তোফায়েল আহমদ::
কক্সবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ একেএম ফজলুল করিম চৌধুরীর সাথে কথা হচ্ছিল বৃহষ্পতিবার। আজ শনিবার উখিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের (উসউবি) ৬০ বছর পূর্তি উদযাপন পরিষদের অনুষ্টানে যাচ্ছেন কিনা জানতে চেয়েছিলাম তাঁর কাছে। তিনি উত্তর না দিয়েই বললেন, এক পুরানো কথা। বললেন, উত্তর চট্টগ্রামের একটি শিক্ষা প্রতিষ্টানে সবে বক্তৃতা দিতে উঠেছি। সম্বোধন শেষ করেছি মাত্র। অমনি পিছন থেকে একটি চিরকুট ধরিয়ে দেওয়া হল। আমি অবাক হলাম। চিরকুট দেওয়ার নিয়ম হচ্ছে বক্তার বক্তৃতা দীর্ঘ হলে, যদি কিনা শ্রোতাদের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় বা মসজিদে আজান হচ্ছে সহ আরো নানা কারনে। কিন্তু আমি মাত্র দাঁড়ালাম।
ব্যাপারটা এমন যে আমি কি হাসব-না কাঁদব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। ততক্ষণেও চিরকুট দেখিনি। দেখারই বা কি আছে। চিরকুট মানেইতো মাইক থেকে বিদায় নেওয়ার তাগিদ। মনকে সান্তনা দিতে পারছি না। মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে চিরকুটটি খুললাম। ওমা-চিরকুটে লেখা-‘স্যার ভাত চুলায় ,বক্তৃতা যতক্ষণ পারেন চালাইয়া যান।’ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লাম। মনে মনে বলি আমাকে কে আর পায়। একথা শুনে স্যারকে নিশ্চিত করলাম উসউবি’র পুণর্মিলনী অনুষ্টানের খাবার দেওয়া হচ্ছে প্যাকেটে। তাই এখানে চুলায় ভাত চড়াতে হবে না।
উসউবি-(উখিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) নিয়ে আমার ব্যক্তিগত একটি দুর্বলতা রয়েছে। আমিও উখিয়ার সন্তান। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি মরিচ্যা পালং জুনিয়র হাই স্কুলে। নবম শ্রেণীতে আমি ভর্ত্তি হই কসউবিতে (কক্সবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়)। গত ডিসেম্বরেই কসউবি’র ১৪২ বছর পূর্তি উদযাপন করা হয়েছে। আমি ১৯৭৭ সালে শুরু করি সাংবাদিকতা। সাপ্তাহিক কক্সবাজার এবং চট্টগ্রামের অধুনালুপ্ত ‘দৈনিক মিছিল’ নামক একটি দৈনিক পত্রিকা নিয়ে। উখিয়া হাই স্কুলে তখন উন্নয়ন কর্মকান্ড চলছিল। কক্সবাজার থেকে জীবনের প্রথম সরেজমিন সংবাদের জন্য উখিয়া হাই স্কুলে যাওয়া । স্কুলের প্রধান শিক্ষক মরহুম কাজী নুরুল কবির (উসউবি’র ৬০ বছর পূর্তি উদযাপন পরিষদের মহাসচিব কাজী হেলাল উদ্দিনের পিতা) আমার পিতৃপরিচয় শুনে বললেন-দুপুরের খাবার তাঁর ঘরে এক সাথে খেতে হবে। একজন ক্ষুদে সাংবাদিক হিসাবে প্রধান শিক্ষক কাজী নুরুল কবির সাহেবের আতিথেয়তাটিকে দেখেছিলাম এক ‘বড় পাওয়া’ হিসাবে। সেই নেশায় পড়ে আমার সাংবাদিকতা আজ চার দশকের কাছাকাছি সময়ে।
আমার জন্মেরও আগে ১৯৫৭ সালে স্থাপিত উখিয়ার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্টান-উসউবি অর্থাৎ উখিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। তারও এক দশক আগে স্থাপিত পালং মডেল হাই স্কুল। এই যে সেদিন ৭০ বছর পূর্তি উদযাপন করা হয়েছে বেশ জাঁকজমক অনুষ্টানের মাধ্যমে। পালং মডেল হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম হোছাইন আলী মাতব্বর প্রকাশ হোছন মাতব্বর। যিনি চিরতরে শুয়ে আছেন স্কুলটির সদর গেইটে। নিশ্চয় এই কৃতি পুরুষ দেখছেন, তাঁর প্রতিষ্টিত বাতিঘরটিতে এসে শিক্ষা নিয়ে পাড়া থেকে জেলায় আর দেশ থেকে দেশান্তরে কিভাবে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন কৃতি শিক্ষার্থীরা। বাতিঘরটির অগনিত সংখ্যক কৃতি শিক্ষার্থীর মধ্যে মোহাম্মদ শফিউল আলমও একজন। যিনি বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদেরই সর্বোচ্চ স্থান মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্টানের আলো ছড়াতে দেখে নিশ্চয়ই চির শান্তিতে থাকবেন মরহুম হোছাইন আলী মাতব্বর-আপনি মহান শিক্ষা ব্রতী।
এবার ‘শিকড়ের টানে প্রিয় প্রাঙ্গণে’ শ্লোগানে গৌরবের ৬০ বছর পূর্তি অনুষ্টান উদযাপন করা হচ্ছে আজ উখিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে-উসউবি। গৌরবময় এই প্রতিষ্টানের প্রতিষ্টাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন উখিয়ার কুতুপালং বড়–য়া পাড়ার জমিদার বাড়ীর সন্তান বাবু ক্ষেমানন্দ বড়–য়া। যিনি ছিলেন ১৯২১ সালের তদানীন্তন কক্সবাজার মহকুমার প্রথম গ্রাজুয়েট। যিনি গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি নিয়ে এলাকায় আসার পর দুরদুরান্তের অনেক লোকজন ভাতের মোচা নিয়ে দেখতে এসেছিলেন। স্কুলের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষকের পুত্র অরবিন্দু বড়–য়াও এই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তিনি জানান,তার বাবা ক্ষেমানন্দ বড়–য়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল্ডমেডালিষ্ট। ক্ষেমানন্দ বড়–য়া স্কুল থেকে বেতন নিতেন বাম হাতে আবার সেই বেতন ডান হাতে দান করতেন স্কুলেই। অর্থাৎ বাম হাত ব্যবহার করতেন নিজের জন্য, আর ডান হাতটি সার্বজনীন। এমন শিক্ষাগুরুর এরকম শিক্ষা অমর হোক।
শিক্ষক অরবিন্দু বড়–য়া এই স্কুলের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। তারা ১৯৬৬ সালে একই সাথে একজন ছাত্রী সন্ধ্যা রাণী দে সহ ৭ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়ে সবাই পাশ করেছিলেন। এর আগের বছর প্রথম ব্যাচে ৬ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছিরেন সবাই। অরবিন্দু বড়–য়া ছিলেন ধর্মীয় শিক্ষক। কিন্তু তিনি পারদর্শী ছিলেন সকল ধর্ম বিষয়েই। উসউবি’র দুই প্রাক্তন শিক্ষার্থী সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম এবং এডভোকেট আইয়ুবুল ইসলাম জানালেন, ইসলাম ধর্মের শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে অরবিন্দু বড়–য়াই ধর্মের ক্লাশ নিতেন। শিক্ষক অরবিন্দু স্মৃতি চারণ করে বলেন-‘নিজের চোখেই দেখা মরহুম মকবুল আহমদ সিকদার, আমার বাবা ক্ষেমানন্দ বড়–য়া, ডাক্তার অরুন বড়–য়া, বদিউর রহমান সিকদার, আমিন শরিফ ভুঁইয়া, কাজি সিরাজুল কবির ও গুরা মিয়া প্রমুখ নিজের হাতেই স্কুলটির মাটি কেটেছেন। আমরা তখন স্কুলের ষষ্ট/সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম।’ একটি বাতিঘর গড়ে তোলার জন্য কি রকম ত্যাগ-তিতিক্ষা। অবসর প্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক অরবিন্দু বড়–য়া নিজেও বিরক্তি হচ্ছিলেন-একটা বিষয়ে বার বার জানতে চাওয়ায়। কেননা উখিয়া উপজেলার সেরা মানুষগুলোই কিনা একটি স্কুল স্থাপনের জন্য নিজেরাই কোদাল হাতে নিলেন ? তাহলে এ অধমরা সমাজের জন্য কিইবা করছেন ? স্কুলের প্রতিষ্টালগ্নে বহু প্রতিভার অধিকারী জগদানন্দ বড়–য়া এবং আরো পরে দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকার সম্পাদক ও কক্সবাজার প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আলহাজ্ব মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম সহ আরো অনেক গুণি ব্যক্তি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
উসউবি’র অবসর প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক টেকনাফের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা আবদুস শুকুর মাষ্টার এখন বার্ধক্যে আক্রান্ত। উখিয়া হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে তিনি যোগ দিয়েছিলেন ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে। স্কুলের পরিচালনা কমিটিতে দুই মেরুর দুই প্রভাবশালী শাহজাহান চৌধুরী ও মরহুম নুরুল ইসলাম চৌধুরী প্রকাশ ঠান্ডা মিয়া সদস্য। মরহুম নুরুল ইসলাম চৌধুরী প্রকাশ ঠান্ডা মিয়া বাস্তবে কিরকম শিক্ষানুরাগি ব্যক্তি ছিলেন তার দু’টি ঘটনা নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন মাষ্টার শুকুর। উখিয়া হাই স্কুলের একটি বিষয় নিয়ে প্রধান শিক্ষককে জরুরি কুমিল্লা বোর্ডে যেতে হবে। পরের দিন সকালেই তিনি (প্রধান শিক্ষক) রওয়ানা দিবেন-এরকমই সিদ্ধান্ত নেয়া হল। ইত্যবসরে ওইদিনই ইন্তেকাল করলেন ( ১৯৮৬ সালে) মরহুম ঠান্ডা মিয়ার পিতা বদিউর রহমান সিকদার। পিতার মৃত্যুর পর তিনি (ঠান্ডা মিয়া) প্রধান শিক্ষক শুকুর সাহেবকে ডেকে বললেন-সকালে জানাযা ফেলে বোর্ডে রওয়ানা দেওয়া ভাল হবে না। বরং জানাযা আমরা পড়ব আপনি আজই (জানাযার আগের দিন) উখিয়া ছেড়ে গিয়ে কক্সবাজার শহরে রাত কাটিয়ে সকালে গাড়িতে উঠুন বোর্ডের উদ্দেশ্যে। এ প্রসঙ্গে মাষ্টার শুকুর সাহেব বললেন, নিজের পিতার জানাযায় অংশ নেওয়ার চাইতেও স্কুলের কাজটিকেই বড় মনে করেছিলেন-শিক্ষাব্রতী মরহুম নুরুল ইসলাম চৌধুরী ঠান্ডা মিয়া।
আরেকটি ঘটনার কথা প্রসঙ্গে মাষ্টার শুকুর সাহেব জানালেন, উখিয়া সদরের হাট (দারোগা বাজার) নীলাম হবে কক্সবাজারে। পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্ত মতে ঠান্ডা মিয়া সাহেব প্রধান শিক্ষক শুকুর সাহেবকেই কক্সবাজার যেতে বললেন। বাজারটির নীলাম নেওয়ার পর এক লাখ টাকা স্কুল তহবীলের জন্য পাওয়া গেল। খরচের জন্য মাষ্টার সাহেব হাজার তিনেক টাকা ওই এক লাখ টাকা থেকে বের করে নিলেনও। হোটেল সায়মানে রাতে রুম ভাড়া নিয়ে ছিলেন তারা। মাষ্টার সাহেব বাজার নীলামের প্রাপ্ত টাকা থেকে রুম ভাড়া দিতে চাইলেন। কিন্তু মরহুম নুরুল ইসলাম চৌধুরী ঠান্ডা মিয়া বললেন, রুম ভাড়ার টাকা আমি দেব স্কুলের টাকা খরচ করবেন না। এক সাথে এত টাকা আয়ের পরেও স্কুলের কাজে গিয়ে টাকা খরচ করতে বারণ করার এমন একজন শিক্ষানুরাগি নুরুল ইসলাম চৌধুরী ঠান্ডা মিয়া এ সমাজে আর জন্ম নেবেন ?
সেই আমলে মরহুম মকবুল আহমদ সিকদার (সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী ও সরোয়ার জাহান চৌধুরীর দাদা) এবং বদিউর রহমান সিকদার (আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরীর পিতা এবং জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর দাদা) মিলেমিশে শিক্ষার বাতিঘর স্থাপন করেছেন। রাজাপালং সিনিয়র মাদ্রাসাটিও মরহুম মকবুল আহমদ সিকদারের অবদানে গড়া। এই আমলেও উখিয়ার দুই পরিবার কিন্তু পিছিয়ে নেই। মরহুম মকবুল আহমদ সিকদারের উত্তরাধিকারের সদস্যরা আবুল কাশেম-নুরজাহান চৌধুরী হাই স্কুল, উখিয়া কলেজ সহ আরো অন্যান্য প্রতিষ্টান স্থাপনের মাধ্যমে এলাকা আলোকিত করার চেষ্টা করছেন। অপরদিকে মরহুম বদিউর রহমান সিকদারের উত্তরাধিকারের সদস্যরা নারী শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষা দিয়ে সমাজকে এগিয়ে নিতে চেষ্টা করছেন নুরুল ইসলাম চৌধুরী টেকনিক্যাল কলেজ ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মহিলা কলেজ সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্টান স্থাপনের মাধ্যমে। স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতি ও সামাজিক স্থানেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন উখিয়ার ঐতিহ্যবাহী এই দু’টি পরিবারের উত্তরাধিকারীগন। এমনকি উখিয়ার এমন আলোকিত ব্যক্তিরাও সবাই উসউবি’র প্রাক্তন ছাত্র। তবে তাদের মধ্যেকার ব্যবধান কেবল উখিয়া ষ্টেশনের উত্তরে বিএনপি- জামায়াত পরিবার আর দক্ষিণ মুল্লুকে আওয়ামী লীগ পরিবারের বসতি। তবুও আজ ‘শিকড়ের টানে প্রিয় প্রাঙ্গণে’ উসবি’র প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা একত্রে গাইবেন- ‘কালো আর ধলু-বাইরে কেবল, ভিতরে সবারি সমান রাঙ্গা।’
লেখক-তোফায়েল আহমদ, কক্সবাজারে কর্মরত দৈনিক কালের কন্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার এবং আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) ও বিবিসি’র স্ট্রিঙ্গার। ঃড়ভধুবষপড়ী@ুধযড়ড়.পড়স