ইসলাম ধর্মের চতুর্থ স্তম্ভ হজ। শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জীবনে একবার হজ সম্পাদন করা ফরজ বা আবশ্যিক। আরবি জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ হজের জন্য নির্ধরিত সময়। প্রতি বছর লাখ লাখ মুসল্লি বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে হজ পালনের জন্য মক্কায় জড়ো হন। চলমান মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে গত বছরের ন্যায় এবারো স্বল্প পরিসরে অনুষ্ঠিত হবে পবিত্র হজ। ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে হজের আনুষ্ঠানিকতাও।
হজের শাব্দিক অর্থ ‘জিয়ারতের সংকল্প’। আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার উদ্দেশ্যে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলমানরা পবিত্র কাবা তাওয়াফ বা জিয়ারতের সংকল্প নিয়ে ছুটে আসে বলেই এর নাম রাখা হয়েছে হজ। হজ ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি এবং অকাট্য একটি ফরজ ইবাদত। মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের এক মহামিলন অনুষ্ঠান। হজের এ বিধানটি বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। হজের রয়েছে একটি ইতিহাস, আছে তার তাৎপর্য ও শিক্ষা।
প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইবরাহিম (আ.) সর্বপ্রথম হজের প্রবর্তন করেন। এরপর থেকে নবী-রাসূল পরম্পরায় চলে আসছে হজ পালনের বিধান। হজরত মুহাম্মদ (সা.) সামর্থ্যবান মুসলমানদের ওপর হজ অবশ্যপালনীয় কর্তব্য বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআন শরীফের সুরা বাকারার ১২৫ নম্বর আয়াতে কাবাঘর নির্মাণ সম্পর্কিত বিষয় এভাবে ইরশাদ হয়েছে : ‘আর আমি যখন কাবাঘরকে মানুষের জন্য সম্মিলন ও নিরাপত্তার স্থান করলাম আর তোমরা ইবরাহিমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাজের জায়গা বানাও। আর আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম ঘরটিকে খুব পবিত্র রেখো তাওয়াফকারী ও অবস্থানকারী লোকদের জন্য এবং রুকু-সিজদাকারীদের জন্য।’
হজ প্রবর্তনের আগে হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে সঙ্গে নিয়ে পুনর্নির্মাণ করেন কাবাঘর। কাবাঘরটি হজরত আদম (আ.) ফেরেশতাদের সহায়তায় সর্বপ্রথম নির্মাণ করেন। হজরত ইবরাহিম জিবরাইল (আ.)-এর সাহায্যে একই ভিতে অর্থাৎ হজরত আদম (আ.) কর্তৃক নির্মিত কাবার স্থানে এর পুনর্নির্মাণ করেন। নির্মাণকাজ শেষ হলে ইবরাহিম (আ.)-এর প্রতি নির্দেশ হলো হজব্রত পালনের।
আল্লাহ তায়ালা হজরত জিবরাইল (আ.) মারফত তাকে হজের সব আহকাম সম্পর্কে অবহিত করেন। ইবরাহিম (আ.) তার পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে নিয়ে কাবাঘর সাতবার তাওয়াফ করেন, চুম্বন করেন হাজরে আসওয়াদ এবং একে একে সম্পন্ন করেন হজের সব আহকাম। এরপর আল্লাহর নির্দেশ এলো হজের দাওয়াত বিশ্ববাসীকে পৌঁছে দেওয়ার।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘যখন হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে হজ ফরজ হওয়ার কথা ঘোষণা করার আদেশ দেওয়া হয় তখন তিনি আল্লাহর কাছে আরজ করলেন, এটা তো জনমানবহীন প্রান্তর। এখানে ঘোষণা শোনার মতো কেউ নেই। যেখানে ঘনবসতি আছে সেখানে আমার আওয়াজ কীভাবে পৌঁছবে? আল্লাহ বললেন, তোমার দায়িত্ব শুধু ঘোষণা দেওয়া। সারা বিশ্বে পৌঁছানোর দায়িত্ব আমার। এ কথা শুনে হজরত ইবরাহিম (আ.) তখন মাকামে ইবরাহিমে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন। আল্লাহ তা উচ্চ করে দেন।’
কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, তিনি আবু কুবায়েস পাহাড়ে আরোহণ করে ঘোষণা দিয়েছিলেন। বর্ণিত আছে, ‘আল্লাহর ইবরাহিম (আ.)-এর সেই আহ্বান জড়জগতের সীমা অতিক্রম করে রুহানি জগতে গিয়ে পৌঁছেছিল এবং লাব্বাইক বলে যেসব রুহ সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল আল্লাহ চান তো কিয়ামত পর্যন্ত তারাই পর্যায়ক্রমে আরাফাতের প্রান্তরে সমবেত হবে!’ এভাবে মক্কা পরিণত হলো হজব্রত পালনের ক্ষেত্রস্থল হিসেবে।
হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে আল কোরআনে আরও ইরশাদ হচ্ছে, ‘এতে রয়েছে মাকামে ইবরাহিমের মতো প্রকৃষ্ট নিদর্শন। আর যে লোক এর ভেতরে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। আর এ ঘরের হজ করা হলো মানুষের ওপর আল্লাহর প্রাপ্য, যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। আর যারা অস্বীকার করবে (তাদের স্মরণ রাখা উচিত) আল্লাহ বিশ্ববাসীর মুখাপেক্ষী নন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ৯৭)
আবার একই বাণী প্রতিধ্বনিত হয়েছে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ভাষায়। সাহাবি আবু সাইদ (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের লক্ষ্য করে বললেন, আল্লাহ তোমাদের প্রতি হজ ফরজ করেছেন। সুতরাং তোমরা হজ কর।’ মুসলিম।
আরেক বর্ণনায় জানা যায়, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হজ করবে, হজ পালনকালে স্ত্রী-মিলন কিংবা সে সম্পর্কে আলোচনা এবং কোনো প্রকার গুনাহের কাজেও লিপ্ত না হয়, সে (হজ শেষে) সদ্যোজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ অবস্থায় ঘরে প্রত্যাবর্তন করবে।’