শাহেদ ইমরান মিজান :
মানবপাচারের ‘গড়মাদার’ উখিয়ার বহুল আলোচিত রেজিয়া আকতার ওরফে রেবি ম্যাডাম বর্তমানে মিয়ানমারে অবস্থান করছে। ক্রসফায়ারের ভয়ে ৬ মাসের বেশি আগে তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে মিয়ানমারে পালিয়ে যান। তিনি মায়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মংডুতে অবস্থান করছে। রেবি ম্যাডামেরই কাছের একটি সূত্র এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এই তথ্যের স্বীকারোক্তি সংক্রান্ত একটি রেকর্ড এই প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে। সূত্রটি মায়ানমার পালিয়ে যাওয়া ছাড়াও রেবি ম্যাডাম সম্পর্কে জানিয়েছেন আরো একটি পিলে চমকানো তথ্য।
সূত্রটির দাবি মতে, মায়ানমার গিয়ে বসে নেই রেবি ম্যাডাম। তিনি সেখান থেকে পাঠাচ্ছেন মরণনেশা ইয়াবার চালান। পাঠানো ইয়াবার বড় বড় চালানগুলো পাচার করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সড়ক ও নৌ-পথে এসব ইয়াবা চালান পাচার করা হচ্ছে বলেও সূত্রটি নিশ্চিত করেছেন।
সূত্র মতে, মামলা সংক্রান্ত কাজ শেষে কক্সবাজারে আসার পথে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকার গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের শ্যামলী কাউন্টার থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল মুখোশধারীরা। এসময় তার মেয়ে এক মেয়ে আলিয়াকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তবে তাকে পরে ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর এক মাসেরও বেশি সময় ধরে নিখোঁজ ছিলো রেডি ম্যাডাম। কিন্তু ততক্ষণে জানা গিয়েছিল, আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরাই রেবিকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। কথিত আছে, বিশাল অংকের টাকার বিনিময়ে সেই সময় ছাড়া পেয়েছিলেন রেবি ম্যাডাম। তবে এরপর আর এলাকায় ফিরেনি রেবি।
রেবি ম্যাডামের কাছের ওই সূত্রটি দাবি করেছেন, সে সময় আইনশৃংখলা বাহিনীর ক্রসফায়ারের মুখে পড়েছিলেন রেবি ম্যাডাম। মোটা অংকের টাকা তা কাটিয়ে উঠেছিলেন। তারপরও জীবন নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন রেবি ম্যাডাম। সেই শঙ্কা থেকেই মায়ানমার পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তার।
বর্তমানে তিনি মায়ানমারের মংডু প্রদেশে অবস্থান করছেন। সেখানে গিয়ে বসে থাকেননি রেবি ম্যাডাম। সেখানকার ইয়াবা গড়ফাদারদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে ইয়াবাকারবারে জড়িয়ে পড়েন। সেখানে বসে উখিয়া কেন্দ্রিক তার নিজ চক্রের লোকজন দিয়ে মায়ানমার থেকে পাঠানো ইয়াবা গুলো বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রান্তে পাচার করা হচ্ছে।
অনুসন্ধানী সূত্র মতে, রেবি বেশির ভাগই সাগরপথে বড় কাঠের বোটে করে বাংলাদেশে ইয়াবা পাঠাচ্ছেন। তার ভাই জালালের মালিকানাধীন দুটি বোটই এসব ইয়াবা সরবরাহে ব্যবহার করা হচ্ছে। সম্প্রতি কক্সবাজার শহরের কলাতলী থেকে ধরা পড়া ৭লাখ ইয়াবার মূল হোতা রেবি ম্যাডাম বলে গোয়েন্দা তথ্যে উঠে এসেছে। ওই ৭লাখ ইয়াবার সাথে আটক হওয়াদের একজন জাহেদ আপন ভায়রা। জালাল ও জাহেদের নেতৃত্বাধীন একটি বড় সিন্ডিকেট রেবি ম্যাডামের পাঠানো ইয়াবা সারাদেশে পাচার করেন। সিন্ডিকেটের দেখভাল করেন রেবির স্বামী নূরুল কবির ও ছেলে জুয়েল।
আরো জানা গেছে, জালাল ও জাহেদের মাধ্যমে মাসে তিন থেকে পাঁচটি বড় ইয়াবার চালান আনা হয় বাংলাদেশে। এসব চালান রাতের আঁধারে বঙ্গোপসাগরের উখিয়ার সোনারপাড়া পয়েন্ট দিয়ে খালাস করা হয়। সম্প্রতি গোপনে ইয়াবার চালান খালাসকালে স্থানীয় জনতার ধাওয়া খায় জালাল ও জাহেদসহ অন্যান্য পাচারকারীরা। তাদেরকে ধাওয়া করার দায়ে সোনারপাড়ার মো. রুবেল এক ব্যক্তিকে বেদম পেটায় জালাল ও জাহেদসহ অন্যান্য পাচারকারীরা। এতে গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন রুবেল।
উখিয়ার সোনারপাড়ার লোকজন জানান, নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে রেবিকে আর এলাকায় দেখা যায়নি। তবে তার স্বামী ও ছেলে রাকিবসহ তার মানবপাচার সিন্ডিকেটের অন্যান্য সদস্যরা এলাকায় বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। জানা গেছে, ঈদের পর রেবির স্বামী নূরুল আমিনের সাথে কিছু অপরিচিত লোকজনকে সোনারপাড়ায় দেখা গেছে। ওই লোকগুলো সেখানে তিন মতো অবস্থান করেছিল। এই অচেনা লোকজন ঘিরে সোনারপাড়ার সাধারণ লোকজনের মাঝে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। ওই লোকগুলোর আচরণও রহস্যজনক ঠেকেছে সবার কাছে।
স্থানীয়রা জানান, রেবি এক সময় জীবনবীমা কোম্পানিতে চাকরির মাধ্যমে জীবন জীবিকা নির্বাহ করলেও তার সংসারে ছিল অভাব অনটন। রেজিয়া আক্তারের স্বামী নূরুল কবির টানাপোড়নের সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে মানবপাচার কাজে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় উপকূলের মেরিন ড্রাইভ ও কক্সবাজার টেকনাফ সড়কের কোটবাজার সি-বিচ সড়ক দিয়ে অহরহ লোকজন জড়ো হতো সোনার পাড়া বাজারে। বলতে গেলে এ সময় সোনারপাড়া, ইনানী, নিদানিয়া এলাকায় মালয়েশিয়া যাত্রীর হাট বসতো। এ সময় লোকজন সংগ্রহ করে সাগরপথে পাচার করে দেয়ার জন্য কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হলে নুরল কবিরের বাড়িতে এসব লোকজনদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে নিরাপদে রাখতো। থাকা-খাওয়া বাবদ খাতেও তারা স্বামী স্ত্রী অনেক টাকা হাতিয়ে নিয়েছে অসহায় মালয়েশিয়া যাত্রীদের কাছ থেকে। ২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারি রেবি ম্যাডামকে মানবপাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর ২০১৪ সালে ২৩ নভেম্বর কারান্তরীণ স্বামীকে মুক্ত করার জন্য কক্সবাজার আদালত পাড়ায় তদবিরের জন্য ঘুরাঘুরি করাকালে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল রেবি ম্যাডামকে আটক করে। এ সময় পুলিশ তার ভ্যানিটি ব্যাগে তল্লাশি চালিয়ে ৮৪ লাখ টাকা এবং ২৭ লাখ টাকার ২টি ব্যাংকের চেকও উদ্ধার করে। এ ঘটনায় পুলিশ তার বিরুদ্ধে ২টি মামলা দায়ের করে। পরে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায়
বিভিন্ন থানা সূত্রে জানা গেছে, রেবি ম্যাডামের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় রয়েছে মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে ৩টি মামলা। কক্সবাজার সদর থানায় রয়েছে ২টি মানবপাচার মামলা। তার স্বামী নুরুল কবিরের বিরুদ্ধেও রয়েছে মানবপাচারের ৬টি মামলা। এছাড়াও তদের মানবপাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের উপর হামলার ঘটনায় আরো তিনটি মামলা রয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রেবি ম্যাডাম মায়ানমারে থাকার কথা উড়িয়ে দিয়ে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আরে ভাই এগুলো পুরনো কথা। ওতো অনেক আগেই সাইট হয়ে গেছে।’ সুত্র: সিটিএন