কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফ সীমান্তে সাগরপাড়ের বাহারছড়া ইউনিয়নের অরণ্যঘেরা একটি মাদ্রাসায় একদল বিদেশি নাগরিকের রহস্যজনক আচরণে সন্দেহ ও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে এলাকায়। কয়েক দিন ধরেই এলাকাটিতে অচেনা বিদেশিদের আনাগোনা চলছিল। সর্বশেষ গত বুধবার সন্ধ্যায় একটি কালো রঙের মাইক্রোবাসে করে কক্সবাজার থেকে বিদেশিদের দলটি গোপনে সেখানে পৌঁছায়। খবর পেয়ে পুলিশও যায় সেখানে। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে বিদেশিরা আশ্রয় নেয় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মওলানা মোহাম্মদ আজিজের ঘরে। তবে ওই বাড়িতে বিদেশিদের সঙ্গে পুলিশকে দেখা করতে কিংবা কথা বলতে দেননি ইউপি চেয়ারম্যান। পুলিশের সন্দেহ, রাতে ওই বিদেশিরা টেকনাফ থেকে উখিয়ার কোনো স্থানে গিয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে।
ওই বিদেশিরা আসলে কোন দেশের তাও নিশ্চিত করা যায়নি। কেউ বলে তুরস্কের আবার কেউ বলে পাকিস্তানের নাগরিক তারা। সাম্প্রতিক সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে দেশ দুটির সম্পর্কে টানাপড়েন চলায় ওই বিদেশিদের এমন গোপন তৎপরতা নিয়ে জনমনে সন্দেহ ও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার নজর এড়িয়ে সীমান্তে একই স্থানে কয়েক দিন ধরে বিদেশিদের এই আনাগোনার বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী গত বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশের চলমান পরিস্থিতিতে সীমান্তের গহিন অরণ্য এলাকায় এসব বিদেশির আনাগোনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিদেশিরা প্রকাশ্যে দিনের বেলায় না এসে এ রকম রাতের বেলায় জঙ্গি কর্মকাণ্ড সম্পৃক্ত মাদ্রাসায় কী কাজ করছে, সেসব গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা প্রয়োজন।’ তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে বাহারছড়া এলাকায় যেসব নেতাকর্মী এ রকম গোপন কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপপরিদর্শক (এসআই) রিপন কুমার দাশ বলেন, ‘বিদেশি নাগরিকের উপস্থিতির কথা শুনে বুধবার সন্ধ্যায় আমি ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। এ সময় পুলিশ দেখে স্থানীয়দের সঙ্গে বিদেশিরাও দৌড়াতে থাকে। একপর্যায়ে বিদেশিরা চেয়ারম্যানবাড়িতে (মওলানা আজিজের বাড়ি) ঢুকে পড়ে।’ ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলে ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মওলানা আজিজ তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন এবং কাজে বাধা দেন। এ বিষয়ে তিনি ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে জিডি করবেন বলেও জানান। ওই রাতেই চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে বিদেশিরা কোথায় গেছে তা জানেন না এসআই রিপন। তবে তিনি সন্দেহ করছেন, এসব বিদেশি উখিয়ার কোনো রোহিঙ্গা শিবিরে বা অন্য কোথাও গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে।
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. সাখাওয়াত হোসেন গতকাল এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টেকনাফ সীমান্তের এমন একটি এলাকায় বিদেশিদের এ রকম সন্দেহজনক আনাগোনার ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।’
কক্সবাজারের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আনোয়ারুল নাসের বলেন, ‘ত্রাণসামগ্রী বণ্টন করতে হলেও দেশি-বিদেশি এনজিওকে জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু এ রকম কোনো অনুমতি নেই। তদুপরি সীমান্তে বিদেশিদের আনাগোনার বিষয়টি দেখার জন্য টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছি।’
টেকনাফের ইউএনও মো. সফিউল ইসলাম বলেন, ‘বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান আমাকে জানান, সেখানে কতিপয় বিদেশি গিয়েছিল তবে পরে তারা কোথায় চলে গেছে তা তিনি (চেয়ারম্যান) জানেন না।’
টেকনাফ-উখিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আবদুল মালেক মিয়া বলেন, ‘সীমান্তে কোনো কারণে বিদেশিদের যাওয়ার দরকার হলে আমরাই তাদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকি। কিন্তু এ রকম বিদেশিদের আসার ব্যাপারে আমাদের জানানো হয়নি। এ কারণেই পুলিশ খবর পেয়ে সেখানে অভিযান চালিয়েছে।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, গত ২০ জুন ইফতারের সময় বাহারছড়ার ওই মাদ্রাসায় কয়েক মণ চালের বিরিয়ানি বিলি করা হয়েছে। রোহিঙ্গা ছাড়া স্থানীয়দেরও ওই বিরিয়ানি দেওয়া হয়। একই রাতে টাকাও বিলি করা হয়েছে। এসব তদারকি করে কয়েকজন বিদেশি। বাহারছড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা মওলানা মোহাম্মদ আজিজ এবং ইউনিয়ন যুবলীগের সহসভাপতি ও ইউপি মেম্বার মোহাম্মদ ইউনুছ বিদেশিদের দেওয়া ত্রাণসামগ্রী বিলি করেন। তবে ত্রাণসামগ্রী দিনে বিলি করা হয় না। রাতে জনপ্রতি এক হাজার, তিন হাজার ও পাঁচ হাজার টাকা এবং বিভিন্ন সামগ্রী দেওয়া হয়।
এসব বিষয়ে জানার জন্য স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মওলানা আজিজের মোবাইল ফোনে অনেকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। অন্যদিকে যুবলীগ নেতা ইউনুছ বলেন, ‘এমন খারাপ কোনো কাজ এখানে হচ্ছে না।’
গত বছরও পুলিশি অভিযান চলে আজিজের এই মাদ্রাসায় : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের অরণ্যঘেরা এলাকায় ‘আনাছ বিন মালেক’ নামের ওই মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নবনির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান মওলানা মোহাম্মদ আজিজ। টেকনাফ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রবেশকারীর অবস্থান বাহারছড়া ইউনিয়নে। রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) দীর্ঘদিন ধরে ওই মাদ্রাসা ঘিরে জঙ্গি কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এ রকম অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর পুলিশ মাদ্রাসাটিতে অভিযানও চালিয়েছিল।
এলাকার লোকজন জানায়, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মওলানা মোহাম্মদ আজিজের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিভিন্ন এনজিওর সম্পর্ক রয়েছে। কয়েক বছর ধরে তিনি বাহারছড়ায় অবৈধ রোহিঙ্গাদের নামে ত্রাণসামগ্রী এনে বণ্টন করে আসছেন। গত বছর তুরস্কের কয়েকটি এনজিওর দেওয়া অর্থে রোহিঙ্গাদের জন্য কেনা কোরবানির ১৯০টি গরু নিয়ে পুলিশের হাতে আটকও হয়েছিলেন মওলানা আজিজ। নানা সুবিধার কারণে আন্তর্জাতিক মৌলবাদী গোষ্ঠীও গোপনে ভিড় জমায় বাহারছড়া এলাকায়। একদিকে সাগর এবং পূর্ব দিকে মিয়ানমারের নাফ নদীর সীমানাবেষ্টিত গহিন পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় অত্যন্ত স্পর্শকাতর হিসেবেই চিহ্নিত এলাকাটি। এখানে শত শত অবৈধ রোহিঙ্গার বসতি রয়েছে।
-সুত্র : কালের কন্ঠ
পাঠকের মতামত