কক্সবাজারের উখিয়ার আলোচিত ফোর মার্ডারের তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এ হত্যাকাণ্ডের কোনো কূল কিনারা হয়নি। এ পর্যন্ত দুইবার তদন্তকারী সংস্থা ও পাঁচবার তদন্ত কর্মকর্তা বদল করা হয়েছে। তবুও তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই। আসামিও শনাক্ত হয়নি। তবে কোনো একদিন খুনিরা চিহ্নিত হবে এ বিশ্বাসে প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন নিহতের স্বজনরা।
২০১৯ সালের এই দিনে (২৬ সেপ্টেম্বর) উখিয়ার রত্নপালং ইউনিয়নে ১ নং ওয়ার্ডের পূর্ব রত্নাপালং বড়ুয়া পাড়ায় খুন হন শাশুড়ি, বৌ, ছেলে ও ভাইঝি।
আদালত সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে আটটায় রত্নপালং বড়ুয়াপাড়ার রুকেন বড়ুয়ার (নিহতদের বসত বাড়ি) দালান বাড়ির পূর্ব পাশের উত্তরের ক্ক্ষ থেকে রুকেন বড়ুয়ার মা সুখি বড়ুয়া (৭০) ও পশ্চিম পাশের উত্তর কক্ষ থেকে স্ত্রী মিলা বড়ুয়া (২৫) এবং মধ্যম কক্ষ থেকে ছেলে রবিন বড়ুয়া (৫) ও ভাইঝি সনি বড়ুয়া (৬) এর গলাকাটা মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকায় পুলিশ ছাদ থেকে নিচে নেমে মৃতদেহগুলো উদ্ধার করে। ওই ঘটনায় নিহত মিলা বড়ুয়ার বাবা শশাস্ক বড়ুয়া সেদিন রাতেই উখিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার নম্বর ৪৭। এরপর উখিয়া থানার এক এসআই, এক ওসি (তদন্ত), এরপর পিবিআইয়ের দুই ওসি এবং এক পুলিশ সুপার মামলাটি তদন্ত করছেন। কিন্তু এখনো হত্যাকারীকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে উখিয়া আদালতে সাধারণ নিবন্ধ অফিসার (জিআরও) এএসআই আল আমিন বলেন, তিনবছরে ওই মামলার তেমন অগ্রগতি নেই। মামলাটি অগ্রগতি বলতে শুধু এজাহার। তদন্ত কর্মকর্তা কয়েকবার আবেদন করে রিমান্ড আবেদন, রক্ত সংগ্রহ, ৯ জনের সন্দেহভাজনের ডিএন পরীক্ষা করা হয়েছে। এর বাইরে ১৪ বার ধার্য তারিখ ছিল। করোনার কারণে মামলাটি আদালতের কার্যক্রম কিছুদিন বন্ধ ছিল।
তিনি বলেন, ৯ জনের ডিএনএ রিপোর্ট আদালতে জমা থাকলেও তাদের সাথে আলমত থেকে সংগ্রহ করা ডিএনএর মিল নেই। এই মামলার পরবর্তী শুনানি তারিখ ২৮ নভেম্বর।
এজাহার থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, খুনের ঘটনার রাতে ২৫ সেপ্টেম্বর রাত ৯টা ১৭ মিনিটে নিহত মিলা বড়ুয়া তার বাবা শশাঙ্ক বড়ুয়ার সাথে মুঠোফোনে কথা বলেছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শশাঙ্ক বড়ুয়া বলেন, আমার সাথে মেয়ে পারিবারিক বিষয়ে কিছু কথা বলেছিলেন। কথা বলার সময় তার মধ্যে কোন ধরণের ভীতি দেখা যায়নি। তাই আমার ধারনা ২৫ সেপ্টেম্বর রাত ৯টা ১৭ মিনিটের পর থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর ভোর ৬ টার মধ্যে যেকোন সময়ে ফোর মার্ডারের ঘটনা ঘটেছে।
সুরতাহাল প্রতিবেদন তৈরিকারী ও মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা উখিয়া থানার তৎকালীন এসআই মো. ফারুক হোসেন বলেন, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ভবনটির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। খুনী খুন করার পর সিঁডি বেয়ে দোতলার ছাদে উঠে তারপর সেখান থেকে গাছ বেয়ে পালিয়ে যায়। আমরাও ঘটনার দিন ছাদ থেকে নিচে নেমেছি।
তিনি আরও বলেন, মিলা বড়ুয়ার ব্যবহৃত পেটিকোট, যৌনরস, নখের অগ্রভাগ, জিন্স প্যান্ট, আকিজ বিড়ির খোসা, টেবিলের উপর থাকা কাটা আপেলের অর্ধেক, ১টি ছুরি, গঞ্জি, রক্তমাখা প্লাস্টিকের প্যাকেট, প্লাস্টিকের কভার আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়। তবে মামলাটি চাঞ্চল্যকর হওয়ায় ঘটনার কয়েকদিন পরেই এর তদন্তের দায়িত্ব নেন উখিয়া থানার তৎকালীন ওসি (তদন্ত) নুরুল ইসলাম মজুমদার।
এ বিষয়ে নুরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ২০১৯ সালের ৯ অক্টোবর ওই হত্যার সাথে জড়িত সন্দেহে নিহতের প্রতিবেশী উজ্জল বড়ুয়া ও রিপু বড়ুয়া নামের দুইজনকে গ্রেফতার করি। ১৬ অক্টোবর তাদেরকে একদিনের রিমান্ডে আনি। এরপর ১২ ডিসেম্বর পরকিয়ার গুঞ্জন শুনে এবং নিহত মিলা বড়ুয়ার স্বামীর জিডির প্রেক্ষিতে তার দুলাভাই অসীম বড়ুয়াকে গ্রেফতার করি। ২৬ ডিসেম্বর তাকে একদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য আদালতকে অবহিত করা হয়েছে।
এদিকে, চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড বিষয়ে পুলিশের অগ্রগতি তেমন না হওয়ায় পরে মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) হস্তান্তর করা হয়। এরপর এটি তদন্ত ভার পান পিবিআইয়ের ইনস্পেক্টর পুলক বড়ুয়া। তিনি গ্রেফতার আসামিদের জেলগেইটে ফের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। বাদী, নিহতের আত্মীয়-স্বজন, নিহত মিলা বড়ুয়ার স্বামী রুকেতন বড়ুয়াসহ অনেকের সাথে কথা বলেন। জব্দ আলামতগুলো ফরেনসিক ও ডিএনএ প্রতিবেদনের জন্য প্রেরণ করা হয়। এরপর তিনি বদলি হয়ে গেলে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান একই সংস্থার আরেক ইন্সপেক্টর ক্যশৈনু।
ইন্সপেক্টর ক্যশৈনু বলেন, আমি অনেকদিন আগে কক্সবাজার থেকে চলে এসেছি। বর্তমানে কি অবস্থা জানিনা। তবে আমি ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা থাকার সময় নিহতের পরিবারের দাবি ও আমার প্রাথমিক তদন্তে সন্দেহের তালিকায় থাকা ৯ জনের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। তবে ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা আলামতের ডিএনএ রিপোর্টের সাথে কারো রিপোর্ট মিলেনি।
আদালত থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, তদন্ত কর্মকর্তাদের তিন দফার ভিন্ন ভিন্ন আবেদনার প্রেক্ষিতে, উজ্জল বড়ুয়া, রিপু বড়ুয়া, নিহত মিলা বড়ুয়ার দুলাভাই অসীম বড়ুয়া, অন্তর বড়ুয়া, অসীম বড়ুয়া, বাবুল বড়ুয়া, আনন্দ বড়ুয়া নিতু, ভাগ্যধন বড়ুয়া ও সোমান্দ বড়ুয়া প্রকাশ টমটমচালক লুধা বড়ুয়ার ডিএন এ পরীক্ষা করা হয়। পরে ২০২১ সালেরর ২ মার্চ জাতীয় ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির এসআই মো. মাসুদ রাব্বি সবুজ স্বাক্ষরিত ওই ৯ জনসহ আলামতের ডিএন এ প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হয়।
নিহত মিলা বড়ুয়ার স্বামী রুকেন বড়ুয়া বলেন, ঘটনার তিন বছর গত হলেও এখনো জানতে পারিনি আমার মা, বৌ, সন্তান ও ভাইঝিকে কে বা কারা খুন করেছে। কেনইবা খুনি করেছে। আমি তদন্ত সংস্থার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি।
ফোর মার্ডার—তিন বছরে ৫ বার তদন্ত কর্মকর্তা বদল, তবুও খুলছে না রহস্যের জট
কক্সবাজারের উখিয়ার আলোচিত ফোর মার্ডারের তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এ হত্যাকাণ্ডের কোনো কূল কিনারা হয়নি। এ পর্যন্ত দুইবার তদন্তকারী সংস্থা ও পাঁচবার তদন্ত কর্মকর্তা বদল করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের এলাকায় চোর, ডাকাতের উপদ্রব বেশি। ঘটনার দিন আমার বসত বাড়ি থেকে একটি স্বর্ণের চেইন দুই জোড়া কানের দোলসহ প্রায় ৭০ হাজার টাকার মালামাল লুট হয়েছে। সেদিন বাড়িতে বিদ্যুৎ না থাকায় আমার মায়ের রুমে টর্চ লাইটটি জ্বলছিল। বয়স্ক মানুষ সারারাত হয়ত টর্চের আলো এদিক সেদিক মারছিল। এ কারণে খুনিরা আমার মায়ের চোখে লাথি মারে। মৃত্যুর সময় তার চোখ কালো এবং ফোলা ছিল।
রুকেন বড়ুয়া আরও বলেন, আমি আবার বিয়ে করেছি বছর দেড়েক আগে। এ ঘরে একজন ছেলে সন্তান আছে। ফেলে আসা অতীতকে ভুলতে বিয়ে করলেও আমাকে সেই খুনের ঘটনা এখনো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আমি খুনীদের চেহারাটা দেখতে চাই। জানতে চাই কি অন্যায় করেছিল আমার মা, ছেলে, বৌ এবং আমার ভাইঝি। জানিনা আমার এই আশা পূরণ হবে কিনা।
পিবিআই কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মো. সরওয়ার আলম বলেন, এটি একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা। এর তদন্তের দায়িত্ব আমি নিজে পালন করছি। এটি সার্বক্ষণিক আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মনিটরিং করছেন। তবে এ মামলার বিষয়ে কথা বলার সময় এখনো আসেনি। সুত্র মহানগর