হুমায়ুন কবির জুশান, উখিয়া নিউজ ডটকম::
সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় আমার জীবনে কালো অধ্যায় নেমে আসে। দুর্ঘটনার পর শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। তখন অনেক রক্তের প্রয়োজন দেখা দেয়। ওই সময় বহু লোক রক্ত দিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে তোলেন। কিন্তু এখন বেঁচে থেকেও মৃত। শুধু আমার একার নয়, পরিবারের তিনজনই এখন এইচআইভি প্রজেটিভে আক্রান্ত। প্রথমে আমার শরীরে এই রোগ ধরা পড়ে। মনে হচ্ছে-ওই রক্ত থেকেই আমার শরীরে এইচআইভি প্রজেটিভ বাসা বেঁধেছে। এই রোগ ধরা পড়ায় আমাকে সৌদি আরব থেকে চলে আসতে হলো। এখানে এসে মা-বাবা ও আত্নীয়-স্বজনেরা আমার জন্যে পাত্রী খোঁজতে লাগলেন। অবশেষে টেকনাফ থেকে আমাকে বিয়ে করানো হলো। বিয়ের ৬ মাস যেতে না যেতেই আমি দুর্বল হতে থাকি। সারাক্ষণ গায়ে জ্বর এবং পাতলা পায়খানাসহ নানা সমস্যায় ভোগী। আমার দুর্ঘটনা এবং দুর্বলতার কথা স্ত্রীকে খোলে বলি। এইচআইভি প্রজেটিভ শুনেই স্ত্রী তার বাপের বাড়িতে চলে যায়। তখন আমার স্ত্রী সন্তান সম্ভাবা ছিল। স্ত্রী-সন্তান এবং আমিসহ তিনজনই এখন এইচআইভি প্রজেটিভে আক্রান্ত। পরে বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনা এলাকায় জানাজানি হলে, আমাকে সবাই ঘৃণা করতে থাকে। আমার পরিবারের ভাই বোনসহ সকলেই মিলে আমাকে আলাদা করে দেয়।আমার খাবার গ্লাস এবং প্লেট আলাদা। ঘরের একটি রোমে অপরাধীর মতো একা একা থাকতাম। সেই সময়ে উখিয়ার সামাজিক সংগঠন কেন্দ্রীয় ফেমাস সংসদের নেতৃবৃন্দ আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। ইউএনএফপিএর ড. নুর মোহাম্মদসহ ফেমাস নেতৃবৃন্দ আমার পরিবারের লোকজনের সাথে কথা বলেন, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সামনে আমি যে গ্লাসে পানি খেতাম সেই গ্লাসের পানি একজন পান করেন। কি কি কারণে এইচআইভি এইডস ছড়ায় আর কি কি কারণে এইচআইভি এইডস ছড়ায় না তা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করলেন। সেই থেকে আমি ঢাকায় গিয়ে সেবা নিচ্ছি। কথাগুলো বলছিলেন উখিয়া রাজাপালং ইউনিয়নের টাইপালং গ্রামের তোফাইল আহমদ ( ছদ্মনাম)। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের লাইলা বেগম ( ছদ্মনাম) বহু বছর আগে মিয়ানমার থেকে এদেশে পালিয়ে এসেছেন। সে দুষ্ট লোকের ফাঁদে পড়ে কক্সবাজার অভিজাত হোটেলে পরপুরুষের সাথে রাত্রি যাপন করে। কুয়েত থেকে আসা এক পর্যটকের সাথে লাইলা টাকার বিনিময়ে পাঁচ দিন সময় কাটায়। এক দালালের মাধ্যমে ২০০৩ সালে সে কুয়েত চলে যান।২০০৯ সালে দেশে ফিরে আসেন। ২০১৫ সালে তার এই রোগ ধরা পড়ে। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন। তার আরেক বান্ধবী সেলিনা আক্তারও এইচআইভি রোগে আক্রান্ত বলে তিনি জানান। কেন্দ্রীয় ফেমাস সংসদের সিনিয়র সহ সভাপতি মোহাম্মদ নুরুল আলম বলেন, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এইচআইভি এইডস আক্রান্ত অনেক রোগী আছে বলে আমাদের ধারনা।। পাশাপাশি বিদেশে অবস্থানকারী এখানকার অনেক প্রবাসি ভাইদেরও এইচআইভি এইডস ধরা পড়েছে। তারা অনেকে পরিবারের সাথে থাকলেও আত্নীয়স্বজনদের বলতে পারছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমনই একজন এইচআইভি প্রজেটিভ আক্রান্ত। তিনি অভিযোগ করেন, ডাক্তাররাও এই রোগকে ভয় পান। হাসপাতাল থেকে তাড়িয়ে দেন। কারো কাছে প্রকাশ করতে পারি না। মনে অনেক কষ্ট নিয়েই বেঁচে আছি। জীবিত থেকেও মৃত। তিনি জানান, ইআরবি নামের ওষুধ তাদের ফ্রি দেয়া হয়। এই ওষুধুট যাতে সহজভাবে নিতে পারেন, তার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি। ২০১৭ সালের বিশ্ব এইডস দিবসের এক আলোচনায় আলোচকরা বলেন, দেশে এই পর্যন্ত ১১ হাজার ৭০০ জন এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী রয়েছেন। ৭৯৯ জন মারা গেছেন। এই হিসাব ১৯৮৯ থেকে। ২০১৭ সালে এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত সংখ্যা ৫ শতাধিক। মারা গেছে শতাধিক, যা অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। অন্যান্য বছর এই সংখ্যা ৪০০,৪৫০ ছিল। ২০১৬ সালে এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৭৮ জন। মারা গেছেন ১৪১ জন। বর্তমানে দেশে এইচআইভি শনাক্তকরণ কার্যক্রম সরকারি ১২ টি হাসপাতালের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, যার মধ্যে ৪ টি সরকারি হাসপাতাল থেকে এইডস আক্রান্ত রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। বাল্য বিবাহ যৌতুক ও এইচআইভি এইডস নিয়ে কাজ করেছেন এমন এক এনজিও কর্মী বলেন, যারা এইচআইভি প্রজেটিভ বহন করছেন, তাদের টেককেয়ার করতে হবে। না হলে তারা অন্ধকারে চলে যাবেন। এই ভাইরাস ছড়াবেন। তিনি আরো জানান, সরকারকে এনজিওদের নিয়ে কাজ করতে হবে। জাতিসংঘের এইডস বিষয়ক শাখার এক তথ্য মতে, সারা বিশ্বের তিন কোটির ওপর মানুষ এইডস আক্রান্ত। ২০১৪ সালে ২০ লাখ প্রাপ্ত বয়স্ক ও শিশু এইডস আক্রান্ত হয়েছে।এইডসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্ব সম্প্রদায় ১৯৮৮ সাল থেকে বিশ্ব এইডস দিবস পালন করে আসছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ মিলিয়ন মানুষ এ রোগে মৃত্যুবরণ করেছে বিশ্বে। এইডস আক্রান্ত দেশের মধ্যে অন্যতম কম্বোডিয়া। কেন্দ্রীয় ফেমাস সংসদের সাবেক কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী বুলবুল আক্তার চৌধুরী মনি কম্বোডিয়া সফর করেছেন। তিনি বলেন, সেরা পর্যটন নগরী আমাদের কক্সবাজারে বিদেশি পর্যটকরা এখানে বেড়াতে আসেন। তাই এদের মাধ্যমেও এইচআইভি ভাইরাস ছড়াতে পারে। তাছাড়া রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা হওয়ার কারণে কক্সবাজার এইডস ঝুঁকিতে রয়েছে।
এইডস কী এবং এইচআইভি কী: এইচআইভি একটি ভাইরাসের ছোট নাম। হিউমেন ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস থেকে নাম হয়েছে এইচআইভি। এই ভাইরাসটা মানুষের শরীরে সংক্রমণ হলেই রোগ হয়ে যায় না। সংক্রমণ হয়ে রোগ হতে অনেক বছর লাগে। ১০ থেকে ১৫ বছর বা ২০ বছর পর এই রোগ হয়। এজন্য যাদের এইচআইভি আছে, তাদের অনেকের ক্ষেত্রে কোনো রোগ নেই। এই এইচআইভি ইনফেকশনের কারণে যখন কতগুলো লক্ষণ শরীরের মধ্যে দেখা দিতে শুরু করে-সেটা জ্বর, ওজন কমে যাওয়া, ডায়রিয়া হওয়া, টিবি রোগ হওয়া। এইচআইভির কারণে যখন মানুষের মধ্যে এই রোগ গুলো দেখা দেয়, তখন একে এইডস বলে। এর মানে এইচআইভি পজিটিভ কেউ হলেও তার মধ্যে এটি কেরিয়ার (বহনকারী) হিসেবে থাকছে, তখন এটি রোগ নয়। যখন এটা রোগে পরিণত হচ্ছে, তখন একে এইডস হিসেবে ডাক্তাররা উল্লেখ করেন। বাংলাদেশে রিকশাচালকদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ লোক এইডস কীভাবে ছড়ায় তা জানে না।
একজন মানুষ থেকে অন্য মানুষের শরীরে এইচআইভি কীভাবে ছড়ায়: এর তিনটি পদ্ধতি রয়েছে। একটি হলো, দুজন মানুষের শারীরিব মিলনের মাধ্যমে। দ্বিতীয়, ইনজেকশনের মাধ্যমে হতে পারে, ইনজেকশন যদি শেয়ার করে বা রক্ত দেয়ার মাধ্যমে হতে পারে। তিন নম্বর হচ্ছে, মায়ের থেকে সন্তানের হতে পারে। মা যদি এইচআইভি পজেটিভ হয়, তখন এটি হতে পারে, তাও এর সম্ভাবনা খুব কম। ১০০ ভাগের এক ভাগও নয়।, দশমিক পাঁচ শতাংশের মধ্যে পড়ে গেলে সন্তানেরও এইচআইভি পজেটিভ হতে পারে। যৌন কার্যক্রমের মধ্যে নারী, পুরুষ, সমকামীদের মধ্যে এইচআইভি ছড়িয়ে পড়ার হার বেশি বলে ডাক্তাররা জানিয়েছেন।