আব্দুল কুদ্দুস,কক্সবাজার
কক্সবাজারে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার বাম্পার ফলন হয়েছে সুপারির। ভালো দামও পাচ্ছেন চাষিরা। আকারে বড় আকার হওয়ায় সারা দেশেই কদর রয়েছে কক্সবাজারের এসব সুপারির।
কক্সবাজারের সবচেয়ে বেশি সুপারি উৎপাদন হয় উখিয়া উপজেলার সোনারপাড়া এবং টেকনাফের সাবরাং এলাকায়। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এসব সুপারি বিভিন্ন দেশেও রপ্তানি হয়। এসব এলাকার এক হাটেই অন্তত ৮০ লাখ টাকার সুপারি বিক্রি হচ্ছে।
চাষিরা জানান, পাঁচ বছর আগেও প্রতিটি কাঁচা সুপারি বেচাবিক্রি হতো ২ থেকে ৩ টাকায়। এখন ৬ থেকে ৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে অতিথি আপ্যায়নে পানের খিলির ঐতিহ্য রয়েছে। বিয়েশাদিসহ সামাজিক অনুষ্ঠানে রাখা হয় পানের বাটা। পানের সঙ্গে সুপারি মিশিয়ে তৈরি হয় পানের খিলি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলার উখিয়া, টেকনাফ, রামু, কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, চকরিয়া, পেকুয়া উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় ৮ হাজার ৬৪৫ একর জমিতে সুপারি বাগান রয়েছে। কৃষি বিভাগ কাঁচা সুপারির পরিবর্তে শুকনা সুপারির হিসাব রাখে। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে ৮ হাজার ৬৪৫ একরে শুকনা সুপারি উৎপাদিত হবে ১২ হাজার ৯৬৭ মেট্রিক টন। প্রতি কেজি শুকনা সুপারির দাম ৩০০ টাকা ধরলে ১২ হাজার ৯৬৭ মেট্রিক টনের দাম পড়ে ৩৯০ কোটি টাকা। পাঁচ কেজি কাঁচা সুপারি থেকে পাওয়া যায় এক কেজি শুকনা সুপারি। তবে চাষিরা জানান, প্রতি একরে কাঁচা সুপারি উৎপাদিত হচ্ছে ১৮ দশমিক ৫ মেট্রিক টন। তাঁদের হিসাবে ৮ হাজার ৬৪৫ একরে সুপারি উৎপাদন হবে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন, যার বাজারমূল্য প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।
উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের ইনানী উপকূলের গ্রামগুলো সুপারি বাগানে ভরপুর। সম্প্রতি এলাকাটিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি গাছে সুপারি ঝুলে রয়েছে। গ্রামের চাষি আবদুল মোতালেবের (৫৫) বাড়ির চারপাশে সুপারিগাছ আছে ৪৩০টি। প্রতিটি গাছে ৫০-২০০টি সুপারি ধরেছে। আবদুল মোতালেব বলেন, অক্টোবর মাস থেকে গাছের সুপারি পাকতে শুরু করেছে। বেচাবিক্রিও তখন থেকে শুরু। ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত গত দুই মাসে তিনি চার লাখ টাকার সুপারি বিক্রি করেছেন। গাছে আরও চার-পাঁচ লাখ টাকার সুপারি আছে। সব মিলিয়ে তিনি এবার ৯ লাখ টাকার সুপারি বিক্রি করার আশা করছেন। গত বছর বাগানের সুপারি বিক্রি করে সাত লাখ টাকা পেয়েছিলেন বলে জানান তিনি।
ইনানীর পাশে সোনারপাড়া গ্রাম। এই গ্রামের ঘরে ঘরেও সুপারি বাগান চোখে পড়ে। গাছের সুপারি ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক (টমটম) এবং জিপ গাড়িতে বোঝাই করে বিক্রির জন্য আনা হয় সোনারপাড়া বাজারে। সপ্তাহের প্রতি রোববার ও বুধবার দুই দিন সুপারির বড় বাজার বসে। প্রতি হাটে অন্তত ৮০-৯০ লাখ টাকার সুপারি বিক্রি হয়। বেশির ভাগ সুপারি সরবরাহ হয় কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, বগুড়া, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, নোয়াখালী, ফেনীসহ বিভিন্ন জেলাতে।
গত রোববার দুপুরে সোনারপাড়া বাজারে গিয়ে দেখা যায় লাল সুপারিতে ভরপুর বাজার। প্রতি পণ (৮০টি) সুপারি বিক্রি হচ্ছে ৩৫০-৪৫০ টাকায়। সোনারপাড়ার চাষি মো. আলমগীর (৪৫) বলেন, সকাল সাতটা থেকে সুপারি বিক্রি শুরু হয়। দুপুর ১২টা পর্যন্ত তিনি ৭ লাখ টাকার সুপারি বিক্রি করেছেন। গত বছর প্রতি পণ সুপারি বিক্রি করেন ২৮০-৩৮০ টাকায়। এবার ১০০-১৫০ টাকা বেশি পাচ্ছেন। তিনি বলেন, সোনারপাড়ার সুপারি আকারে বড়, স্বাদেও মজা। এই সুপারি ঢাকা ও রাজশাহী অঞ্চলে ৭-৮ টাকায় বেচাবিক্রি হয়।
সুপারি কিনতে আসা ঢাকার ব্যবসায়ী সাব্বির আহমদ (৫৫) বলেন, সোনারপাড়ার সুপারির ভেতরে কষ কম থাকে, আকারেও বড়। ১০-১৫টি সুপারিতে এক কেজি ওজন হয়। বড় আকারের সুপারি বিদেশে রপ্তানি হয়। উখিয়া হলদিয়া পালং ইউপি চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, উপজেলার হলদিয়া পালং, জালিয়াপালং, ইনানী, সোনারপাড়া, রুমখা, মরিচ্যা, চেপটখালীসহ অন্তত ১২-১৫টি গ্রামে সুপারির চাষ হচ্ছে। চলতি মৌসুমে অন্তত ৫৫ কোটি টাকার সুপারি বিক্রি হবে।
সোনারপাড়ার পাশাপাশি মরিচ্যা, কোটবাজারেও সুপারি বেচাবিক্রি করতে দেখা যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, এবার সুপারির দাম ভালো পাওয়ায় অনেকে নতুন করে সুপারির বাগান করছেন।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে টেকনাফ মডেল থানার সামনের বাজারে গিয়ে দেখা যায় সুপারি বিক্রির ধুম। উপজেলার সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, নয়াপাড়া, মুন্ডারডেইল, আছারবনিয়া, হোয়াইক্যং, বাহারছড়া, শামলাপুর, জাহাজপুরা, বড় ডেইল গ্রামের অন্তত ১৩টি বাজারেও একই চিত্র। এসব বাজারে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার সুপারি বিক্রি হচ্ছে।
সাবরাং আছারবনিয়া গ্রামের চাষি ফজলুল হক (৬৫) বলেন, সাবরাং ইউনিয়নের অন্তত ৪০০ পরিবারে সুপারি বাগান রয়েছে। ৯০ ভাগ পরিবার সুপারি বিক্রির আয়ের ওপর নির্ভরশীল। প্রতি সপ্তাহে এসব গ্রাম থেকে ২০-২৫ ট্রাক সুপারি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলেন, টেকনাফ, রামু, ঈদগাঁও, চকরিয়ার অন্তত ২৩টি বাজার থেকে শতাধিক ব্যবসায়ী সুপারি কেনেন। সপ্তাহে গড়ে ২২৫ ট্রাক সুপারি দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করছেন। আগামী জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সুপারির বেচাবিক্রি চলবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আশীষ কুমার বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার সুপারির বাম্পার ফলন হয়েছে। সুপারির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও বেশি পাওয়া যাচ্ছে, তা ছাড়া ভারত ও মিয়ানমার থেকে সুপারি পাচার বন্ধ থাকায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত চাষিরা লাভবান হচ্ছেন। তিনি বলেন, সারা বছর গাছে সুপারি ধরলেও সুপারি উৎপাদনের ভর মৌসুম ধরা হয় সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাস। শুকনা সুপারির চেয়ে কাঁচা সুপারি বেচাবিক্রিতে চাষিরা বেশি লাভবান হন। সুত্র : প্রথম আলো