ডেস্ক রিপোর্ট - ইয়াবা সেবন নিয়ে ঝগড়ার এক পর্যায়ে স্কুলছাত্রী তাছনিম সুলতানা তুহিন (১৩)কে মুখ চেপে ধরে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে বখাটে প্রেমিক শাহনেওয়াজ সিরাজ মুন্না। হত্যার আগে খুনি মুন্না তুহিনের সাথে দৈহিক ভাবে মিলিত হয়েছিল।
সোমবার (১৭সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট এর আদালতের বিচারক কামরুন নাহার রুমীর খাস কামরায় দেয়া ১৬৪ ধারামতে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দিতে এসব কথা জানায় মুন্না।
মুন্নার জবানবন্দির উদ্বৃতি দিয়ে হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিন জাহাঙ্গীর সাংবাদিকদের কাছে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, খুন হওয়া তুহিনের সাথে অনুমান ১০ মাস ধরে মুন্নার প্রেমের সম্পর্ক চলে আসছিল। নিখোঁজের দিন ১৩ সেপ্টেম্বর বিকালে প্রেমিক মুন্না পৌর এলাকার শাহজালাল পাড়া সালাম ম্যানশন তার বাসা থেকে মিরেরহাট দাদার বাড়ীতে বেড়াতে যায়। পরদিন শুক্রবার (১৪ সেপ্টেম্বর) বিকাল অনুমান ৩টার দিকে সে তাদের ভাড়া বাসায় সালাম ম্যানশন চলে আসে। বিকাল ৫টা পর্যন্ত মুন্না তার ৪র্থ তলার বাসায় কয়েকজন বন্ধুসহ আড্ডা দেয়। সবাই মিলে ইয়াবা সেবন করে। সন্ধ্যার দিকে বন্ধুরা চলে যাওয়ার পর সে ভাড়া বাসায় তার কক্ষে ঘুমিয়ে পড়ে।
মাগরিবের পর তুহিন তাদের নীচ তলা বাসা থেকে চতুর্থ তলায় মুন্নাদের বাসায় যায়। এসময় মাদক সেবন নিয়ে তুহিনের সাথে মুন্নার ঝগড়া হয়। পরে মুন্না তুহিনকে বুঝিয়ে শান্ত করে। এবং দুজন দৈহিক মিলনে মিলিত হয়। দৈহিক মিলনের পর আবার তুহিনের সাথে মুন্নার ঝগড়া শুরু হয়। একপর্যায়ে মুন্না তার বাম হাত দিয়ে তুহিনের গলা পেঁচিয়ে ধরে ডান হাত দিয়ে নাক মুখ চেঁপে ধরে। এতে শ্বাসরোধ হয়ে তুহিন মারা যায়।
জবানবন্দিতে মুন্না আরো জানায়, তুহিনের মৃত্যু হয়েছে বুঝতে পেরে প্রথমে মুন্না ঘরের খাটের নীচে তুহিনের লাশ লুকিয়ে রাখে। পরে তুহিনের লাশ টেনে নিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফার নীচে লুকিয়ে রাখে।
আদালতে খাস কামরায় জবানবন্দি শেষে পুলিশ তাকে আদালতের নির্দেশে কারাগারে নিয়ে যায়।
এদিকে নিহত কিশোরী তুহিনের বড় ভাই আকিব জাবেদ বাদি হয়ে হাটহাজারী মডেল থানায় মুন্না ও তার পিতা ডাক্তার শাহজাহান সিরাজ ও মাতা নিগার সুলতানাকে আসামী করে সোমবার দুপুরে হত্যা মামলা (নং-২৫,তারিখ-১৭/০৯/২০১৮) দায়ের করে। এতে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০(সংশোধনী/০৩) এর ৭/৯(২)/৩০ তৎসহ দঃবিঃ ২০১ ধারা রুজু করা হয়।
এর আগে রবিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে হাটহাজারী পৌর এলাকার শাহজালাল পাড়া সালাম ম্যানশনের ৪র্থ তলার মুন্নার বাসা থেকে কিশোরী তুহিনের গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগেই তুহিনদের ভাড়াটিয়া কথিত প্রেমিক শাহনেওয়াজ সিরাজ মুন্নাকে অাটক করে পুলিশ।
জানাগেছে, খুনী মুন্না হাটহাজারী পৌর এলাকার চন্দ্রপুর বানু বাপের বাড়ির (শাহজাহান ডাক্তারের বাড়ি) ডাক্তার শাহজাহান সিরাজের পুত্র। সে সালাম ম্যানশনের ৪র্থ তলায় তার পিতামাতার সাথে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করতো। তুহিন গড়দুয়ারা ইউনিয়নের নিয়ামত আলী সারাং বাড়ির মো. আবু তৈয়ব ও ফিরোজা বেগমের কন্যা। তবে পরিবারসহ শাহজালাল পাড়ার তাদের মালিকানাধীন সালাম ম্যানশনের ৪র্থ তলায় তারা বসবাস করে আসছিল।
উল্লেখ্য নিহত তুহিনের পরিবারের দাবী গত ১৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় প্রাইভেট শিক্ষক তুহিনকে পড়াতে আসেন। এসময় ভবনের নিচ তলা থেকে ২য় তলায় পড়তে যাওয়ার কথা থাকলেও সে যায়নি। পরে অনেক খোঁজাখুজি করে তাকে পাওয়া না যাওয়ায় হাটহাজারী মডেল থানায় নিখোঁজ ডায়েরী করা হয়।
এদিকে তুহিন খুনের ঘটনার পর খুনি মুন্নার ফাঁসির দাবীতে হাটহাজারী সদর উত্তাল হয়ে উঠেছে।
সোমবার বেলা ১১টার দিকে খুনীদের ফাঁসির দাবিতে তুহিনের নিজের স্কুল হাটহাজারী গার্লস হাই স্কুল এন্ড কলেজ, হাটহাজারী পার্বতী সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়, হাটহাজারী সরকারি কলেজ, হাটহাজারী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অন্তত ৩ হাজার শিক্ষার্থী হাটহাজারী উপজেলা পরিষদের সম্মুখে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি মহাসড়কে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে।
এদের সাথে সদরের বেশ কয়েকটি সংগঠনও যোগ দেয়। এসময় প্রায় একঘন্টা যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া ময়নাতদন্ত শেষে সোমবার বিকালে হাজারো মুসল্লীর অংশগ্রহণে জানাযা নামাজের পর তুহিনের লাশ উপজেলার গড়দুয়ারা ইউনিয়নের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
.
পুলিশ ও তুহিনের পরিবার সূত্রে জানা যায়, তুহিনের পিতামাতা বর্তমানে হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে সৌদিআরব অবস্থান করছেন। সে কারণে তুহিন সালমা ম্যানশনস্থ নানার বাড়ীতে অবস্থান করছিল। শুক্রবার মাগরিবের নামাজ শেষে বাসার নিচ তলার ফ্ল্যাট থেকে ২য় তলায় শিক্ষকের কাছে পড়তে যায়। কিন্তু এরপর থেকে তাকে আর পাওয়া যায়নি।
তুহিন নিখোঁজ হওয়ার পর ভাড়াটিয়া যুবক মুন্নার আচরণ সন্দেহজনক হওয়ায় তাকে সবাই জিজ্ঞাসাবাদ করলেও সে কিছু জানে না বলে জানায়। পরে তুহিনের ভাই ও মামারা মুন্নাকেআটক করে থানা পুলিশে সোপর্দ করে।
৬ তলা ভবনের সর্বত্র তুহিনকে খোঁজা হলেও সেদিন তার কোন সন্ধান পায়নি স্বজনরা। ভবনের বাইরে সম্ভাব্য সবস্থানে কোন সন্ধান না পাওয়ায় পরিবারের পক্ষ থেকে শনিবার থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি রুজু করা হয়।
অপরদিকে মুন্নার কাছ থেকে কোন তথ্য না পাওয়ায় তাকে তার পিতামাতার জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়।
খুনী মুন্না নিজেও পুলিশের সাথে তুহিনকে খোঁজার ভান করে।
সর্বশেষ রবিবার সন্ধ্যায় হঠাৎ ভবনের ৪র্থ তলা থেকে পঁচা দৃর্গন্ধ বের হলে মুন্নার পিতামাতা ও সে দ্রুত ঘর থেকে পালিয়ে যায়।
পরে কৌশলে মুন্নাকে ডেকে নিয়ে থানা আটক করে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে পুলিশের জেরার মুখে সে খুনের কথা স্বীকার করে এবং তার দেওয়া তথ্যানুযায়ী সালাম ম্যানসনের ৪র্থ তলার ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ড্রয়িং রুমের সোফার নিচ থেকে প্লাস্টিকের বস্তা মোড়ানো তুহিনের লাশ উদ্ধার করা হয়।