খাজা বাবার ডেক নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা জেনেছি। এই ডেকে এক সাথে ৩০০০ (তিন হাজার) কেজি খিচুড়ি রান্না করা যায়।এতে বিভিন্ন ধরনের প্রায় নব্বই প্রকারের মসলা একসাথে ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি ২টি ডেক রয়েছি।ডেকসির মুখ প্রায় একতলা ছাদ সমান উচ্চতায় অবস্থিত। ডেকের নিচে আগুন জালানোর ব্যবস্থা রয়েছে।ডেকের চতুর্পাশ্বে উপরের যাওয়ার স্থানী পাকা গোলাকার সিড়ি রয়েছে।মাজারে আগত যে কেউ ঐ ডেকে টাকা কিংবা অন্যকোন পণ্য সামগ্রিক ফেলতে/ডালতে পারেন।ডেকসির ভিতরে টাকা কড়ির পাশাপাশি শুকনো চাল ডালের অস্তিত্ব দেখা গেল।এক কথায় বর্তমানে ডেক দুটি দান বাক্স হিসাবে উন্মুক্ত রয়েছে।আমার খুব ইচ্ছে ছিল এই বড় ডেকের খিচুড়ি খাওয়ার কিন্তু তা সম্ভবপর হয়নি কারণ এই ডেকে এখন প্রতিদিন খিচুড়ি রান্না হয়না।বিশস্ত সূত্র সত্তরোর্ধ রুস্তম ভাই,বাংলাদেশী বংশদ্ভূত ভারতীয় নাগরিক যিনি ছোট বেলা থেকে মাজারে খিদমতে লিপ্ত আছেন,মারফত জানতে পারলাম মাজারে প্রাপ্ত সমগ্র দান/অনুদানের একটি অংশ এই ডেক রান্নার জন্য ব্যয় করা হয়।একটি ডেক একবার রান্নার জন্য ভারতীয় মুদ্রায় তিন লক্ষ বিশ হাজার রুপি খরচ হয়।যখনই অনুদান থেকে সমপরিমাণ অর্থের যোগান হয় তখন মাজার পরিচালনা কমিটি এই ডেক রান্না সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন।কেউ এক সাথে সমপরিমাণ অর্থ দান করলেও একটি ডেক রান্না হয়ে থাকে। উল্লেখ্য মাজারখানা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা জন্য একুশ সদস্য বিশিষ্ট একটি নির্বাহী কমিটি রয়েছে।এই কমিটি সকল খাদেমগণের(আওলাদ) প্রত্যক্ষ ভোটে তিন বছরের জন্য নির্বাচিত হয়।বর্তমানে সারা বিশ্বে খাদেমের সংখ্যা প্রায় চার হাজার।রোজার মাসে প্রতিদিন শতশত লোকজন মাজার এর চতুর্থ পাশে ফ্লোরে বসে একসাথে ইফতার করেন।ইফতারে একটা অংশ মাজার পরিচালনা কমিটি প্রাপ্ত অনুদান থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয় বাকি অংশ ব্যক্তি উদ্যোগে যেকেউ দিতে পারেন।মজার বিষয় হলো সবার ইফতারের প্লেটে একই ধরনের খাবার নেই।কারো প্লেটে খেজুর,আপেল,আঙ্গুর,কলা ত কারো প্লেটে বিরিয়ানি আবার কারো প্লেটে কেক মিষ্টি। মাজারের চর্তুপার্শ্বের উন্মুক্ত মাঠে যেখানে সুবিধা বসার সুযোগ পায়।যে অংশে যেমন ডোনার আসে ইফতারের আয়োজনও ঠিক ঐ মানের হয়ে থাকে।তরমুজ আর কলা সবপ্লেটে কমন আইটেম হিসাবে লক্ষ্য করলাম।তবে ছোলা/বুট মুড়ি নেই বললেই চলে।এক সাথে অনেক লোক ইফতার করলেও খাবারের কোন কমতি কিংবা লোকজনের ঠেলাঠেলি চোখে পড়েনি।ইফতারের সময় একটা তোপ ধ্বনির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়।তার ঠিক আগ মুহূর্তে মাজার আলোক প্রজ্জ্বলনের সময়(রোশনিকা টাইম) সকলে দাড়িয়ে মিলাদ ও বিশেষ মোনাজাত পরিচালনা করা হয় এবং মাজার প্রাঙ্গনের সমস্ত লাইট অন করিয়ে দেওয়া হয়।এই সময়ে আশপাশের ভবনের লোকজনকেও তাদের ঘরের বারান্দা ও ছাঁদে দাড়িয়ে মোনাজাতে অংশ নিতে দেখা যায়। ইফতারের পরপরই মাজার প্রাঙ্গনের ৪ টি মসজিদে মাগরিবের নামাজের আয়োজন হয় তবে জামায়তের সময় একেক মসজিট এ একেক সময়ে।একটা জামায়াত যদি হয় ৭ঃ৩০ মিনিট আরেকটাতে হয় ৭ঃ৩৫ এ।ফলে কেউই তেমন একটা জামাত মিস করেন না।
নারী মুসল্লীদের আলাদা জামায়াতে নামাজ পড়ার সুব্যবস্থা রয়েছে।মাগরিবের নামাজের পর মাজার সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকা থেকে ছোট ছোট ডেকে রান্না করা বিরিয়ানি মাজার প্রাঙ্গনে আসতে থাকে এবং তা আগত ভক্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়।সাধারণত ভক্তদের ইচ্ছা অনুযায়ী স্বস্ব খাদেমের তত্ত্বাবধানে এই বিরিয়ানি রান্না করা হয় এবং রান্না শেষে পুরো ডেক দুইজন লোক কাঁধে করে মাজারে আগত লোকদের বিতরণের জন্য নিয়ে যায়।গরু/মহিষের মাংস দিয়ে এইসব খাবার রান্না করা হয়।আজমীর শরীফের চতুঃপার্শ্বে মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ হওয়ায় এখানে গোমাংস সহজে পাওয়া যায়।
ইমাম বারা রোড এলাকায় এক সাথে কয়েকটা কসাই খানা(গোস্তের দোকান) দেখলাম যেখানে সব কটিতেই গরুর কাঁচা মাংস বিক্রি করা হয়।কৌতুহলবশতঃ গরু মাংসের দাম জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম প্রতিকেজি হাড় মাংস একশত আশি রুপি এবং হাড়ছাড়া মাংস বিশটা বেশি অর্থ্যাৎ দুই’শ রুপি যা বাংলাদেশী টাকায় যথাক্রমে প্রায় দুই’শ বিশ থেকে দুই’শ চল্লিশ টাকার সমমূল্যের।আট হাজার থেকে দশ হাজার টাকায় একেকটি ডেক রান্না করা হয়।কেউ ইচ্ছে করলে একাধিক ডেক কিংবা বেশি পরিমাণ খাবারও বিতরণ করতে পারেন।এটি মাজার এলাকায় লঙ্গরখানায় অনুদান হিসাবে পরিচিত।এর বাইরেও আরো বিভিন্ন খাতে অনুদানের অপশনও রয়েছে যেমন এতিমখানা,ফুল ছাদর ইত্যাদি।
আরও পড়ুন “কক্সবাজার থেকে আজমীর শরীফ”
মাগরিবের নামাজের পর আমরা আজমীর শরীফ দরগাহ থেকে রুমে চলে আসি।এরপর একটা টুকটুক(টমটম) ভাড়া নিয়ে রাতের আজমীর শহর দেখতে বের হই।এক পর্যায়ে আমরা ঐতিহাসিক আনা সাগর লেকে চলে যায়।প্রায় তের কিলোমিটার দীর্ঘ এই লেকটির নাম আনা সাগর হলেও প্রকৃতিপক্ষে এটি একটি কৃত্রিম হ্রদ যা দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে অর্নোরাজা (ওরফে আনা) এর দাদা পৃথ্বীরাজ চৌহান স্থানীয় জনগণের সহায়তা নির্মাণ/খনন করেছিল।হ্রদের কাছে পাহাড়ে একটি সার্কিট হাউস রয়েছে যা ব্রিটিশ রেসিডেন্সি হতো। এটি সেখানে ভ্রমণকারীদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। হ্রদের মাঝখানে একটি দ্বীপ রয়েছে যা নৌকায় করে প্রবেশযোগ্য।আনা সাগর হ্রদের পাশে পায়ে হাটার প্রশস্ত পথ রয়েছ । একপাশে শিশুদের বিনোদন স্থানও রয়েছে।হ্রদে প্রবেশ করতে কোন টিকেট নিতে হয়না তবে বোট ভ্রমনের জন্য আলাদা টিকেট কিনতে হয়।কথিত আছে খাজা মঈনউদ্দীন চিশতি (রহঃ) তার কাফেলা নিয়ে আজমির আগমনের সময় সর্ব প্রথম এই লেকের তীরে অবস্থান নিয়ে ছিলেন এবং তাঁর কাফেলার একজন মুসলিম এই আনা সাগর লেকে ওযু করতে গিয়ে তৎকালীন হিন্দু পুরোহিত দ্বারা লাঞ্ছিত হন।এতে খাজা মঈনউদ্দীন চিশতি (রহঃ) তাদের উপর কিছু রুষ্ট হয়ে ঐ লেক থেকে একবাটি পানি নিয়ে আসতে বলেন।একবাটি পানি আনাতে অলৌকিকভাবে মুহূর্তের মধ্যে পুরো আনা সগরের পানি শুকিয়ে যায়।এতে হিন্দু পুরোহিতরা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে এবং তৎকালীন রাজার পরামর্শে খাজা মঈনউদ্দীন চিশতি (রহঃ) তাদের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।মঈনউদ্দীন চিশতি (রহঃ) তাদের ক্ষমা করে দেন এবং ঐ একবাটি পানি আবার আনা সাগরে ফেলে দিতে বললেন।সঙ্গে সঙ্গে লেকটি পানিতে পূর্ণ হয়ে গেল।সেই থেকে আনা সাগর লেক ঐতিহাসিক নিদর্শনে রুপান্তরিত হলো।আজমীর শরীফ জিয়া’রতে আসা ভক্তদের জন্য সৈয়দ নাদিম চিশতি (রহ) এর বাড়ি সংলগ্ন ইমাম বাড়া রোডে চিটাগং বাড়ি নামক একটি মেহমান খানা রয়েছে।এই মেহমান খানায় আগত মেহমানদের সরাসরি খাজা বাবার মেহমান হিসাবে গণ্য করে বিনামূল্যে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।চিটাগং বাড়ি চট্টগ্রামের এক ভক্ত তৈরি করে দেন বর্তমানে এটিতে লিফট সংযোজনের কাজ চলছে।মেহমান হিসাবে আথিতেয়তা গ্রহন করার জন্য আগে থেকে খাদেমের সাথে যোগাযোগ করে রাখা ভালো।
চলবে….
লেখক,
জিয়াউর রহমান মুকুল,
উপ-পরিচালক (স্বাস্থ্য ও পুষ্ট),
শেড,কক্সবাজার।
ইমেইলঃ[email protected]
পাঠকের মতামত