শাহীন মাহমুদ রাসেল।
রোহিঙ্গা সমস্যা নতুন কোনো সমস্যা নয়, তবে এ সমস্যা বহুমাত্রিক রূপ নিয়ে আবির্ভূত হচ্ছে বারবার। ১৯৪২ সালে জাপান-ব্রিটিশ যুদ্ধের সময় রোহিঙ্গারা ব্রিটিশের পক্ষে থাকায় জাপানি সৈন্যদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে সর্বপ্রথম প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে চলে আসে। ১৯৬৫ সালে জাতিগত দাঙ্গার কারণে এবং ১৯৭৭ সালে সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়নে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ১৯৮২ সালে কেড়ে নেওয়া হয় তাদের নাগরিকত্ব। এরপর ১৯৯১, ১৯৯২ ও ১৯৯৪ সালে দফায় দফায় রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটলেও জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় এবং দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় তাদের ফেরত পাঠানো হয়। তবে প্রত্যাবাসনে ফাঁকি দিয়ে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা থেকে যায় এ দেশে। কিন্তু ২০১২ সালে নতুন করে যোগ হয় সন্ত্রাসবাদ ইস্যু। এ সময় প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গাদের সঙ্গে উগ্র বৌদ্ধদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে এবং প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গারা ফের অনুপ্রবেশ করে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে পুলিশকে হত্যা করার অভিযোগ ওঠে এবং ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট একই অভিযোগে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কঠোর দমন-পীড়নে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
রাখাইন রাজ্যে বংশপরম্পরায় রোহিঙ্গারা বসবাস করলেও মিয়ানমার সরকারের কাছ থেকে নাগরিকত্ব আদায়ে তারা ব্যর্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিশ্বও এতদিন এই অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে নাগরিকত্ব পরিচয়ের জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। সেই কফি আনান কমিশনও অকার্যকর ছিল, জাতিসংঘও ব্যর্থ হয়েছে। নতুন করে মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করতে অমানবিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক তৎপরতা দিয়ে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে কতটুকু সফল হবে, তা আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। মিয়ানমার বাংলাদেশের চেয়ে আড়াই গুণ বড় একটি দেশ। দেশটিতে রোহিঙ্গা ছাড়াও শান, কাচিন, চীন, কারেন ইত্যাদি আরও বহু জাতিগোষ্ঠী নিয়ে পৌনে তিন কোটি লোকের বসবাস। এত বড় একটি দেশে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর যেখানে ঠাঁই হচ্ছে না, সেখানে আমাদের এই জনবহুল ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে তাদের ঠাঁই দেওয়াটা যাতে নিতান্তই মানবিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, অন্যথায় এর বাস্তবতা আমাদের ভোগ করতে হবে অচিরেই।
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে এখন বলছে, নাগরিক নয় এমন মানুষদের ফেরত নেবে না। আন্তর্জাতিক পরিসরে নিন্দিত হওয়ায় আবার বলছে, তারা যাচাই করে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে, যা দ্বৈত নীতির শামিল। মোট কথা, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়; অতএব তাদের ফেরত নেওয়া হবে না। রোহিঙ্গারা যাতে তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে না পারে সে জন্য মিয়ানমার তাদের সীমান্তে ইতিমধ্যে মাইন পুঁতে রেখেছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে স্পষ্টভাবে এই বার্তা দিতে হবে যে, অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ নিতান্তই মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু এ অবস্থা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন মেনে নিতে পারে না। অন্য দেশ থেকে অবৈধভাবে ঠেলে দেওয়া মানুষের বোঝা এভাবে কোনো দেশই গ্রহণ করতে পারে না। আমাদের মূল লক্ষ্য হবে একটিই- তাদের পিতৃভূমিতে ফেরত নেওয়ার জন্য মিয়ানমারকে বাধ্য করা। আমাদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, যাতে সুন্নত পালন করতে গিয়ে ফরজ ছুটে না যায়। যদি সংশ্নিষ্ট সব মহল এখনই সরব না হয় এবং কার্যকর ভূমিকা না রাখে, তাহলে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে।
বাংলাদেশ এমনিতেই একটি জনবহুল দেশ। যেখানে চিকিৎসা, শিক্ষাসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনায় হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে বাড়তি এই বোঝা নতুন নতুন সংকটের সৃষ্টি করতে পারে। বন্যায় সৃষ্ট সংকট কাটতে না কাটতেই রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন সংকট সৃষ্টি করেছে। আমাদের নিজেদের সমস্যার কোনো অন্ত নেই। আমরা এখনও বেকারত্ব ঘোচাতে পারিনি। দারিদ্র্য দূর করতে পারিনি। আমরা এখনও পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার পুরোপুরি সমাধান করতে পারিনি। সাম্প্রদায়িক সমস্যা বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নিরাপত্তা দিতে যেখানে অনেক বেগ পেতে হয়, সেখানে নতুন করে একটি জাতিগোষ্ঠীর বোঝা আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংকট সৃষ্টি করবে। জঙ্গিবাদ সমস্যায় দেশ যখন সাফল্যের দিকে, তখন এই উগ্র গোষ্ঠীর অবস্থান নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
বাংলাদেশে বর্তমানে যেসব রোহিঙ্গা অবস্থান করছে, তারা নিজেদের অধিকার আদায়ে মোটেই ঐক্যবদ্ধ নয়- তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কারণ তারা এখানে আরাকানের চেয়ে আপাতত সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। রোহিঙ্গাদের আত্মমর্যাদার অভাব, আমাদের অতিথিপরায়ণতা, আশ্বাস, দেশি-বিদেশি ত্রাণ তৎপরতা তাদের অনেকটাই নির্ভরশীল করে তুলছে। এক সময় যখন তাদের সাহায্য-সহযোগিতা কমে আসবে এবং মানবেতর জীবনযাপনের আশঙ্কা দেখা দেবে, তখন তারা বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়বে, যা অনেকটাই দৃশ্যমান। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা তাদের অবস্থান উপলব্ধি করে দেশের ভেতরে বাসা বাঁধতে চাইবে। এ জন্য তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে সুযোগ নেবে। স্থানীয়দের বিয়ে করে স্থায়ী হতে চাইবে, যা তাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য। এরা সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও পাহাড়ি অঞ্চল দখল করে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। এতে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এসব জেলার শ্রমবাজারও রোহিঙ্গাদের দখলে চলে যাবে, এতে স্থানীয় মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। এ ছাড়া বিপুল এই জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা মেটাতে খাদ্য সংকট ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতার আশঙ্কা রয়েছে। কক্সবাজার ঘিরে পর্যটন কেন্দ্রের বিকাশ নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে বাধাগ্রস্ত হবে। দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে বরং শরণার্থীরাই এলাকাভিত্তিক সমাজ ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। নিজেদের অধিকার আদায়ে এক সময় বাংলাদেশিদের ওপর আক্রমণ চালাবে। জাতিগত বিভেদ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি বয়ে আনবে। রোহিঙ্গারা একটি ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষার জাতিগোষ্ঠী হওয়ায় তারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
নিরাপত্তা বিশ্নেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়া বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। এ অঞ্চলে ট্রানজিশনাল টেররিজম বহু যুগ ধরে। খোলা বা অনিয়ন্ত্রিত বর্ডার, ধর্মীয় এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী থাকায় এই অঞ্চলটিতে সন্ত্রাসী নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়েছে। ক্রসবর্ডার সুবিধার কারণে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে এশিয়ার এই অঞ্চলটি। সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অতটা প্রকট নয়। কিন্তু প্রকট রোহিঙ্গাদের মধ্যে। ধর্মীয় অনুশাসন পালনে তারা কঠোর। শুধু পরিবার-পরিকল্পনার ক্ষেত্রে নয়, ধর্মের সব অনুশাসনের ক্ষেত্রেই তারা উগ্র। এই উগ্রতার সুযোগ নিয়ে তাদের মধ্যে আরও উগ্র মতাদর্শ ছড়িয়ে দিতে শুরু করবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নানা ধর্মীয় উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠন।
রাজনৈতিক বিশ্নেষকদের মতে, রোহিঙ্গা সংকট সামনে রেখে বিশ্ব রাজনীতিতে ভিন্ন বার্তা বহন করছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ যে একটি সুপরিকল্পিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, তা ইতিমধ্যেই অনুমান করা গেছে। বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে রোহিঙ্গা ইস্যুকে কাজে লাগাতে তৎপর হতে পারে বিভিন্ন মহল। আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে রেখে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা চালানো অসম্ভবের কিছু নয়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের ইন্ধনে রোহিঙ্গারা যদি কক্সবাজার অঞ্চলে বসবাসরত বৌদ্ধদের উৎখাতের ষড়যন্ত্র করে, তা সামাল দেওয়া মুশকিল হবে। রামু ট্র্যাজেডি বেশিদিন আগের কথা নয়। এই ট্র্যাজেডির নেপথ্যে যে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ছিল না, স্থানীয়দের সঙ্গে রোহিঙ্গারাও জড়িত ছিল না, তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।
গত ৩ অক্টোবর ২০১৭ মিয়ানমারের মন্ত্রী বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার যে আশ্বাস দিয়েছেন তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে মিয়ানমারের ওপর বাংলাদেশকে এখন আন্তর্জাতিক চাপ জোরালো করতে হবে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে তার অবস্থান স্পষ্ট করে একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে চুক্তি অনুযায়ী অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে শুরু করতে হবে। এ সমস্যার সমাধান যদি দ্রুততম সময়ে করা সম্ভব না হয়, তাহলে রোহিঙ্গারা দেশের অন্যত্র যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেদিকে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। নিবন্ধন অল্প সময়ে শেষ করতে হবে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের খুঁজে বের করে তাদের ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই তাদের কলোনি সৃষ্টি করতে দেওয়া যাবে না। এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে সামাল দিতে বাংলাদেশ যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে সহানুভূতিশীল দেশগুলো রোহিঙ্গাদের ভাগ করে নিয়ে আপাতত আশ্রয় দিতে পারে।
ভারত ও চীন তাদের স্বার্থ দেখবে, মানবতার চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে আঞ্চলিক স্বার্থকে প্রাধান্য না দিলে তাদের যে মাসুল দিতে হবে, কূটনৈতিক তৎপরতা দিয়ে এ উপলব্ধি তাদের জাগ্রত করতে হবে। এ অঞ্চলে চরমপন্থির বিস্তার ও পশ্চিমাদের প্রভাব ঠেকাতে আসিয়ানের নেতাদের অবশ্যই কার্যকর কূটনৈতিক সমাধান খুঁজতে হবে। নীরব কূটনীতি ও মূল্যবোধভিত্তিক হস্তক্ষেপ না করার নীতি আসিয়ানদের গ্রহণ করতে হবে। আসিয়ানকে শক্তিশালী, রাজনৈতিকভাবে জবাবদিহিমূলক সংগঠনে পরিণত করতে হবে এবং শান্তিপূর্ণ ও কার্যকর পন্থায় এই আঞ্চলিক মানবিক সংকট সমাধান করতে হবে। অন্যথায় আমাদের জীবনমান উন্নত ও নিরাপদ রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ যেখানে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনে কঠোরভাবে কাজ করে যাচ্ছে, সেখানে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো বাংলাদেশকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় সহযোগিতা না করলে এ অঞ্চলটি অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়বে। তাই বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে এ অঞ্চলের শান্তি-শৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা একটি জাতীয় ও আঞ্চলিক সমস্যা। এর সমাধানে রাজনৈতিক, জাতিগত ও আঞ্চলিক বিভেদ ভুলে সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
পাঠকের মতামত