বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। অন্তর্জালে অভ্যস্ত সিংহভাগ মানুষ। এখানে চটকদার সংবাদও যেমন মুহূর্তে কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়ে, ভাইরাল হয়, তেমনি মানবিক অনেক ঘটনা অনেক হৃদয় আবেগাপ্লুত করে। কিছু ভাষ্য আমাদের হঠাৎ করেই আয়নার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। প্রথমে মৃদু গুঞ্জন ওঠে, তারপর বিবেকের তাড়নায় আমরা সেই ভাষ্য শেয়ার করি পরিচিতজনের সঙ্গে। এভাবেই দেশ-কাল-সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে যেতে চাই আমরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উচ্চারিত হতে থাকে সেই কথাগুলো।
আটলান্টা প্রবাসী আরিফ মাহমুদ গতকাল ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। পোস্টটিতে ইতোমধ্যেই পাঁচ হাজারেরও বেশি লাইক পড়েছে। শেয়ার হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার। তিনি সেখানে টাঙ্গাইল মধুপুরের কালিয়াকুড়ি গ্রামের ‘ডাক্তার ভাই’ হিসেবে পরিচিত এড্রিক বেকারের কথা বলেছেন। এই চিকিৎসককে প্রথমে গণমাধ্যমে তুলে ধরেন দেশের জনপ্রিয় উপস্থাপক, লেখক, নাট্যকার, পরিচালক হানিফ সংকেত। মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এড্রিক বেকার। জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র মাধ্যমে মহান এই মানুষটির অবদান তুলে ধরেছিলেন তিনি।
সেই কথা স্মরণ করে আরিফ মাহমুদ লিখেছেন: ‘টানা ৩২ বছর টাঙ্গাইল জেলার কালিয়াকৈর গ্রামের (মূলত কালিয়াকুড়ি) দরিদ্র মানুষদের চিকিৎসা দেয়ার পর মারা যান ‘ডাক্তার ভাই’ হিসেবে পরিচিত ডাক্তার এড্রিক বেকার। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে অনেকেই চেয়েছিলেন তাকে ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা দিতে। তিনি ঢাকা যাননি। তাঁর তৈরি করা হাসপাতালেই তিনি ২০১৫ সালে মারা যান। মৃত্যুর পূর্বে তিনি চেয়েছিলেন, এই দেশের কোনো মানবতবাদী ডাক্তার যেন গ্রামে এসে তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতালের হাল ধরে। কিন্তু হানিফ সংকেতের ইত্যাদিতে প্রচারিত প্রতিবেদন অনুসারে এ দেশের একজন ডাক্তারও তাঁর সেই আহ্বানে সাড়া দেয়নি।
দেশের কেউ সাড়া না দিলেও তাঁর আহ্বানে সূদুর আমেরিকা থেকে ছুটে এসেছেন আরেক মানবতাবাদী ডাক্তার দম্পতি জেসিন এবং মেরিন্ডি। যে দেশে যাওয়ার জন্য দুনিয়ার সবাই পাগল। শুধু নিজেরা যে এসেছেন তা নয়। নিজেদের সন্তানদেরও সাথে করে নিয়ে এসেছেন।’
এখানেই থেমে থাকেননি জেসিন এবং মেরিন্ডি দম্পতি। সন্তানদের ভর্তি করে দিয়েছেন গ্রামেরই স্কুলে। গ্রামের শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করে তারা বেড়ে উঠেছে উল্লেখ করে আরিফ মাহমুদ আক্ষেপ করে লিখেছেন: ‘আমরা সুযোগ পেলেই গ্রাম থেকে শহরে ছুটি। শহর থেকে বিদেশ পাড়ি দেই। শিশু জন্মের পর থেকেই চিন্তা থাকে কত দ্রুত সন্তানকে আধুনিক মিডিয়াম ইংরেজি স্কুলে বাচ্চাকে পড়াবো। লুঙ্গি পরাতো আমাদের রুচির সাথে আজ বড়ই বেমানান। লুঙ্গি পরতে পারি না বলতে পারলে- আমাদের আভিজাত্যের পারদ শুধু একটু না অনেকটুকুই বাড়ে। বনানী গুলশান পশ এলাকায় তো একবার লুঙ্গি পরাই নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলো। কারণ ওরা জানে না, ওদের প্লেটে যে খাবার যায় তা এদেশের লুঙ্গি গামছা পরা কৃষকরাই তুলে দেয়।’
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. রুশাদ ফরিদীর বিরুদ্ধে সিন্ডিকেটের দেয়া জবরদস্তিমূলক ছুটির আদেশ অবৈধ ঘোষণা করে তাকে কাজে যোগ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। বিষয়টি নিয়ে সোমবার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন ড. রুশাদ ফরিদী। সেখানে নিজের একটি ছবি দিয়েছেন তিনি। ছবিতে দেখা যায়, তিনি অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে একটি প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। প্ল্যাকার্ডে লেখা: ‘আমি শিক্ষক, আমাকে ক্লাসে ফিরে যেতে দিন।’ ড. রুশাদ ফরিদীর দাবি, ঢাবি কর্তৃপক্ষের অনীহা ও অসহযোগিতার কারণেই তিনি বিভাগে ফিরতে পারছেন না।
বিষয়টি উল্লেখ করে আরিফ মাহমুদ লিখেছেন: ‘কোনো একটা লেখায় পড়লাম- বিদেশের এক শিক্ষক বাংলাদেশের এক অধ্যাপককে বলছেন, আপনাদের ছেলেমেয়েরা বাইরে পড়ালেখা করে কি দেশে ফিরে যায়?
উনি লজ্জায় বললেন, বেশির ভাগই যায় না।
অবাক হয়ে বিদেশী অধ্যাপক বললেন, যায় না কী বলেন! এটা তো ভারী অন্যায়। কারণ জনগণের ট্যাক্সের টাকা সরকার তাদের শিক্ষার পিছনে ইনভেস্ট করলো। আর ভোগ করলো অন্য একটা দেশ।
অধ্যাপক বললেন, ওদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ দেশে এসে উচিত কথা বলতে চাইলে ঘটে পদে পদে দুর্গতি। যেমন উচিত কথা বলায় সম্প্রতি দুর্গতির শিকার হয়েছেন ঢাবি’র অর্থনীতির এক অধ্যাপক। কোর্ট থেকে রায় পেয়েও শরণার্থীর মতো নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন, ক্লাস নিতে পারছেন না।’
এরপরেই আরিফ মাহমুদ লিখেছেন: ‘দেশপ্রেম মাটি, মমতা, মানুষ ইত্যাদি নিয়ে আমরা কত কথা বলি। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি- জাতীয় সংগীত। সোনার বাংলার প্রতি আমাদের ভালোবাসা কত বেশি- তা একবার ইউরোপ আমেরিকার এ্যাম্বেসীর সামনে দেখা গেলেই বুঝা যায়। কাকডাকা ভোর থেকেই বিদেশের স্বপ্নের আশায় মানুষের লাইন। দেশপ্রেম নিয় কত কথা আমি নিজেও তো কম বলি না। কিন্তু বিদেশেই তো পড়ে আছি।’
আরিফ মাহমুদ মূলত ‘ইত্যাদি’তে প্রচারিত হওয়া এড্রিক বেকারের ওপর তৈরি ভিডিও প্রতিবেদন দেখে এই স্ট্যাটাস দেন। সব শেষে তিনি লিখেছেন: ‘ডাঃ জেসন এবং মেরিন্ডি দম্পত্তি আমাদের এক বিশাল লজ্জায় ফেলে দিলেন।’
স্ট্যাটাসে পাঁচ শতাধিক মন্তব্য রয়েছে। অনেকেই দেশের চিকিৎসকদের প্রতি দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ তুলে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। একজন লিখেছেন: ‘মানুষ হয়ে জন্মানোটা আমাদের হাতে না। কিন্তু মানুষ হওয়াটা আমাদের হাতে। সত্যিকারের মানুষ দেখলাম অনেক দিন পর। আল্লাহ আপনাদের হেফাজতে রাখুক।