মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে একের পর এক এইডস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ায় কক্সবাজারসহ সারা দেশে এইডস বিস্তারের ঝুঁকি বাড়ছে।
এ পর্যন্ত এইডস আক্রান্ত ৯৭ রোহিঙ্গাকে শনাক্ত করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, চার হাজার রোহিঙ্গা এইডস আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারে। এইডস আক্রান্ত অনেক রোহিঙ্গা নির্দিষ্ট ক্যাম্পে আশ্রয় না নিয়ে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে।
কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেল, মোটেল, গেস্ট হাউস ও আবাসিক ভবনে রোহিঙ্গা নারীদের যৌনকর্মী হিসেবে ব্যবহার করছে স্বার্থান্বেষী মহল। এ কারণে এইডস ভাইরাসের জীবাণু সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে আজ বিশ্ব এইডস দিবস পালিত হতে যাচ্ছে।
দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হল- ‘স্বাস্থ্য আমার অধিকার (Right to health)। দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা প্রশাসনের সহায়তায় কক্সবাজারের উখিয়া ও কুতুপালংয়ে আশ্রয় পাচ্ছে। তবে অনেক রোহিঙ্গা প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্পের বাইরে আশ্রয় নিচ্ছে।
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ আশপাশের জেলায় তারা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের কাছেও তারা আশ্রয় নিচ্ছে। পুরনো রোহিঙ্গারা স্থানীয় প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে নানা রকম অবৈধ ও অনৈতিক কাজে লিপ্ত রয়েছে।
কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও বিভিন্ন এলাকায় ইতিমধ্যে অভিযান চালিয়ে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গাকে আটক করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছে পুলিশ।
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত এলাকার বিভিন্ন হোটেল, মোটেল, গেস্ট হাউস ও আবাসিক ভবনে রোহিঙ্গা নারীদের যৌনকর্মী হিসেবে ব্যবহার করছে স্বার্থান্বেষী মহল। অভাব অনটনে এ কাজে রোহিঙ্গা নারীরাও বাধ্য হচ্ছে। এ কারণে কক্সবাজারে ছড়িয়ে পড়ছে এইডস।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানান, কক্সবাজারের সাড়ে তিনশ’ হোটেল, মোটেল, গেস্ট হাউস ও কটেজ রয়েছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারীদের এসব হোটেল-মোটেলে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে এইডস আক্রান্তরাও রয়েছে। তাদের সঙ্গে পর্যটকসহ হোটেল-মোটেল শ্রমিকদের শারীরিক মেলামেশায় এইডস দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এর মাধ্যমে সারা দেশে এইডস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, পালিয়ে আসা এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এইডস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, এইডস আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয় অনেকে যৌনকর্ম করায় দেশে এইচআইভি ভাইরাস ছড়াচ্ছে।
কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. আবদুস সালাম যুগান্তরকে বলেন, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে এ পর্যন্ত (২৯ নভেম্বর) ৯৭ জনের এইচআইভি ধরা পড়েছে। তাদের মধ্যে ৯২ জন আগে থেকেই আক্রান্ত ছিল। নতুন করে চিহ্নিত হয়েছে পাঁচজন। তিনি বলেন, এইডস আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করতে টেকনাফ ও উখিয়ায় দুটি ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। সাধারণ রোগের চিকিৎসায় রক্ত পরীক্ষা করিয়ে অনেকের শরীরে এইডস পাওয়া গেছে। তিনি আরও বলেন, তবে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকায় অনেকের রক্ত পরীক্ষা করা যাচ্ছে না।
এদিকে ন্যাশনাল এইডস এসটিডি প্রোগ্রামের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১১ হাজার ৭০০ জন। এর মধ্যে নতুন শনাক্ত হয়েছে ৮ হাজার ১২১ জন এবং মৃত্যু ঘটেছে ১৪১ জনের। চলতি বছর নতুন করে ৮০০ জন শনাক্ত হয়েছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৫৭৮ জন। সারা দেশে এ পর্যন্ত এ রোগে ৭৯৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এইডস আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা যাবে না। বরং তারা যেন অবাধ মেলামেশায় জড়িয়ে না পড়ে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, এইচআইভি জীবাণু শরীরের বাইরে বেশিক্ষণ বাঁচে না। এ কারণে সরাসরি রক্ত বা যৌন নিঃসরণ শরীরে প্রবেশ না করলে এইচআইভি সংক্রমণের আশঙ্কা কম।
ন্যাশনাল এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, পালিয়ে আসা এইডস আক্রান্ত ৯২ রোহিঙ্গার জীবাণু আগেই ধরা পড়ে এবং তাদের নিয়মিত ওষুধ ও সেবা দেয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, নতুন করে আরও পাঁচজন শনাক্ত হয়েছে। তিনি বলেন, আইনি বাধার কারণে কাউকে না জানিয়ে এইচআইভি/এইডস পরীক্ষা করা যায় না। তাই রোহিঙ্গাদের ভেতর নতুন রোগী শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এ ক্ষেত্রে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা যেহেতু নির্দিষ্ট স্থানে আবদ্ধ থাকছে, অনুমতি ছাড়া সেখান থেকে তারা বের হতে পারছে না, তাই এটি ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ কম।
বিশ্ব এইডস দিবস উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আগামী ৬ ডিসেম্বর রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
এইডস নির্মূলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসার আহ্বান : এইডস নির্মূলে সরকারি কার্যক্রমের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সহযোগী ও অন্য সংস্থাগুলোকে কার্যকরী ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, নিয়ন্ত্রিত জীবন ব্যবস্থা, মাদক বর্জন, নৈতিকতার উন্নয়ন, ধর্মীয় অনুশাসন ও যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমেও বাংলাদেশকে এইডস থেকে ঝুঁকিমুক্ত করতে হবে। বিশ্ব এইডস দিবস-২০১৭ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার দেয়া এক বাণীতে তিনি এ আহ্বান জানান।