আবদুল্লাহ আল আজিজ, উখিয়া
মাত্র ৯০ টাকা বেতনে শুরু তাঁর শিক্ষকতা জীবন। অভাবের সংসারে নানা ঝড়ঝাপটা সামলেও সন্তানদের পড়িয়েছেন। প্রাপ্তির কথা না ভেবে দীর্ঘ ৪৫ বছর ছড়িয়েছেন শিক্ষার আলো। তবে সারা জীবনের পরিশ্রম বৃথা যায়নি। তিন ছেলেই এখন তাঁর সম্পদ, আর গর্বের উপলক্ষও।
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার হলদিয়াপালং ইউনিয়নের রুমখাঁ বাজার গ্রামের লোকজন তাঁকে অরুণ স্যার নামেই ডাকে। পুরো নাম অরুণ কান্তি দাশ। সম্প্রতি অবসরে গেছেন তিনি। তাঁর তিন ছেলেই মেধার স্বাক্ষর রেখে আজ সাফল্যের চূড়া স্পর্শ করেছে। বড় ছেলে মোহন কুমার দাশ বর্তমানে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি (বুয়েট) এ গবেষণা সহকর্মী এবং ঢাকার আগারগাঁও সার্ক আবহাওয়া গবেষণাকেন্দ্রের গবেষণা কর্মকর্তা , মেজো ছেলে সুজন কুমার দাশ যশোর বিমানবাহিনী একাডেমির স্কয়াড্রন লিডার (মেজর) এবং ছোট ছেলে রুপন কুমার দাশ টাংগাইল জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সহকারী জজ হিসেবে কর্মরত আছেন।
উখিয়া সদর থেকে পশ্চিম দিকে তিন কিলোমিটার দূরের গ্রাম রুমখাঁ । প্রসিদ্ধ বটগাছ,সুপারী,নারকেল গাছে ছাওয়া এই গ্রামে একখণ্ড জমিতে অরুণের আধা পাকা পুরোনো টিনের বাড়ি। সকালে তাঁর বাড়িতে ঢুকে দেখা যায়, আঙিনায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন তিনি।
সন্তানদের কথা তুলতেই বললেন, ‘আমার তিন ছেলে এখন গ্রামের গর্ব। ওরা আমার সারা জীবনের পরিশ্রমের ফসল। ওদের কারণে আজ আমার সামাজিক মর্যাদাও বেড়েছে।’
পাশে দাঁড়ানো স্ত্রী মাধুরী দাশ (৫৭) বলেন, ‘তিন ছেলেকে মানুষ করতে জীবনের অনেক সুখ–স্বাচ্ছন্দ্য বাদ দিয়েছি। এখন ছেলেদের সুনাম শুনলে মনে হয় পরিশ্রম সার্থক হয়েছে।’
১৯৭৩ সালের ১ জুলাই অরুণ কান্তি দাশ উখিয়ার সমুদ্র উপকূলের সোনাইছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন সহকারী শিক্ষক পদে। মাসিক বেতন ছিল ৯০ টাকা। বিয়ে করেন চট্টগ্রামের আমিরাবাদের মেয়ে মাধুরী দাশকে। শিক্ষকতা জীবন থেকে অরুণ কান্তি দাশ অবসর নিয়েছেন গত ২৯ এপ্রিল। তাঁর শেষ কর্মস্থল ছিল উপজেলার জালিয়াপালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
তিন ছেলের সাফল্য প্রসঙ্গে অরুণ কান্তি দাশ বলেন, ‘আমাদের ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। এখন ছেলেরা এলাকার গরিব মানুষের শিক্ষার জন্য কিছু করলে শেষ ইচ্ছেও পূর্ণ হবে।’
অরুণ কান্তি দাশের তিন ছেলের লেখাপড়া শুরু জালিয়াপালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তিনজনই লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন। মোহন কুমার দাশ চট্টগ্রাম কলেজ থেকে রসায়নে এমএসসি ডিগ্রি নেন। বর্তমানে চাকরির পাশাপাশি তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন। সুজন কুমার দাশ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ ডিগ্রি করেছেন। আর রুপন কুমার দাশ একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ থেকে এলএলএম পাস করেন।
নিজেদের সাফল্যের পেছনে বাবা-মায়ের অবদানকে বড় করে দেখেন ছেলেরা। বড় ছেলে মোহন কুমার দাশ জানান, তিন ভাইয়ের পড়ালেখার হাতেখড়ি হয়েছে মায়ের হাতে। তিনি বলেন, ‘মা সব সময় আমাদের চোখে চোখে রাখতেন। সন্ধ্যার আগেই তিন ভাইকে ঘরে ফিরে পড়তে বসতে হতো।’
বাবা সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন, ‘দুর্গম এলাকায় বসবাস করলেও বাবা আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষায় উৎসাহ দিতেন সব সময়। সব বিষয়ে আমরা তাঁর সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতাম। আসলে বাবা-মা সজাগ থাকলে সন্তানেরা মানুষ হবেই।’
সময় পেলেই এখনো রুমখাঁয় ছুটে আসেন গ্রামের তিন কৃতী সন্তান। এলাকায় বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে কাজ করছেন তাঁরা।
পাঠকের মতামত