প্রভাষ আমিন : চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন নতুন কিছু বলেননি। তবে অতি পুরনো সত্যি কথাটি প্রকাশ্যে উচ্চারণ করে রীতিমতো বোমা ফাটিয়েছেন তিনি। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত একজন মেয়রের মুখে এ ধরনের অভিযোগ অসত্য না হলেও একটু বেমানান। গত ১০ আগস্ট চট্টগ্রামে এক নাগরিক সংলাপে তিনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ চাওয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনেছেন। অভিযোগটি নিছক কথার কথা নয়। নিজের বক্তব্যে অভিযোগটির বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। খালি অভিযুক্ত কর্মকর্তার নামটি বলেননি।
আ জ ম নাছির বলেছেন, তাকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চাহিদামতো থোক বরাদ্দের আশ্বাস দেওয়া হয়। তবে বিনিময়ে তাদের ৫ শতাংশ কমিশন দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এমনকি ঠিকাদারদের কাছ থেকে ৫ শতাংশের এই টাকা ম্যানেজ করারও পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে রাজি হননি। রাজি না হওয়ায় কী হলো? শুনুন মেয়রের মুখেই- ‘রাজি না হওয়ায় আমি শুধু ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেলাম। যদি ৫ শতাংশ করে দিতে পারতাম, তাহলে ৩০০ থেকে ৩৫০ কোটি টাকা আনতে পারতাম’। মেয়র আরও অভিযোগ করেন, ‘কয়েকদিন আগে একজন যুগ্ম সচিব মেয়রের সব কাজে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তবে বিনিময়ে তিনি একটি পাজেরো গাড়ি চেয়েছেন।’ মেয়র আরও অভিযোগ করেছেন, ‘বদ্দারহাটের বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত নতুন খাল খনন প্রকল্প একনেকে পাস হয়েছে অনেক আগে। এরপরও প্রশাসনিক অনুমোদন পেতে অনেক সময় চলে যাচ্ছে। ২০১৭ সালের জুনে এটির মেয়াদ শেষ হবে। আর দুই মাস পরই লেখালেখি শুরু হবে, মেয়র ব্যর্থ।’ অসহায় মেয়রের প্রশ্ন- ‘অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা ছাড় না দিলে কী করার আছে?’
মেয়রের অভিযোগের পরই তোলপাড় সরকারে, মন্ত্রণালয়ে। কোন কর্মকর্তা কোথায় কখন ঘুষ দাবি করেছেন, কে কোথায় কখন পাজেরো জিপ চেয়েছেন, কোন প্রকল্পের অর্থ ছাড়ে কোন কর্মকর্তা জটিলতা সৃষ্টি করেছেন, তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে উপযুক্ত প্রমাণ মন্ত্রণালয়ে দাখিল করতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে চট্টগ্রামের মেয়রকে ৭ দিনের সময় দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জ্যোতির্ময় দত্ত স্বাক্ষরিত চিঠিতে মেয়রের অভিযোগকে গুরুতর হিসেবে অভিহিত করে বলা হয়, তার অভিযোগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে।
চট্টগ্রামের মেয়র ৭ দিনের মধ্যে কী জবাব দেবেন, কী প্রমাণ দেবেন, জানি না। অভিযোগগুলো সত্য না মিথ্যা তাও জানি না। তবে তার অভিযোগগুলো শুনে অসত্য মনে হয় না। তার তিনটি অভিযোগের দুটি সুনির্দিষ্ট। মেয়রের কাছে ৫ শতাংশ টাকা চাওয়া হয়েছে। এবং কিভাবে তা ম্যানেজ করা যাবে, তারও উপায় বাতলে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় অভিযোগে, একজন যুগ্ম সচিব, একটি পাজেরো চেয়েছেন, বলা হয়েছে। তৃতীয় অভিযোগটি অতটা সুনির্দিষ্ট নয়, কিছুটা ঢালাও। আমলাতন্ত্রের ঐতিহাসিক লাল ফিতার দৌরাত্ম্যের নতুন উদাহরণ এটি। মেয়র আর কিভাবে তার অভিযোগ প্রমাণ করবেন, আমরা জানি না।
তবে শুরুতেই বলেছি, মেয়র যে অভিযোগ করেছেন, তা নতুন নয়, অস্বাভাবিক নয়। ইনফরমেশন হিসেবে এটা কতটা সত্য তাও প্রমাণিত নয়। তবে পারসেপশন হিসেবে এটা প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কোনও প্রমাণ ছাড়াই মেয়রের অভিযোগগুলো বিশ্বাস করবেন। আর এটা তো অজানা নয়, ধারণা কখনও কখনও সত্যেরই চেয়েও বেশি শক্তিশালী। হয়তো ৫ শতাংশ নয়, ৩ শতাংশ, হয়তো পাজেরো নয় টয়োটা। কিন্তু যে কোনও বরাদ্দ পেতে কিছু না কিছু লেনদেন করতে হয়, এটা সবাই জানে। আর এটা শুধু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে নয়, সব মন্ত্রণালয়েই কমিশন প্রথা প্রচলিত। শতাংশের হেরফের হতে পারে, তবে কমিশন ছাড়া কাজ হয় না, এটা হলো বাস্তবতা। বাইরের কাজ না হয় পরে। যারা সরকারি চাকরি করছেন, তারা বুকে হাত দিয়ে বলুন, মেয়রের অভিযোগ সত্যি না মিথ্যা? চাকরি পেতে টাকা লাগে। পোস্টিং পেতে টাকা লাগে। এমনকি পেনশনের টাকা পেতেও টাকা লাগে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টাকা আর টাকা। শিক্ষকরা ছাত্রদের নৈতিক শিক্ষা দেন। কিন্তু নিজের কোনও কাজে ঢাকা এসে শিক্ষা ভবনে গিয়ে পড়েন অন্তহীন দুর্নীতির কবলে। শিক্ষা ভবনে নাকি টাকা ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। তো শিক্ষা ভবনে নিজে ঘুষ দিয়ে কাজ হাসিল করে সেই শিক্ষক গ্রামে গিয়ে তার ছাত্রদের কী নৈতিক শিক্ষা দেবেন? সরকারি চাকজীবীদের বেতন নাটকীয়ভাবে বাড়ানোর পর অনেকে ভেবেছিলেন, এখন বুঝি দুর্নীতি কমে যাবে। কিন্তু আদৌ কমেছে কি? বেতন বাড়িয়ে আপনি চাহিদা পূরণের চেষ্টা করতে পারবেন। কিন্তু লোভের ভয়াল স্রোতে কি বাধা দিতে পারবেন? টাকাটা যতক্ষণ পর্যন্ত প্রয়োজন, ততক্ষণ আপনি চেষ্টা করতে পারবেন। কিন্তু যখন টাকা কামানোটা অভ্যাস, তখন বড্ড কঠিন। খাসলত যায় না ধুইলে।
কেউ ভাববেন না, শুধু সরকারি কর্মচারীরা দুর্নীতি করেন; এমন ধারণা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছি আমি। আমি জানি, বাংলাদেশে পদে পদে দুর্নীতি। এমনকি সাংবাদিকতা পেশাও এ থেকে মুক্ত নয়। কয়েকদিন আগে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিপাকে পড়েছিলেন তথ্যমন্ত্রী। থোক বরাদ্দের অর্ধেক এমপিরা খেয়ে ফেলেন, এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে জাতীয় সংসদে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। সব এমপিই অর্ধেক খেয়ে ফেলেন, এটা হয়তো সত্যি নয়; তবে অনেক এমপি যে এমনটা করেন, এটা তো সবাই জানেন। তথ্যমন্ত্রী তো আর তথ্য ছাড়া কথা বলেননি। কিন্তু বাংলাদেশে উচিত কথার ভাত নাই। তাই তথ্যমন্ত্রীকে ক্ষমা চাইতে হয়েছে।
আ জ ম নাছিরও যে ধোয়া তুলসি পাতা, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। আ জ ম নাছির হঠাৎ করে তার দলের সরকারের বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ প্রকাশ্যে আনলেন কেন? তিনি তো ব্যক্তিগত পর্যায়ে এটি মিটিয়ে ফেলতে পারতেন। মেয়রের নিশ্চয়ই সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ জানাতে পারতেন। তা না করে কেন তা প্রকাশ্যে আনলেন? আমার ধারণা, আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মেয়র নির্বাচিত হলেও, আঞ্চলিক রাজনীতির নানা সমীকরণে আ জ ম নাছির এখন কিছুটা কোণঠাসা। কিছুদিন আগে সরকার ঢাকার দুই মেয়রকে মন্ত্রী, রংপুরের মেয়রকে প্রতিমন্ত্রী এবং নারায়ণগঞ্জের মেয়রকে উপমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রামের মতো বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হয়েও আ জ ম নাছির কোনও মর্যাদা পাননি। হয়তো তার অভিযোগের পেছনে, এই অপ্রাপ্তিজনিত হতাশার কোনও প্রভাব থাকতে পারে।
থাকতেই পারে। কিন্তু একজন নির্বাচিত মেয়র যেহেতু অভিযোগ করেছেন, সরকারের উচিত হবে, অভিযোগটি খতিয়ে দেখে অভিযুক্তদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। এই অভিযোগ হতে পারে, আমাদের আমলাতন্ত্রে শুদ্ধি অভিযান চালানোর প্রাথমিক পদক্ষেপ। এরপর আস্তে আস্তে শুদ্ধি অভিযান চলুক, সব পর্যায়ে। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ, দেশ সম্ভব নয় জানি। তবে তাকে একটা সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতেই হবে। বাংলাট্রিবিউন
লেখক: অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ