এক সময়ের সেলুন কর্মচারী স্বপন শর্মা রণি,এখন কয়েক’শ কোটি কালো টাকাসহ অঢেল সম্পত্তির মালিক। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি সদস্যের ক্ষমতার অস্বাভাবিক দাপটে ও দোদর্ন্ড প্রতাবে বিত্ত বৈভবের পাহাড় গড়েন। কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা উখিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে এই মূহুর্তে সবচেয়ে বিতর্কিত মূর্তিমান চরিত্র। অন্তরালে এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন ক্ষমতার প্রভাব।
জানা যায়, রাষ্ট্রের ক্ষমতা থেকে পতিত হওয়া আওয়ামীলীগের অঙ্গ সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি গত দেড় যুগ ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। সাবেক সাংসদ ইয়াবা বদির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন বলেও পরিচিত। মূলত তার আশ্রয় পশ্রয়েই স্বপন শর্মা রনি এলাকায় মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে গড়ে ওঠেন। আওয়ামী লীগের আমলে ভোট ডাকাতি সহ নানা কারণে বিতর্কিত নির্বাচনে জনবহুল হলদিয়াপালং ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়া স্বপন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান পদ ও ভাগিয়ে নেন স্বঘোষিত ভোট ডাকাত চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস চৌধুরীর সহযোগিতায়।
ইউনিয়নটির বর্তমান চেয়ারম্যান ও যুবলীগ নেতা এস এম ইমরুল কায়েস চৌধুরী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন ছাত্র-জনতার উপর হামলার ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন বলে ছাত্র প্রতিনিধিরা অভিযোগ করেন। এবং ছাত্র জনতার উপর হামলার দায়ে তার বিরুদ্ধে ২ টি মামলাও কক্সবাজার সদর থানায় চলমান রয়েছে। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে কিছু দিন দেখা মিললেও মামলার আসামী হয়ে বর্তমানে পলাতক, উপজেলা নির্বাচনে ভোট ডাকাতির প্রকাশ্যে স্বীকারোক্তি দিয়ে বক্তব্য দিয়ে দেশব্যাপী ভাইরাল হওয়া আওয়ামী যুবলীগের দুর্ধর্ষ এই ক্যাডার। অথচ ইমরুলের অসুস্থতার মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়ে অত্যন্ত সুকৌশলে হলদিয়াপালং ইউনিয়নে এক প্রকার স্বৈরশাসন জারি রেখেছেন তারই অনুচর সমস্ত অপকর্মের মদদদাতা স্বপন শর্মা রণি। রণি বিরুদ্ধে মূলত ইমরুলের যাবতীয় লুটপাট ও অপকর্মের সহযোগী হিসেবে চোরাকারবারি থেকে শুরু করে সাধারণ বাসিন্দাদের নির্যাতন-নিপীড়ন সহ অভিযোগের অন্ত নেই।
ক্ষমতার অপব্যবহার করে গডফাদার ইমরুল সহ তিনি গড়েছেন বিপুল পরিমাণের অবৈধ অর্থ-বিত্ত, একসময়ের নরসুন্দর (নাপিত) স্বপন এখন চড়েন নিজস্ব প্রাইভেট দামী গাড়িতে এবং থাকেন বিলাসবহুল বাড়িতে। ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা মানবিক বিপর্যয়ের পর উখিয়ায় আশ্রয় নেয় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাস করা দুই শতাধিক হিন্দু পরিবার। বিগত প্রায় এক মাস ধরে চালানো অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বপন সহযোগিতার নামে সেসময় লুট করেন অসহায় মানুষগুলোর বিপুল পরিমাণের স্বর্ণালংকার, অর্থ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে, কুতুপালং হিন্দু ক্যাম্পে আশ্রিত এক যুবক বলেন, ” স্বপন দা এখানকার প্রভাবশালী হিন্দু নেতা, আমাদের আশ্রয় ও সাহায্য দেবার নাম করে আমাদের কাছে থাকা শেষ সম্বল স্বর্ণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। আমার স্ত্রীর তিন টিকেল (ভরি) স্বর্ণ তাকে সেসময় দিতে হয়েছিলো, জীবন বাচাতে বাধ্য হয়ে দিয়েছি।”তার মত এরকম প্রায় ১০০ হিন্দু শরণার্থী পরিবার আনুমানিক দেড়শ ভরি স্বর্ণালংকার নগদ ৫০ লাখ টাকার মত স্বপনের কাছে গচ্ছিত রাখে পরে সে এগুলো উক্ত পরিবারগুলোর কাছে ফেরত না দিয়ে আত্মসাৎ করে।
অনেকে পরবর্তীতে ফেরত চাইলে তাদেরকে মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় ফলে অসহায় নির্যাতিত হিন্দু শরণার্থী পরিবারগুলো নিরবে মুখ বুঝে সয়ে যায় বলে নাম প্রকাশ না করে শর্তে কয়েকজন মাঝি এ তথ্য গুলো জানিয়েছেন। এসব স্বর্ণালংকার ও নগদ অর্থ পেয়ে স্বপন শর্মা রনি রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যায়। তার লোলুপদৃষ্টি এখানেই শেষ নয় এই হিন্দু শরণার্থীদের পুঁজি করে তাদের মানবিক সহায়তার নামে উখিয়া উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের ব্যানারে সংগঠনের সভাপতি হওয়ার সুবাদে দেশে এবং দেশের বাইরের সনাতনী সম্প্রদায়ের বিত্তশালী বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা তহবিল সংগ্রহ করে লোক দেখানো নামমাত্র কিছু অর্থ হিন্দু রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রান বাবদ খরচ করে সিংহভাগ অর্থ আত্মসাৎ করে মর্মে এরকম একাধিক অভিযোগ রয়েছে।
তখনকার সময়ে তার এবং পরিবারের বিভিন্ন ব্যাংক একাউন্ট ও বিকাশ নম্বর খতিয়ে দেখলে থলের বেড়াল বেরিয়ে আসবে। এছাড়াও হিন্দু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দেওয়া লক্ষ লক্ষ টাকার এান সামগ্রী তাদের বিতরণ না করে বাইরে বিক্রি করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এনিয়ে পূজা উদযাপন পরিষদের অনান্য নেতৃবৃন্দ তাকে চরম হেনস্তা ও লাঞ্ছিত করে। হিন্দু রোহিঙ্গাদের দেখভাল করার দায়িত্ব পালনের সুযোগে দেশি বিদেশি কিছু এনজিও সংস্থার কতিপয় কর্মকর্তার সাথে সম্পর্ক করে তোলে পরবর্তীতে সেটাকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতিবাজ এনজিও কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ক্রমে আত্মসাত কৃত বিশাল অংকের অবৈধ অর্থ কে বৈধ করতে ঠিকাদারী ব্যবসায় যুক্ত হন। বিগত ৪/৫ বছরে দেশি বিদেশি বিভিন্ন এনজিও সংস্থার কর্মকর্তাদের সাথে আতাঁতের মাধ্যমে বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মালামাল সরবরাহ ও শেডসহ নানা অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ কাজের ঠিকাদারি ব্যবসায় চরম অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয়ে কোটি কোটি টাকা ও সম্পদের পাহাড় গড়েন।
বিগত পতিত সরকারের সময়ে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং হলদিয়া পালং ইউপির টানা ৩ বারের ভোট ডাকাতির নীল নকশার মাধ্যমে সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় এবং উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের ক্ষমতার দাপটে হলদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের পলাতক চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস চৌধুরীর যোগ সাজস ক্রমে ২০২১, ২০২২, ২০২৩, ২০২৪ অর্থ বছরে ইউনিয়ন পরিষদের বার্ষিক উন্নয়ন তহবিলের(এডিপি) আওতায় ১০০ টি ভূয়া নামমাত্র প্রকল্পের শুধু কাগজে পত্রে ঠিক রেখে ৫ কোটি হাতিয়ে নেয়। কাগজপত্র খতিয়ে দেখলে এসব প্রকল্পের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ ছাড়া পরিষদের ১% এর বরাদ্দকৃত প্রকল্পের নামেও চলেছে হরিলুট।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ঠিকাদারি ব্যবসায় জড়িত হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তুু স্বপন শর্মা রনি তার ছেলের নামে সহ দুটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সে এলজিইডি, জেলা পরিষদ এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন এনজিওতে তার কালো টাকা সাদা করতে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে ও এনজিও তে বর্তমানে ৫০ কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা যায়। এছাড়াও তার মালিকানাধীন পার্বত্য এলাকার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুমে একটি ব্রিক ফিল্ড,কক্সবাজারের কলাতলীতে ৩টি বহুতল ভবন, শশুর বাড়ি মহেশখালীতে তার ও আত্মীয়-স্বজনের নামে প্রায় ১০ একর সম্পত্তি ও লবণের মাঠ রয়েছে। এসব সম্পত্তিতে প্রায় দেড়শ কোটি টাকার মত ইনভেস্ট রয়েছে বলে পাওয়া তথ্য থেকে উঠে আসে।
সব মিলিয়ে সে প্রায় শত কোটি টাকার মালিক। অথচ ২০০৭-২০০৮ সালের দিকে কক্সবাজারে লালদীঘির পাড়ের বাবুল সেলুনের কর্মচারী হিসেবে সেলুনের কাজ করতো। মূলত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিপুল অংকের স্বর্ণালংকার ও অর্থ আত্মসাৎের মাধ্যমে তার উত্থান ঘটে। তার বাবা ছিল একজন কবিয়াল ও সেলুন দোকানী।পারিবারিকভাবে তাদের তেমন কোন স্ব সম্পত্তি ছিল না। বিগত ছয়-সাত বছর পূর্বে তার হঠাৎ উত্থান দেখে এলাকাবাসী ও বিস্মিত। এলাকায় তার একটি সন্ত্রাসী বাহিনীর কারণে গ্রামবাসীরা ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। অপরদিকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর পাওয়া যায় বিগত ৫ই আগস্টের পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে মামলা হামলা থেকে রেহায় পেতে এবং নিজেকে নিরাপদ থাকতে কক্সবাজার ও উখিয়ার প্রশাসন থেকে শুরু করে ক্ষমতাধর বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গাড়ী সহ প্রায় কোটি টাকার মতো অর্থ ব্যয় করেন। ফলে এখনো সে বহালতবিয়তে নিরাপদে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে।
সংখ্যালঘুদের নেতার বেশে স্থানীয় হিন্দু সাম্প্রদায়কে একপ্রকার জিম্মি করে রেখেছেন স্বপন। উখিয়ায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজমান থাকলেও গুজব ছড়িয়ে ভয়ভীতি দেখানোর মাধ্যমে ৫ আগস্টের পরপর তার নিজ এলাকার পরিবেশ অশান্ত করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন তিনি, যা ছিলো সর্বেভৈই চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস চৌধুরী ও কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির পরিকল্পনায়। বিগত দিনগুলোর মতোই এখনো বীরদর্পে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন স্বপন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ভিডব্লিউবির কার্ড বিক্রি,বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে জনরোশ সৃষ্টি হয় মত নাগরিক সেবায় ব্যাঘাত ঘটানো সহ তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা রহিমা খাতুন (ছদ্মনাম) কে ভিডব্লিউবি উপকারভোগী হিসেবে দালাল মারফত ৫ হাজার টাকা ঘুষের অনুরোধ পাঠিয়েছেন তিনি। রহিমা জানান, ” আমাকে চেয়ারম্যান এর নামে ৫ হাজার টাকা দিতে বলেছে কার্ড এর জন্য।এতো টাকা কই পাবো? টাকা থাকলে তো আর এই সুবিধা চাইতাম না।”তদন্ত করলে ইতিমধ্যে এরকম অসংখ্য অভিযোগের হদিন মিলবে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সামনের সারিতে প্রতিনিধিত্ব করা সাগর নামে এক স্থানীয় কলেজ ছাত্র জানান, ” আমার ভাইয়েরা আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছে অপশাসন, দুর্নীতি থেকে আমাদের মুক্ত করতে। অথচ এখনো আমার নিজের ইউনিয়নেই স্বৈরাচারের এক পদলেহনকারী অভিভাবকের পবিত্র চেয়ার কে কলুষিত করছে, যা অত্যন্ত লজ্জাজনক “বটে।
উপজেলা বিএনপির সভাপতি সরোয়ার জাহান চৌধুরী বলেন, ” বিএনপি ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্বরত পতিত আওয়ামী লীগের বর্তমান পদধারীদের অপসারণ এর দাবী জানিয়েছিলো কেন্দ্রীয়ভাবে। আওয়ামীলীগের ধান্দাবাজরা এখনো চেয়ার ধরে আছে কিভাবে? দ্রুত এদের চিহ্নিত করে অপসারণ করা হউক।” উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর হোসেন বলেন, ” ইউপি চেয়ারম্যান এর বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের উপর নির্ভরশীল। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হবে।” এসব অভিযোগ সম্পর্কে স্বপন শর্মা রণির কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া এবং বক্তব্য জানতে তার ব্যবহৃত মুঠোফোনে বারবার কল করা হলেও সাড়া মেলেনি