়া এই চালের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১২ মেট্রিক টন, যার বাজার মূল্য আনুমানিক ৭ লক্ষ টাকা। মোহাম্মদ আইয়ুব নামে স্থানীয় এক জেলে বলেন, ‘আমরা যা পেয়েছি তা পরিবার সামলানোর জন্য খুবই নগণ্য। অথচ রামুতে থাকা আমার এক আত্মীয় জেলে জানিয়েছে তারা ৬ কেজি বেশি পেয়েছে। আমাদের রিযিক যারা লুট করেছে, আল্লাহ তাদের হেদায়েত দিক।’ ইউপি চেয়ারম্যান তার সহচরদের সহযোগিতায় চালগুলো সরিয়ে সোনারপাড়া বাজারের নিজের বিশ্বস্ত এক আড়তদার কে বিক্রি করে দিয়েছেন বলে নির্ভরযোগ্য এক সূত্রে জানা গেছে।
সামাজিক বিচারে দিতে হয় ঘুষ- মসজিদ কমিটির সমস্যা সমাধানের মতো সামাজিক বিচারে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ আছে উপজেলা আওয়ামী লীগের এই নেতার বিরুদ্ধে। মাস তিনেক আগে ২নং ওয়ার্ড’স্থ সোনাইছড়ি জামে মসজিদের তৈরি হয় ইমামতি নিয়ে জটিলতা। বিষয়টি মীমাংসার জন্য এলাকার দুই পক্ষ ও মসজিদ কমিটির সদস্যরা শরণাপন্ন হলে টাকা চান এস এম সৈয়দ আলম। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক মুসল্লী জানান, ‘চেয়ারম্যান কে আমাদের মসজিদের সমস্যার বিষয়ে বিচার দেয়া হলে তিনি সমাধানের জন্য ১০ হাজার টাকা নেন। টাকা নিয়েও কোনো ফল হয়নি এবং বিষয়টিও মীমাংসা হয়নি।’
ইউনিয়ন পরিষদের নয় যেন দলীয় কার্যালয়- আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী নৌকা প্রতীক নিয়ে এস এম ছৈয়দ আলম দিন দুপুরে প্রকাশ্যে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে পুরো ইউনিয়ন পরিষদকে দলীয় কার্যালয়ে পরিনত করে ফেলেছে। পরিষদের নাগরিক সুবিধা নিতে গেলে তিনি আওয়ামী লীগ করেন নাকি অন্য দল করেন তার জন্য ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার সাহাবউদ্দিনের জেরার সম্মুখীন হতে হয়। আওয়ামী লীগ ব্যাতিত অন্য দলের সমর্থক হলে তিনি বঞ্চিত হন তার প্রাপ্ত নাগরিক সেবা থেকে। মেম্বার সাহাবউদ্দিনকে ঘুষ বা অন্য কিছুর বিনিময়ে যদি ম্যানেজ করা যায় অথবা ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ করার অঙ্গীকার প্রদানের নাগরিক সেবা মিলে। চেয়ারম্যান এসএম সৈয়দ আলম মেম্বার শাহাবুদ্দিনের কথায় ওঠবস করে থাকেন। উল্লেখ্য বিগত সংসদ নির্বাচন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পুরো জালিয়া পালং ইউনিয়নের ভোট ডাকাতির ঘটনার মাস্টারমাইন্ড হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর দমনপীড়ন বাহিনীর বিশ্বস্ত সেনাপতি ছিলেন।
চেয়ারম্যানের অবৈধ টাকার লেনদেনের ক্যাশিয়ার যারা- ইউনিয়ন পরিষদ কেন্দ্রীক অবৈধ টাকা লেনদেনর ক্যাশিয়ারের ভূমিকায় রয়েছেন ৪নং ওয়ার্ডের মেম্বার আবুল কালাম ও চেয়ারম্যানের একান্ত ব্যক্তিগত সহকারী খ্যাত রাফিয়া আক্তার। স্থানীয় জনগনের সাথে সব ধরনের লেনদেন ও জন্ম নিবন্ধন এবং বিভিন্ন মেম্বারদের মাঝে অস্বাভাবিক ভাবে প্রকল্প বণ্টন করার বা প্রকল্প পেয়ে দেয়ার জন্য অবৈধ ঘুষের টাকা ও পারসেন্টিসের টাকা তারা ২ জনই লেনদেন করেন।
ইউপি সেক্রেটারীর বক্তব্য- ইউনিয়ন প্রশাসনিক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম কে তার পরিষদ সক্রান্ত এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি চট্টগ্রামে ছুটি কাটিয়ে অফিসে ফিরছেন বলে জানান এবং প্রতিবেদককে অফিসে দেখা করতে যেতে বলেন।
ইউএনওর বক্তব্য- উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর হোসেন বলেন, ‘জনপ্রতিনিধিরা যদি নাগরিকদের ভোগান্তিতে রাখেন তাহলে দেশের আইন ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় করণীয় পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ আছে। যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া যাবে।’
ইউপি চেয়ারম্যানের বক্তব্য- জালিয়া পালং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি চেয়ারম্যান এস এম সৈয়দ আলমের মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগ করা হলেও অন্যপ্রান্ত থেকে কোনো প্রকারের সাড়া মেলেনি
পাঠকের মতামত