খোলা বাজারের তুলনায় সুপারশপে পণ্যের মূল্য পার্থক্য থাকায় তার দায় উৎপাদকদের। সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) নির্ধারণে সুপারশপের কোনও হাত নেই। সেটি উৎপাদকরাই নির্ধারণ করেন। তাই এমআরপি নির্ধারণে সুপারশপের হাত আছে, এমন তথ্য বিভ্রান্তিকর বলে মনে করেন সুপারশপের প্রতিনিধিরা। এছাড়া সরকার নির্ধারিত সব ধরনের কমপ্লায়েন্স (সরকারি নিয়ম) মেনেই ব্যবসা করেন তারা, যা খোলা বাজারের দোকানের ক্ষেত্রে নেই।
মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর উৎপাদনকারী/সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও সুপারশপের প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্যাকেটজাত নিত্যপণ্যের (চাল, ডাল, আটা, ময়দা, চিনি, ডাল, লবণ ইত্যাদি) মূল্যের বিষয়ে মতবিনিময় সভায় এসব কথা জানান তারা। সংস্থার মহাপরিচালক মো. শফিকুজ্জামানের সভাপতিত্বে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সভাকক্ষে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় ভোক্তার মহাপরিচালক প্যাকেটজাত পণ্যের দামের পার্থক্য সম্পর্কে জানতে চাইলে এসিআই লজিস্টিকসের (স্বপ্ন সুপারশপ) হেড অব সাপ্লাই চেইন তমাল পাল বলেন, ‘উৎপাদকরা আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কথা আমাদের জানিয়েছেন। আমরা পুষ্টি সয়াবিন তেলে ৩৫ টাকা ছাড়ে বিক্রি করেছি, যা কোনও কাঁচাবাজারে পাবেন না। আমরা লবণ ৭ টাকা কম দামে বিক্রি করেছি, সেটাও কাঁচাবাজারে ২-৩ টাকা কমে কোথাও কোথাও পেতে পারেন। আমরা এসিআই ফেশ ব্র্যান্ডের আটা-ময়দা ১০ টাকা ছাড়ে বিক্রি করেছি, সেটাও কাঁচাবাজারে ২-৫ টাকা কমে পেতে পারেন। আমরা ইস্পাহানি চা বিক্রি করেছি ২০ টাকা ছাড়ে। স্বপ্ন, মীনা বাজারসহ সব সুপারশপে এই ডিসকাউন্ট নানা সময় ৩০০টির বেশি পণ্যে থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘খোলা ও প্যাকেটজাত পণ্যের ক্ষেত্রে যারা উৎপাদক তারা বিভিন্ন সময় তাদের বক্তব্য আমাদের কাছে উপস্থাপন করেছেন। যেমন, চালের ক্ষেত্রে ভাঙা চালের পরিমাণ কত, আদ্রতার পরিমাণ কত, সেটি তাদের সর্টিং করতে হয় এবং তাতে কস্টিং বেড়ে যায়। ফলে কেউ কেউ প্যাকেট প্রতি ৫ টাকা খুচরা মূল্য বাড়িয়েছে। এখন এমআরপি নির্ধারণ হয় কিন্তু বাজারের পরিস্থিতির ওপর। যখন এমআরপি নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে, তখন প্রত্যেক কোম্পানি সেখানে নেগোসিয়েশন করে যে, প্রোফিট মার্জিন কী হবে। কারণ, ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে একটা ব্যয় আছে।’
সুপারশপের ব্যয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের আয়ের ৪-৫ শতাংশ ব্যয় হয় জায়গার ভাড়ায়। আমরাও কিন্তু ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে ভোক্তা। আমাদের কেন এত চড়া মূল্যে ভাড়া নিতে হয়। তার মধ্যে সব সুপারশপ যেহেতু কমপ্লায়েন্স মেনটেইন করে তার জন্য ১৫ শতাংশ ভ্যাট দেয়। কেউ কি ভাড়ার ওপর ভ্যাট দেয়?’
অপরদিকে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী, তাপমাত্রা সহনীয় যেসব পণ্য আছে সেসব ৪ ডিগ্রির নিচে রাখতে হয়। সেজন্য এসি ও চিলার বৃদ্ধি করতে হয়। একটি আউটলেট করতে তিন কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করতে হয়। আমাদের সব সুপারশপে প্রায় ৬-৭ হাজার কর্মকর্তা- কর্মচারী কাজ করছেন। কেউ ৫০০ টাকার বাজার করলে ৭ টাকার ব্যাগে দিতে হয়। সরকারের যে পরিবেশগত পলিসি আছে আমরা তা মেনে ব্যবসা করি। পলিথিন ব্যবহার করতে গেলে অনুমোদিতগুলো ব্যবহার করি। বাইরের দোকানে কি তা পাবেন? একজন ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বিল দিলে সেটির চার্জ ১০০ টাকায় ৫ টাকা ব্যাংকে দিয়ে দিতে হয়। সব সুপারশপের রেভিনিউয়ের ২০ শতাংশ পরিচালনা ব্যয় আছে। আমরা তো আর দাম বাড়িয়ে কিছু বিক্রি করছি না। আমরা নেগোসিয়েশন করে কম দামে কেনার চেষ্টা করি, সেখান থেকে আমাদের মার্জিন হয়। সরকার নির্ধারিত দাম তো কিছু পণ্যে আমরাই ঠিক রাখছি। বাইরের বাজারে কিছুক্ষণ ঠিক থাকছে, কিছুক্ষণ পর আবার বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমরা তো তা করছি না। সয়াবিন তেল প্রতি লিটার বিক্রিতে আমরা ১০ টাকা লস করি। সুপারশপে যারা কেনাকাটা করেন, যাদের সামর্থ্য আছে তারাই কিন্তু যায়। একটি ইলিশ মাছ ৪০০ গ্রাম বিক্রি করলে ৮ টাকা লাভ করি। এখন যদি এখানে ২৫ শতাংশ লাভ করি, তাতে কি সাধারণ ভোক্তা লাভবান হন? হবেন না।’
ভোক্তার মহাপরিচালক এসময় বলেন, ‘মিনিকেট চাল বলে কিছু নেই। এটি এ নামে বিক্রি প্রতারণা। এটি এ নামে বিক্রি বন্ধ রাখতে চাচ্ছি।’ এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে স্বপ্ন সুপার শপের হেড অব মার্কেটিং মাহাদী ফয়সাল বলেন, ‘আমাদের কাছে প্রত্যেকটি প্রাইসিংয়ের ডকুমেন্ট আছে। তথ্য গোপন করার কোনও সুযোগ নেই। আমরা মূল্য নির্ধারণে চাপ প্রয়োগ করি- এ তথ্য আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’
মীনা বাজারের হেড অব সাপ্লাই চেইন আবু রায়হান ভূঁইয়া আলবেরুনী বলেন, ‘উৎপাদকরা যখন মূল্য নির্ধারণ করেন তখন সেটি তাদের স্থানীয় ভ্যাট অফিসে জমা দেন। সব ব্রেকডাউন দিয়ে জমা দেওয়ার পর অনুমোদিত হলে এরপর সেটি সার্কুলার করে। এই অনুমোদনের পর তারা আমাদের ইমেইল দিয়ে জানায়। আগের প্রাইস ৫ টাকায় কিনে ৮ টাকা বিক্রি করতেন। এখন ৮ টাকায় কিনে ১০ টাকায় বিক্রি করতে হবে। ওরা যখন প্রাইস দেয় তখন আমরা আরেকটু কমিয়ে দিতে বলি। এখানে ওদের যে মার্কাপ এটা আমরা বাড়াই না। ভ্যাট কর্তৃপক্ষকে সব খরচের ব্রেকডাউন দিতে হয় একটি ফরম্যাটে। তারপর মূল্য অনুমোদন দেয়। এটি ১৯৯২ সাল থেকে প্রচলিত এদেশে। আমরা শুধু উৎপাদকদের কাছ থেকে পণ্য নিয়ে ভোক্তাদের পৌঁছায় দেই। আমরা শুধু মাত্র ট্রান্সফারের কাজ করি, এখানে কোনও ভ্যালু এডিশন নেই।’
মিনিকেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মিনিকেটের মতো অনেক পণ্যই আছে। আমরাও চাই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হোক। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে যে মূল্য নির্ধারণের চিঠি আসে, গত সপ্তাহেও এসেছে। সেখানেও মিনিকেট লেখা আছে। আমাদের যেভাবে কাগজ দেবেন আমরা সেভাবেই চলবো। একজন ডানে যেতে বলবে আরেকজন বামে, তাহলে আমরা কোথায় যাবো? এটার একটা সল্যুশন আমরা চাই।’
সভায় অন্যান্য সুপারশপের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন