পলাশ বড়ুয়া::
কক্সবাজারের উখিয়ায় এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। এতে বিপাকে পড়েছে আর্থিক অস্বচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। তাদের অভিযোগ, স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি ও প্রধানশিক্ষকের যোগসাজসে এ অর্থ আদায় করা হচ্ছে।
২০১৮ সালের এসএসসি ও সমমানের ফরম পূরণে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে স্কুলের উন্নয়ন ও কোচিং ফি বাবদ নেওয়া হচ্ছে ৪ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া নির্বাচনি পরীক্ষায় বিভিন্ন বিষয়ে অকৃতকার্যদের কাছ থেকে বিভিন্ন হারে জামানত নেওয়া হচ্ছে। এক বিষয়ে ৫শ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ছয় বিষয়ে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে।
#স্কুল উন্নয়ন ও কোচিং ফি’র নামে ৪ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত ফি: আদায়।
# শিক্ষার্থীদের টাকা আদায়ের রশিদ দিচ্ছে না ।
# শিক্ষায় বাধাগ্রস্থ হচ্ছে হতদরিদ্ররা।
# বাড়বে ঝরে পড়ার হার।
এদিকে ২০১৮ সালে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার জন্য ফি নির্ধারণ করেছে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটি। শিক্ষার্থীপ্রতি সর্বোচ্চ ফি নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার ৫৬৫ টাকা। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য এই ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রতি বছরই বোর্ডের নির্দেশনা না মেনে নিজেদের নিয়মে পরীক্ষার ফি আদায় করে আসছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো। একাধিক শিক্ষার্থী জানায়, কোচিং ও উন্নয়ন ফি বাবদ মাত্রাতিরিক্ত ফি আদায়ের ফলে গরীব, মেধাবী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা বিপাকে পড়েছেন।
চট্টগ্রাম বোর্ড সুত্রে জানা যায়, নিয়মিত ব্যবসায় ও মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী প্রতি ১১৭৫টাকা এবং ব্যবহারিক ও কেন্দ্র ফি: সহ সর্বোচ্চ ১৪৭৫টাকা। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১২৬৫টাকা এবং ব্যবহারিক ও কেন্দ্র ফি: সহ সর্বোচ্চ ১৫৬৫টাকা নির্ধারণ করা হলেও কক্সবাজারের উখিয়ার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে মানা হচ্ছে না এই নিয়ম। এ বিষয়ে সকল বোর্ড আলাদা আলাদা বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে।
অতিরিক্ত ফি: আদায়ের বিষয়ে বোর্ড চেয়ারম্যান বরাবরে লিখিত অভিযোগ করার কথা বলেন চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাহবুব হাসান। এ বিষয়ে তিনি জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকেও বিষয়টি অবহিত করার কথা বলেন। গত বছর অতিরিক্ত ফি: আদায়কারী প্রতিষ্ঠান গুলোকে উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী পরবর্তীতে উক্ত টাকা ফেরত দেওয়া হয় বলেও তিনি জানান।
কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী মরিয়ম আকতার জানায়, ৪ হাজার ৫শ টাকা দিয়ে ফরম ফিলাপ করেছে সে। কিন্তু তাকে কোন ধরণের রশিদ দেওয়া হয়নি। একই অভিযোগ জান্নাত আরার।
মরিয়মের বাবা হাফেজ আলী আহমদ জানায়, সামান্য বেতনে চাকরি করি। তাছাড়া সরকার মেয়েদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন কৌশলে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে। তাছাড়া আমার মেয়ের ফরম পূরণের ৪হাজার ৫শ টাকা নিয়ে রশিদ দেয়নি স্কুল কর্তৃপক্ষ।
অতিরিক্ত অর্থ দিতে না পারায় সে ফরম ফিলাপ চুড়ান্ত হয়নি এখনো হলদিয়া’র তামান্না বড়–য়া’র। তার মা রেখা বড়–য়া জানায়, আমার মেয়ের কাছ থেকে ৭হাজার দাবী করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। ৪ হাজার টাকা জমা দিলেও বাকী ৩ হাজার টাকার জন্য পরীক্ষা দিতে পারবে না বলে জানিয়েছে।
ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বখতিয়ার আহমদ মেম্বার বলেন, উখিয়ার অন্যান্য স্কুলে ৪ হাজার ৫০০ টাকা নিলেও কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪ হাজার ২শ টাকা নেওয়া হচ্ছে। কোন কোন খাতে এবং শিক্ষার্থীদের রশিদ দেওয়া হচ্ছে না কেন জানতে চাইলে তিনি অসুস্থতার কথা বলে প্রধান শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।
কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান অতিরিক্ত ফি আদায়ের বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন ৩টা বিভাগ থেকে ১৩শ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে অতিরিক্ত ক্লাশের নামে ১২শ টাকা নেওয়া হচ্ছে।
ফরম ফিলাপ বাবদ অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার বিষয়টি নাকচ করে পালং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এহসানুল হক মানিক বলেন, কেন্দ্র ফি: ও ব্যবহারিক ব্যতীত শুধুমাত্র বোর্ড ফি: বাবদ মানবিক ও ব্যবসায় শাখার শিক্ষার্থী প্রতি ১হাজার ৪০০টাকা, বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী প্রতি ১ হাজার ৫০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া আগ্রহী শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ক্লাশ বাবদ তিন মাসে ৯শ টাকা সহ সর্বসাকুল্যে ২ হাজার ৫শ টাকা নেওয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
একই ভাবে উখিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে কোচিং ফি: সহ সাড়ে ৩ হাজার টাকা, উখিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সাড়ে ৩ হাজার টাকা, আবুল কাশেম নুর জাহান চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪ হাজার টাকা, ভালুকিয়াপালং উচ্চ বিদ্যালয়ে ৩ হাজার ৮শ টাকা, সোনারপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ৩ হাজার ৬শ টাকা সহ উখিয়া উপজেলার মোট ২১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফরম পূরণের নামে অতিরিক্ত ফি: আদায়ের অভিযোগ উঠেছে।
এ ব্যাপারে কয়েকজন এসএসসি পরীক্ষার্থীদের সাথে আলাপ করা হলে নাম প্রকাশ না করার সত্ত্বে ওই পরীক্ষার্থীদের নিকট থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা আদায়ের কথা জানান। এ প্রসঙ্গে জানতে চেয়ে উখিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল হোসাইন সিরাজীর মুঠোফোনে সংযোগ পাওয়া যায়নি।
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অনলাইনে ফরম পূরণের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত। তবে ১০০টাকা বিলম্ব ফি দিয়ে ১৩ থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত তা পূরণ করা যাবে।
বোর্ডের কড়াকড়ির কারণে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই এখন ভিন্ন পন্থায় অতিরিক্ত ফি আদায় করছে। তারা ফরম পূরণ বাবদ একটি রসিদ দিয়ে বোর্ড নির্ধারিত ফির প্রায় সমপরিমাণ অর্থ নিচ্ছে। তবে অন্য রসিদে উন্নয়ন ফিসহ নানা নামে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে। ফলে শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণ করতে হলে দুটি রসিদের সম্পূর্ণ টাকাই পরিশোধ করতে হয়।
এসএসসি ফরম পূরণের অতিরিক্ত ফি: আদায়ের বিষয়ে উখিয়া কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক আলমগীর মাহমুদ আক্ষেপ করে বলেন, “শিক্ষা বাণিজ্য নয়, বাণিজ্যিক ভাবলে এটি হবে ইয়াবার চেয়েও জগণ্য”। এভাবে চলতে থাকলে হতদরিদ্ররা হবে শোষিত। জাতি হবে বাধাগ্রস্থ। বাড়বে ঝরে পড়ার হার।
উখিয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রায়হানুল ইসলাম মিঞা বলেন, উখিয়ার ১৩টি মাধ্যমিক ও সমমানের ৮টি মাদ্রাসার ফরম ফিলাপ চলছে। এবার ২ হাজারের মতো ছাত্রছাত্রী ২০১৮ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে বলে তিনি ধারণা করেন। তিনি বলেন, অতিরিক্ত ফি: আদায়ের বিষয়ে এখনো কোন অভিযোগও আমাদের কাছে নেই। তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখবো এবং প্রমাণ মিললে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদিকে ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার পক্ষ থেকে কোচিং বন্ধ করা হয়েছে। বিদ্যালয় গুলোতে কোচিং ফি’র নামে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার কোচিং বন্ধ করেনি। নীতিমালার আলোকে কোচিং করা যাবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নিকারুজ্জামান বলেন, এসএসসি ফরম পূরণকালে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের ব্যাপারে কোন শিক্ষার্থী অভিযোগ করেনি। তিনি বলেন, এ ধরনের কোন অভিযোগ আসলে তা সাথে সাথে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।