সিটি করপোরেশন, পৌরসভার মতো দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার (সদস্য) ও সংরক্ষিত সদস্যদের অপসারণে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাজনীতিসহ দেশের বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছিল। একাধিক সূত্রের খবর, এ বিষয়ে উদ্যোগও নিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু হঠাৎ করেই সেই উদ্যোগ থেমে যায়। সূত্র বলছে, তাদের অপসারণ করে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ করা হবে, নাকি যেভাবে চলছে সেভাবেই রাখা হবে- এ নিয়ে দোটানায় রয়েছে সরকার। সারা দেশে ইউনিয়ন পরিষদগুলোয় ৬৯ হাজার ৪২৩ জন চেয়ারম্যান, মেম্বার ও সংরক্ষিত সদস্য রয়েছেন। এক সঙ্গে এত জনপ্রতিনিধিকে অপসারণ করে কীভাবে প্রশাসক নিয়োগ করা হবে, কীভাবে ইউনিয়ন পরিষদের সেবা কার্যক্রম চলমান থাকবে, এসব ভাবনা থেকেই চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি সরকার। এক্ষেত্রে সরকার এমন কোনো সিদ্ধান্তও নিতে চাইছে না, যা সরকার ও জনগণের জন্য হিতে-বিপরীত হয়ে দাঁড়াতে পারে।
Pause
Mute
Remaining Time -9:58
Close PlayerUnibots.com
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউনিয়ন পরিষদ পরিচালিত হয় চেয়ারম্যান, সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্যদের দ্বারা। কাজেই শুধু চেয়ারম্যানের পদে প্রশাসক বসালেও সাড়ে চার হাজার প্রশাসক প্রয়োজন। তা ছাড়া ওয়ার্ড পর্যায়ের কাজ করতেও লোকবল দরকার। তাই অপসারণের আগে সরকারকে এর ভালোমন্দ নিয়েও ভাবতে হবে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোরও চাপ রয়েছে চেয়ারম্যান, সদস্যদের অপসারণে। অন্যদিকে অপসারণ করা হলে সারাদেশের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্যরা আন্দোলন করতে পারেন, এমনকি আদালতের দারস্থও হতে পারেন। কারণ এসব জনপ্রতিনিধিদের যুক্তি- তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত। কলমের খোঁচায় অপসারণ করা হলে তারা কেন চুপ থাকবেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটিই এখন দেখার বিষয়। বর্তমান সরকারের অপসারণ ভাবনা ও হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারের
ভয়ে অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধি নিজ কার্যালয়ে যাচ্ছেন না। এলাকাতেও তাদের দেখা যাচ্ছে না। ফলে স্থানীয় নাগরিকরা ছেলেমেয়ের চারিত্রিক সনদপত্র, ওয়ারিশ সনদপত্র, জন্মসনদ, অবিবাহিত সনদপত্র, অসচ্ছল প্রত্যয়নপত্র, উত্তরাধিকার সনদপত্র, বৈবাহিক সনদপত্র, গ্রাম্য সালিশ-বিচার এবং জমি-জমার ভাগবাটোয়ারা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারছেন না। ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের অনুপস্থিতির কারণে উল্লিখিত সেবা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। দেশের অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের একটি বড় অংশই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে গেছেন। ফলে যেসব বিচার-সালিশ তারা করতেন সেগুলো প্রায় বন্ধ। এতে ছোটখাটো বিষয় নিয়েও গ্রামে গ্রামে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে সামনে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে পারে সরকার- এমন আশঙ্কাও করছেন বিশ্লেষকরা।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের পর ভেঙে পড়ে ইউনিয়ন পরিষদের সেবা কার্যক্রমও। ১৫ বছরেরও অধিক সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ইউনিয়ন পরিষদগুলোও দলের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায়। বিশেষ করে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করার পর সৌন্দর্য হারায় স্থানীয় সরকার শাসন ব্যবস্থা। আওয়ামী লীগের দলীয়করণে অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিল আওয়ামী লীগের সমর্থিত ও দলের মনোনীত চেয়ারম্যান। তাই দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সরব ছিলেন তারাও। সঙ্গত কারণেই হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গা-ঢাকা দিয়েছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বর ও সংরক্ষিত সদস্যরাও।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সারাদেশে ৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়নে একজন করে চেয়ারম্যান ছিলেন। এ ছাড়া ৪১ হাজার ১৩৯ জন সদস্য, ১৩ হাজার ৭১৩ জন সংরক্ষিত সদস্য ছিলেন। গত ৫ আগস্টের পর থেকে সারাদেশে ১ হাজার ৪১৬ জন ইউপি চেয়ারম্যান কার্যালয়ে অনুপস্থিত, যা মোট ইউনিয়ন পরিষদের এক-তৃতীয়াংশ। তাদের বেশির ভাগের নামে হত্যা মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে আছেন তারা। আবার কেউ কেউ নিজেদের ওপর হামলা হবে, এমন আশঙ্কা থেকে কার্যালয়ে যাচ্ছেন না।
এমন বাস্তবতায় সব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার-সংরক্ষিত সদস্যদের অপসারণ করার কথা ভাবছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে একসঙ্গে এত জনপ্রতিনিধি অপসারণ করে স্থানীয় সরকার প্রশাসন ব্যবস্থা পরিচালনা নিয়েও ভাবতে হচ্ছে সরকারকে। সব ইউনিয়ন পরিষদ থেকে চেয়ারম্যান অপসারণ করতে গেলে সাড়ে ৪ হাজার প্রশাসক দেওয়া দরকার। শুধু তাই নয়, প্রশাসকদের কাজে সহযোগিতার জন্য ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে একজন করে সরকারি প্রতিনিধি দরকার। সব মিলে প্রায় ৫৪ হাজার সরকারি কর্মকর্তা দরকার বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার প্রশাসন।
অন্যদিকে বিএনপি বলছে, আওয়ামী লীগের সময় ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে। নিজ দলের নেতাকর্মীদের দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ সাজিয়েছিল শেখ হাসিনা। তাই সব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের অপসারণ চায় বিএনপি। রাজনৈতিক দলের এমন চাপও সরকারকে চাপে ফেলেছে। তাই ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ নিয়ে উভয় সংকটে অন্তর্বর্তী সরকার।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের অপসারণ করা হবে কিনা, এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (ইউনিয়ন পরিষদ অধিশাখা) মোহাম্মদ ফজলে আজিম কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
তবে মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, তালিকা করা হয়েছে। এখন অপসারণ হবে কিনা, সেটা অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে। এত বড় একটি সিদ্ধান্ত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক ছাড়া করা সম্ভব নয় বলেও জানান অনেক কর্মকর্তা।
ইউপি চেয়ারম্যানদের অপসারণের বিপক্ষে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া ঠিক হবে না, বরং যেসব ইউপি চেয়ারম্যান অনুপস্থিত, সরকারের উচিত হবে প্রথমে তাদের নোটিশ দেওয়া। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাদের পরিষদে উপস্থিত হওয়ার সময় বেঁধে দেওয়া। এ সময়ে না এলে আসন শূন্য ঘোষণা করা। তারপর সদস্যদের মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
সরকারের অপসারণ ভাবনায় ক্ষুব্ধ বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের আহ্বায়ক ও কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুফতি আমজাদ হোসাইন আশরাফী আমাদের সময়কে বলেন, একমাত্র ইউনিয়ন পরিষদেই ফেয়ার ভোট হয়। আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। জনগণের রায়ে আমরা এসেছি। এখন একটা কলমের খোঁচায় অপসারণ করা হলে আমরা দেশের সংবিধান ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আইনগতভাবে লড়াই করব। তিনি বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করলে তৃণমূল পর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। চেইন-অব কমান্ড ভেঙে পড়বে। দেশে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ বেড়ে যাবে। সরকার যদি অপসারণ করতেই চায়, তাহলে আমরা অন্তত স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই। তারা যদি দেশের স্বার্থে করতে চান, আমরা তাদের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নেব। অন্যথায়, আমরাও আইনি পদক্ষেপ নেব। সুত্র, আমাদের সময়