পরদিন ১৭ এপ্রিল-২০২২ সকাল ৯ টায় আমরা একটা টয়োটা কার যোগে আজমীর শহর থেকে রাজস্থানের রাজধানী জয়পুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করি।জয়পুর সিটি ট্যুরসহ ভাড়া পড়ল তিন হাজার পাচশত রুপি।এতে সিটি ট্যুরের পাশাপাশি রাস্তার টোল এবং পার্কিং ফিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। আজমির শহর থেকে জয়পুরের দুরত্ব প্রায় ১৪০ কিলোমিটার। সড়ক পথে প্রায় ৪ ঘন্টা সময় লাগল।আজমীর শহর থেকে জয়পুর শহর পর্যন্ত রাস্তা বেশ ভালো এবং পাশে অনাবাদি বিস্তৃত মাঠ কিছু ধূসর পাহাড়ও কোথাও কোথাও চোখে পড়ল।জয়পুর আসার পথে আমরা কিষাণগড় রেল স্টেশন থেকে পরের দিনের আজমীর শতাব্দী ট্রেনের জয়পুর-দিল্লি যাওয়ার টিকেট সংগ্রহ করি।আগেই বলেছি ভারতে এক জংশন থেকে অন্য যে কোন রুটের টিকেট সংগ্রহ করা যায়।একটু রিমোট এলাকায় স্টেশনটির অবস্থান হওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যে টিকেট পেয়ে যায়। জয়পুর শহরে ডুকতেই রাজকীয়তার ছোয়া চোখে পড়ল।পুরো জয়পুর শহর একই রংয়ের এবং অধিকাংশ স্থাপনা পিংক রংয়ে রাঙ্গানো সম্ভবত সে কারণেই এটিকে পিংক সিটি বা গোলাপি শহর বলা হয়।শহরের রাস্তা ঘাট বেশ পরিচ্ছন্ন।
তবে বাহিরে গরম ছিল বেশ।তখন জয়পুরের টে্ম্পারেচার প্রায় ৪০/৪১ ডিগ্রি।আজমীর থেকে ফিরার পথে বুকিং ডট কমের মাধ্যমে হোটেল বুক করে রাখা হয়। মাউন্ট ব্লু নামক হোটেলে জিএসটিসহ রুম ভাড়া পড়ল আঠারশত রুপি।বেশ বড়সড় এসি রুম।অভিজাত ফার্নিচার।হোটেল থেকে হাওয়া মহলের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার মত হবে।আমরা ( আমি,আমার স্ত্রী আর ২ বছর বয়সী ছেলে) হোটেলে ফ্রেশ হয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম সিটি ট্যুরে।আমাদের হাতে সময় আছে আজকে আর পরদিন দুপুর দুইটা পর্যন্ত।কারণ পরদিন(১৮ এপ্রিল-২২) দুপুর তিনটায় আমাদের হোটেল চেক আউট করতে হবে এবং আমাদের ট্রেন বিকাল পাঁচটা চল্লিশ মিনিটে জয়পুর স্টেশনে পৌছাবে এবং ঠিক পাঁচ মিনিট পর বিকাল পাঁচটা পয়তাল্লিশে দিল্লির উদ্দেশ্যে জয়পুর স্টেশন ছাড়বে।সে হিসাবে আমরা চারটা ত্রিশের মধ্যে রেল স্টেশনে যাবার প্লান করি।
অপেক্ষমাণ গাড়িতে করে বেড়াতে বের হয়ে প্রথমে গেলাম হাওয়া মহল তারপর আমের ফোর্ট।মহারাজা মান সিংহ ১৫৯২ সালে এটি নির্মাণ করেন।প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন ও মহারাজারদের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত স্থান এটি।বলা হয়ে থাকে আমের পোর্ট ভ্রমণ না করলে নাকি জয়পুর ভ্রমণ অপূর্ণ থেকে যায়। আমের পোর্ট রাজস্থান প্রদেশের সাবেক রাজধানী এবং এই শহরটি পাহাড়ের পাদ দেশে অবস্থিত।রাজ প্রসাদটি একেবারে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত।পাহাড়ের চতুর্প্বাশে সুউচ্চ দেয়াল নির্মাণ করে শহরটিকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করা হয়েছিল।বর্তমানে পুরো আমের পোর্ট ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান হিসাবে সংরক্ষিত স্থান।এখানে বেশ সংখ্যক পর্যটকের যাতায়াত লক্ষ্য করা যায়।আমাদের গাড়ি পোর্টের মেইন গেট পর্যন্ত গিয়ে একশত রুপিতে পার্কিং করা হলো।সাথে সাথে কয়েকজন লোক তাদের জিপগাড়ি ভাড়া নেওয়ার জোরালো আবেদন করলো।আমি একটু দর-কষাকষি করতে চাইলে তারা খুটিতে ঝুলানো একটি রেট চার্টের দিকে ইঙ্গিত করে আমাদের বুঝিয়ে দিলেন এটি সরকার কর্তৃক নির্ধারিত রেট।কম বেশি করার সুযোগ নাকি তাদের নেই।যাইহোক রেট চার্ট অনুযায়ী চারশত পঞ্চাশ রুপিতে আসা যাওয়ার জন্য একটি জিপ গাড়ি ভাড়া নেওয়া হলো।গাড়ি ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে পাহাড়ের নিদির্ষ্ট গন্তব্যে গিয়ে আমাদের নামাল।পথিমধ্যে সরকারি ট্যুর গাইডরা আমাদের সেবা করার জন্য বেশ চেষ্টা করলো,কিন্তু আমার অমতের কারণে তারা সফল হয়নি।শেষতক একজন ইংরেজি জানা গাইড দুইশত রুপিতে চুক্তি করলাম।উনি আমাদের পুরো এলাকা ঘুরে ঘুরে ঐ স্থানের ঐতিহাসিক তথ্যবহুল গুরুত্ব তুলে ধরলেন।তার কয়েকটা স্থানের নাম ছিল জালেব মর্ঘ,দেওয়ানে আম,দেওয়ানে খাস,শীষ মহল,জীনা মহল (রাজদরবারের নারীস্থান),শান্তি নিবাস ও গনেষ পোল ইত্যাদি।পোর্ট বা প্যালেসটি প্রতিদিন সকাল ৮ থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।গাড়ি পরির্বতে হাতির পিঠে চড়েও নাকি পাহাড়ে উঠা যায় তবে হস্তিবাহন আমাদের নজরে পড়েনি।প্যালেসের প্রবেশ মুখে রাজস্থানের ঐতিহ্যবাহী ফোকগানের আসর বসে।রাজস্থানের স্থানীয় শিল্পীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী জামা গায়ে দিয়ে পুরনো ধাঁচের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে খালি গলায় গান করেন।কখনো কখনো গান ছাড়ায় বেহালায় সুমধুর সূর তুলেন।লোকজন জটলা পাকিয়ে উপভোগ করেন এই গান।জালেব চৌকের পাশেই দূর্গে প্রবেশের টিকেট কাউন্টার। টিকেট মূল্য ভারতীয় নাগরিকদের জন্য পঞ্চাশ রুপি হলেও বিদেশি নাগরিকদের জন্য পাঁচশত পঞ্চাশ টাকা!বিষয়টি আমার কাছে মোটেও ভালো লাগেনি।অন্তত তারা আমাদের মত প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য একটু কমিয়ে নিতে পারত।পুরো এলাকা ভালোভাবে ঘুরে দেখার জন্য একবেলা সময় প্রয়োজন।ন্যুনতম তিন চার ঘন্টা ত লাগবেই।আমাদের সময় সল্পতার কারণে ঘন্টা খানেকের মধ্যে আমাদের গাড়িতে ফিরে আসলাম।আসার পথে ক্ষণিকের জন্য রাজস্থানের বিখ্যাত কটেজ মিলেও যাবার সুযোগ হয় কিন্তু আপাততঃ ওখান থেকে আমরা কোন কাপড় কিনি নাই।আমের পোর্ট কিংবা আম্বার প্যালেস জয়পুর শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।আসার পথে জল মহাল ভ্রমণ করলাম।জল মহল মহারাজা দ্বিতীয় মান সিংহ মান সাগর হ্রদের মাঝাখানে ১৬৯৯ সালে নির্মাণ করেন।বর্ষা মৌসুমে জল মহাল পাঁচ তলা বিল্ডিং এর প্রায় চার তলা জলে ডুবে যায়।এটি ভোর থেকে রাত দশটা পর্যন্ত খোলা থাকে।বাহ্যিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এখানে কোন টিকেটের ব্যবস্থাও নেই। জল মহালের পাশে হকাররা বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী বিক্রি করেন।রাজস্থানের পোষাক ও ঐতিহ্যবাহী ভারী গহনা ভাড়ায় নিয়ে ফটো তুলার ব্যবস্থাও ঐখানে রয়েছে।ঘোড়ার গাড়ি ও উটের পিঠে চওয়ার হওয়ার বন্দোবস্ত এই মহলকে বিশেষভাবে আকর্ষনীয় করেছে।স্ট্রীট ফুডের বেশ চাহিদা লক্ষ্য করা যায় প্রায় প্রতিটি দোকানে। জল মহালের জলে বিভিন্ন প্রজাতি পাখির দেখা মিলে তন্মধ্যে পানকৌড়ি,বেজি(নেউল),বক ও ডাহুক উল্লেখযোগ্য। একটা মুরগী ডাহুককে দেখা গেল ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে প্রায় লোকজনের গা ঘেঁষে চড়তেছিল।আশে-পাশে অনেক পর্যটক ও হকার লোকজন থাকলেও কেউ তাদের বিরক্ত করেনি।এই জন্যই মনে হয় তাদের অবাধ বিচরণ চোখে পড়ে।ডাহুক দেখছিলাম আর আমি আমাদের দেশে আগত পরিযায়ী পাখির কথা ভাবছিলাম। ভারতে বন্য প্রাণীরা অনেক সুখে আছে মনে হলো।জল মহাল ভ্রমন শেষে আমরা বিরলা মন্দিরের কাছে গিয়ে ঐ কার গাড়িটি ঐদিনের মত বিদায় দেয়।হোটেল রুমে এসে ইফতার সেরে বের হলাম রাতের জয়পুর দেখতে।পথিমধ্যে আমার ছেলের বিরিয়ানির আহ্লাদ।
বিরিয়ানি খুজতে শুরু করে এক মিষ্টির দোকানে লাচ্ছি খেলাম।এই দোকানের আপেল কালারের আপেল মিষ্টি সবাইকে মুগ্ধ করে। পরক্ষণেই খোজ পেলাম একটু দূরের এক দোকানী বিরিয়ানি রান্না করেন।পায়ে হেটে পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যে পেয়ে গেলাম স্বাদের বস্তু। বড় ডেকে বিরিয়ানি রান্না করা হয়েছে।পাশে আরো একটা ডেকে কি যেন রান্না করেছেন।একেবারে রাস্তার ধারে প্যান্ডেল খাটিয়ে বিরিয়ানি বিক্রি হচ্ছে। টেবিলে ভাজ করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে প্লাস্টিকের বাক্স।কোনটা বড় কোনটা মাঝারি সাইজের। বিরিয়ানির অর্ডার দিতে গিয়ে একটু টাশকি খেলাম।সে আমার জিজ্ঞেস করল এক কিলো না হাফ কিলো।আমার ধারণা এক কিলো মানে বড় বাড়ি আর হাফ কিলো মানে মাঝারি বাটি; তাকে বললাম এক কিলো দিতে।একি! সে দেখি ঐ বাটির কোনটাতে না দিয়ে দাঁড়ি পাল্লায় একটি গামলাসহ বিরিয়ানি ওজন করে তারপর পলিথিনে করে দিল।আমরা একে অপরের দিকে নির্বাক দৃষ্টিবিনিময় করে কথা না বাড়িয়ে হাতে নিলাম।দাম কত?এক কিলো একশত বিশ রুপি মাত্র।বাংলাদেশী টাকায় প্রায় একশত চল্লিশ টাকার সমমূল্যে।পরে আরো ত্রিশ রুপি দিয়ে পাশের ডেকে রান্না হালিম নিলাম প্রায় তিনশ গ্রাম।তাও পাল্লায় ওজন করে দিল।রাত ৯ টার দিকে রাজস্থানের প্রায় দোকানপাট বন্ধ হতে থাকে।একই ঘটনা আমি নেপালের রাজধানী কাঠমুন্ডু ও ভারতের অন্যান্য শহরে লক্ষ্য করছি।আমাদের দেশের মত লোকজন নিশাচর প্রাণীর মত বিকিকিনি করেনা।রুমে এসে বিরিয়ানির খেতে বসলাম।বিরিয়ানির পরিমাণ সরু চিকন লম্বা বাসমতী চালের ভাত ও মহিষের মাংস দেখে বেশ মুগ্ধ হলাম।ভাত আর মাংস পরিমাণ দেখে আমরা বারংবার আমাদের দেশের হাজী বিরিয়ানির সাথে তুলনা করে পুলকিত হচ্ছিলাম।কম করে হলেও পাঁচ প্যাকেট হাজী বিরিয়ানির(ফুল) সমপরিমাণ হবে।আর দাম নিলো মাত্র একশ কুড়ি টাকা।এক বিরিয়ানির দিয়ে আমাদের তিনজনের রাতের ও সকালের খাবার হয়ে গেল।হয়ত তাদের পক্ষে এই কারণে সম্ভবপর হয়েছে কারণ মাংসের দাম কেজি একশ আশি টাকা আর বাসমতী চাউল ভারতে নরমাল থালিতেও ব্যবহার করা হয়।বাসমতী চাল তাদের দেশে সহলভ্য জিনিস।এর মধ্যে আমরা আলবার্ট মিউজিয়াম,বাবু বাজার সন্জয় বাজারও ঘুরে আসলাম।আমার ছেলে আলবার্ট মিউজিয়ামে বেশ দৌড়াদৌড়ি করে শান্তি পেল।আলবার্ট মিউজিয়ামে ডুকেই সে আমাকে নামাজ পড়ার জন্য ডাকছিল এবং সেও দেখি সিজদাহ্ দিচ্ছে। পরে আমরা বুঝতে পারলাম এর আগের তিন দিনে আমরা আমরা নিজামউদ্দিন আওলিয়ার মাজার সংলগ্ন মসজিদে, দিল্লি শাহী জামে মসজিদ ও আজমির শরীফের মোজাইককৃত মসজিদে তাকে সঙ্গে নিয়ে নামাজ পড়ছিলাম তাই তার মনে হয়েছে এখানেও সাদা মারবেল পাথরের মেঝে রয়েছে সুতরাং এখানেও নামাজ পড়তে হবে।পর দিন সকালে রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়।প্রচন্ড গরম ছিল।আমার মনে হয়েছে জয়পুরে সর্বোচ্চ গরম বোধহয় এই ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসেই পড়ে।ক্যান্টিনে ছেলেকে নাস্তা করাতে গিয়ে দেখি সিংগারা ছাড়া পরিচিত তেমন কোন খাবার নেই।পরে একটা সিংগারা অর্ডার করলাম।আমি বলি সিংগারা আর দোকানী বলে ছমুছা! এত দেখি মহা মুশকিল!পরে বুঝতে পারলাম ওরা সিংগারাকে ছমুছা বলে।হিন্দি না জানা মানুষের রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সবক 'সিংগারা মানে ছমুছা'।এর পরে একে একে বিজ্ঞান ভবন,গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ভবন আর ল ফ্যাকাল্টি ঘুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ ঐ দিনের মত শেষ করি।আইন বিভাগের চেয়ারম্যান স্যারের সাথে উনার অফিসে সংক্ষিপ্ত আকারে সৌজন্য সাক্ষাৎ করি।অতি গরমে আমার ছেলের ঐ ক্যাম্পাস পছন্দ না হওয়ায় পরিকল্পিত সময়ের আগেই ক্যাম্পাস ত্যাগ করি।তবে অনেক বড় ক্যাম্পাস এক ফ্যাকাল্টি থেকে আরেক ফ্যাকাল্টি দূরত্ব বেশ বড়।ল ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান স্যারকে বেশ অমায়িক ও ভদ্রলোক মনে হলো।না হয় আমাদের মত আগন্তুকের সাথে কোন এপয়েন্টমেন্ট ছাড়া কথা বলার কি দায় পড়ছিল উনার।হোটেল রুমে ফিরে খানিক বিশ্রাম নিয়ে ব্যাগ বেগেজ গুছিয়ে জয়পুর রেল স্টেশনে ছুটলাম,বিকাল পাঁচটা চল্লিশের ট্রেন ধরার জন্য।
চলবে...
লেখকঃ
জিয়াউর রহমান মুকুল,
উপ-পরিচালক (স্বাস্থ্যও পুষ্টি)
শেড,কক্সবাজার।
ইমেইলঃ[email protected]